[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

আজকের ভাবনা [ Today’s thoughts ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ]

আজকের ভাবনা [ Today’s thoughts ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : জীব-উদ্ভিদ দুনিয়ার তাবৎ প্রাণীই জীবনকে ভালোবাসে এবং জীবনের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও বিকাশ কামনা করে। আর সব জীব-উদ্ভিদের জীবন প্রকৃতিনির্ভর। তাই তাদের জীবন প্রকৃতির নিগড়েই আবর্তিত হয়। আঙ্গিক-উৎকর্ষের দৌলতে মানুষ প্রকৃতিকে কৌশলে বশ করে বান্দার মতো তার ইচ্ছার অনুগত করেছে। তাই মানুষ প্রকৃতিও প্রবৃত্তিবিরুদ্ধ কৃত্রিম জীবন রচনার ও জীবিকাসৃষ্টির সামর্থ্যগৌরবে গর্বিত।

 

আজকের ভাবনা, আহমদ শরীফ
আজকের ভাবনা, আহমদ শরীফ

 

সে জীবশ্রেষ্ঠ, মন ও মননধনে ধনী। তার সমাজ ও শাস্ত্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি তার চিন্তা চেতনার প্রসূন- তার জীবনের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও বিকাশলক্ষ্যে নিয়োজিত তার জীবিকা-পদ্ধতির ফসল। জীবনটাই তার এক পরম ঐশ্বর্য। পৃথিবীর ব্যক্ত ও গুপ্ত সব পদার্থই তার সম্পদ। সৃষ্ট সম্পদ ও শক্তির উপযোগ সৃষ্টি করে সেও স্রষ্টার মতো আনন্দিত।

এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে জিজ্ঞাসা ও আকাঙ্ক্ষার অশেষতায় ও অপরিমেয়তায়। জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল অভাব ও বাঞ্ছা জাগায়। তা-ই আশা ও আকাঙ্ক্ষা হয়ে উদ্যম, উদ্যোগ ও প্রয়াস সৃষ্টি করে। জীবনে মন মননের বিকাশ ও বিস্তার ঐ আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়াসেরই প্রসূন। ভাব-চিন্তার প্রয়োগে পাই কর্ম। সে-কর্মের ফসলই জীবনের পাথেয়। ভাবচিন্তা-কর্ম তাই জীবনের পুঁজি। জীবনটাই একটা অসীম সম্ভাবনা-প্রসূ সম্পদ।

 

আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature
আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature

 

ঐ ঐশ্বর্য-চেতনাসম্পন্ন মানুষই জীবনের মুহূর্তগুলো সম্পদ-সৃষ্টিতে ও বৃদ্ধিতে নিয়োগ করে। জীবন-জমি আবাদ করলেই ফলে সোনা। জীবনেও থাকে চাষের মৌসুম, বোনার ঋতু আর ফসল তোলার কাল। আবাদের অতিক্রান্তকালে ফুল ফোটাবার, ফল ধরাবার প্রয়াস ব্যর্থ হবেই। এ-বোধ যাদের আছে, তারাই আবিষ্কারে-উদ্ভাবনে-অর্জনে সঞ্চয়ে-রক্ষণে সদা-সচেতন। সফল ও সার্থক জীবনের প্রসাদ তাদেরই প্রাপ্য। জাতীয় জীবনেও এ তথ্য ও তত্ত্ব প্রযোজ্য। কিন্তু এর জন্য নতুন চেতনার প্রয়োজন। কেননা নতুন চেতনাতেই নতুন স্বপ্নের, সাধের ও আকাঙ্ক্ষার জন্ম।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

পুরাতনের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, সন্দেহ ও অনাস্থাই নতুন চেতনার লক্ষণ। তৃপ্ত ও তুষ্ট হৃদয়ে দ্রোহ নেই। দ্রোহবিরহী প্রয়াস-প্রযত্ন অসম্ভব। কেননা দ্রোহ ব্যতীত পুরাতন পরিহারের প্রেরণা এবং নতুন বরণের বাঞ্ছা জন্মায় না। তৃপ্তি ও তুষ্টি জড়তা ও জীর্ণতার শিকার। তৃপ্তি ও তুষ্টি তাই বন্ধ্যা ও বৈনাশিক। পুরোনো জীবননীতি ও জীবিকারীতির মধ্যে স্থিতি-কামীর আপাতসুখকর নিশ্চিন্ত ও নিষ্ক্রিয় জীবন পরিণামে বৈনাশিক বীজের আকর হয়ে ওঠে। তাই স্থিতিতে মরণ।

 

আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature
আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature

 

অতৃপ্তি ও অসন্তোষ নিগড় ভাঙার উদ্যম ও উদ্যোগের জনক, প্রয়াস-প্রযত্নের প্রসূতি, সৃষ্টিশীলতার ও সৃষ্টির উৎস। এজন্যেই গতিতে জীবন। জিজ্ঞাসার, আকাঙ্ক্ষার ও চেতনার কথা এত করে বলতে হচ্ছে এজন্য যে, আমরা আকস্মিকভাবে এক অনাস্বাদিতপূর্ব অনভ্যস্ত সম্পদ সম্প্রতি পেয়ে যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

এর জন্য যে আমাদের মানস প্রস্তুতি সম্যক ছিল না, তা সততার সঙ্গে স্বীকার করা কল্যাণকর। কেননা আমাদের যোগ্যতা অর্জনে ঐ স্বীকৃতিই প্রবর্তনা দেবে। এই নতুন ও সুদুর্লভ সম্পদটি হচ্ছে স্বাধীনতা। শশাঙ্ক ও গণেশগোষ্ঠীর কথা বাদ দিলে বাঙালী জীবনে এই প্রথম স্বাধীনতা-সম্পদ অর্জিত হল। স্বাধীনতা কি সূর্য-প্রতিম! হয়তো তা-ই। কেননা পার্থিব প্রাণ সূর্য-সম্ভব এবং এর লালনও সূর্য-নির্ভর।

 

আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature
আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature

 

আজকের দিনে দৈশিক ও জাতিক জীবনও তেমনি স্বাধীনতা-সূর্যমুখী। কারণ একালে মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও বিকাশ দৈশিক বা জাতিক স্বাধীনতাভিত্তিক। আগের কালের বোকা মানুষেরা স্বদেশী, স্বধর্মী ও স্বজাতি রাজা পেলেই স্বাধীনতার গৌরব-গর্ব-সুখ অনুভব করে তৃপ্ত থাকত। এ-যুগ রাজার রাজত্বের নয়, গণমানবের সমবায় সংস্থার। তাই এ-যুগে স্বাধীনতার তাৎপর্য ভিন্ন। এ-যুগে সামরিক স্বনির্ভরতা ও আর্থিক স্বয়ম্ভরতার নামই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতা। গণমানবের জীবন-জীবিকার বিকাশ-বিস্তারই হচ্ছে স্বাধীনতার প্রসাদ।

নতুন চেতনাতেই নতুন ভাব-চিন্তা কর্মের জন্ম, নতুন নীতির উদ্ভব এবং নতুন বস্ত্র আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সম্ভব। আবার নতুন চেতনার অনুকূল প্রতিবেশেই নতুনের লালন ও বৃদ্ধি সহজ ও স্বাভাবিক হয়। রাম না জন্মিতেই নাকি রামায়ণ রচিত হয়েছিল। লোকে তা বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমরা করি। কেননা মনোজগতে মানসপ্রতিমা রচিত না হলে বাহ্যজগতে মূর্তি তৈরি হতে পারে না। চিৎ না থাকলে চিত্র আসবে কোথা থেকে! কল্পলোকে কল্পনা চাই, পরিকল্পনা চাই–তবে তো তার বাস্তবায়ন!

স্বাধীনতা অর্জনের আগেও তেমনি স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষা চাই, স্বাধীনতা উপভোগের নীতিরীতি জানা চাই, স্বাধীনতা অনুভবের জন্যে চিত্রকর্ষ চাই। স্বাধীনতা প্রয়োগের নৈপুণ্য চাই। যে কোনো বস্তু ও শক্তির উপযোগ-বুদ্ধি থাকা চাই, নইলে সুলভ বা লব্ধ হলেও তা কখনো সম্পদ হয়ে ওঠে না। উপযোগ-বুদ্ধিই বস্তু ও শক্তিকে কেজো করে জীবিকানুগত করে।

 

আজকের ভাবনা, আহমদ শরীফ
আজকের ভাবনা, আহমদ শরীফ

 

অন্যায়, অসুন্দর ও অকল্যাণ দ্বেষী না হলে কেউ কখনো বিবেক-বুদ্ধির আনুগত্যে স্বীকারে সমর্থ হয় না। তেমন মানুষ নাগরিকত্বের অযোগ্য। দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবুদ্ধি, দাবি ও অধিকার-চেতনা কখনো বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র হতে পারে না, তাদের সম্পর্ক বলতে গেলে অঙ্গাঙ্গী কিংবা ঐকাত্মিক।

সমস্বার্থে সহযোগিতা ও সহাবস্থানের অঙ্গীকারে সহিষ্ণু মানুষের সঙ্ঘশক্তির প্রয়োগে দৈশিক জীবনে গণমানবের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সামগ্রিক কল্যাণ ও স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ্যে মানবিক বিকাশ ও বিস্তার কামনায় আনুপাতিক সাম্যের ভিত্তিতে বণ্টনে বাঁচার ব্যবস্থা করা ছাড়া আজকের দুনিয়ায় মানবিক সমস্যার সমাধানে বোধগত অন্য কোনো উপায় আপাতত নেই।

বহু-পরীক্ষিত কাড়াকাড়ি, বঞ্চনা, বড়ান্ত, মারামারি ও হানাহানিতে এ-যুগে-যে সমাধান কিংবা কারো কল্যাণ নেই, তা আশুউপলব্ধ হওয়া উচিত। নির্ভয়ে নির্বিরোধে সহাবস্থান করবার জন্যে আজকের মানুষকে মানববাদী হতে হবে এবং আত্মকল্যাণেই পড়শী-প্রীতির অনুশীলন করে সেবা সততা ও ত্যাগপ্রবণতার বিস্তার ঘটাতে হবে। এ না হলে কেউ স্বাধীনতা অর্জনের ও অনুভবের এবং রক্ষণের ও উপভোগের যোগ্য হয় না।

 

আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature
আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature

 

প্রকৃতির জগতে দেখা যায় বুনোপাখি খাদ্যরূপেই ঠোঁটে কিংবা পেটে করে দূরদূরান্তের নানা বৃক্ষবীজ স্থানান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। এতে ভাগ্যবলে কোনো বীজ প্রাণ পায়, অনুকূল পরিবেশে মহীরুহ হয়ে ধন্য হয়। কিন্তু সব বীজ সে সুযোগ পায় না, হতভাগ্যের সংখ্যাই অধিক। মনুষ্যজীবনেও ভাগ্য ক্বচিৎ প্রসন্ন হয়। ভাগ্যের বরাত দিয়ে বসে থাকলে ভাগ্য প্রায়ই প্রতারিত করে।

ভাগ্যবিড়ম্বিতের কাছে জীবনটা কখনো মরীচিকা, কখনো মরুমায়া এবং কখনোবা মরুশিখাও। জাতীয় জীবনেও তেমনি দায়িত্ব ভুলে কর্তব্য এড়িয়ে ভোগ করতে উৎসুক হলে, ভাগ্যের হাতে মার খেতে হবে। কাজেই অর্জিত স্বাধীনতা উপভোগের যোগ্যতা অর্জনই আমাদের আশু কাম্য। অন্যায়-অসততা-অকর্মণ্যতা অনুরোধে-প্রতিবাদে প্রতিরোধে প্রতিকার করার যোগ্যতাই হবে প্রাথমিক লক্ষ্য। এবং তার জন্য দরকার। মন-জাগানো ও মন-বানানো।

 

[ আজকের ভাবনা – আহমদ শরীফ ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment