একগুচ্ছ প্রশ্ন [ A bunch of questions ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : পাকিস্তান আমলে ২১শে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিচারণ আমাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করার, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ও সংগ্রামী চেতনা অর্জনের জন্যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। সেদিন তা ছিল উদ্দীপনার, উত্তেজনার ও স্বাতন্ত্র্য-চেতনার উৎস। স্বাধীন বাঙলাদেশে সে-পর্ব চুকে গেছে।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারির পার্বণিক উদযাপন আমাদেরকে কেবল বিজয়ী ও কৃতার্থম্মন্যের আত্মপ্রসাদ দিতে পারে। এই ঐতিহ্যস্মৃতির রোমন্থন-সুখ নতুন কোনো লক্ষ্যের সন্ধান কিংবা আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেবে না। দেশে আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি মোহররমের মতো তাৎপর্যহীন পার্বণে এবং শহীদমিনারগুলো পৌরাণিক পরিত্রতায় ইমামবাড়া বা বুদ্ধস্তূপের মতোই শোভা পাবে।
এই নির্লক্ষ্য আচরণের নাম আচার, তাৎপর্যভ্রষ্ট অনুসৃতির নাম প্রথা। দুটোই বন্ধ্যা এবং জীবনে বোঝা ও বাধা। অতীতাশ্রয়ী মনে অর্থাৎ ঐতিহ্যের গৌরবগরী মনে একপ্রকার তৃপ্তম্মন্যতা আসে, তার অনুভব-সুখ মানুষকে উদ্যমহীন ও উদ্যোগ-বিরহী করে তোলে। যেমন, ধনীর সন্তান আলস্যসুখে অভিভূত থাকে। অর্জনে সম্পদবৃদ্ধির আন্তঃপ্রেরণা সে অনুভব করে না অভাবজাত যন্ত্রণাবোধ থাকে না বলেই ।
![একগুচ্ছ প্রশ্ন [ A bunch of questions ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 google news](https://glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
কাজেই যার এগিয়ে যেতে হবে, তার সুখস্মৃতির জন্যে কিংবা গৌরব-গর্বের জন্যে বারবার ও ঘনঘন পিছু তাকালে চলে না। রক্তক্ষরা লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা এসেছে, লোক তো মরবেই, কিন্তু স্বাধীনতাও চাইব আর লড়িয়ে মৃতের জন্যে বারোমাস অনিবার নানা ছলে কাঁদব—এ বীরধর্ম তো নয়ই, স্বস্থ ও সুস্থ মানব-স্বভাবও নয়। প্লেটোর রিপাবলিকে এ বিলাপের কুফল সম্বন্ধে উচ্চারিত বাণী স্মর্তব্য।
গৃহগত জীবনে মানুষের মা-বাপ, ভাইবোন, ছেলেমেয়ে মরে, তাই বলে কি তারা সারাজীবন ধরে প্রিয়জনের জন্যে কাঁদে, না সর্বক্ষণ তাদের স্মরণ করে কাজে ও কর্তব্যে অবহেলা করে?
বিগত দুই বছর ধরে আমরা যে উৎসাহে প্রায় প্রত্যহ জাতীয় বিলাপ-ব্রত উদযাপন করছি, তাতে আমাদের বিমূঢ় বন্ধ্যা মন ও অসুস্থ জীবনদৃষ্টির পরিচয় মেলে। তাও আমরা সব নিহত মানুষের জন্যে দুঃখ করিনে। কেবল ‘বৃদ্ধিজীবী’ সংজ্ঞাভুক্ত শিক্ষিত লোকদের জন্যেই সভা করে কাঁদি। তাদের পরিবার-পরিজনদের কথাই ভাবি।
আফসোসটা যেন এই–ওরা বাঙালী মারবেই যদি, তাহলে মুটে-মজুর-চাষীদের মেরেই সাধ মিটাল না কেন, ভদ্দরলোকের প্রাণে হাত দিল কেন? এ-ই হচ্ছে শিক্ষিত ও সমাজতন্ত্রী বাঙালী মনের স্বরূপ! সারাদেশে ভদ্রলোক মরেছে কয়জন; আর অশিক্ষিত বলি হয়েছে কত? তাদের খবর নিল কে? তাদের বউ কি বিধরা হয়নি? তাদের সন্তান কি এতিম হয়নি? তারা কি সরকারি-বেসরকারি বৃত্তি পেয়েছে? তারা কি করে খায় জানবার কৌতূহল আছে কি কারো?
সৈনিকের নারীধর্ষণ কি অভিনব উপসর্গ, দেশে নারীসঙ্গ সহজলভ্য না হলে কিংবা বেশ্যালয় না থাকলে জৈব প্রয়োজনেই মানুষ কি ব্যভিচারের পথ করে নেয় না? হোটেলে ক্যাবারে বারবনিতা যোগাড় হয় না?
তালাক দেয়া নারী বা বিধবা বিয়েতে যে-মুসলমানের কোনোকালেই অরুচি ছিল না, সে-মুসলমান অনিচ্ছায় ধর্ষিতা নারীকে স্ত্রীরূপে-বধূরূপে গ্রহণ করতে এগিয়ে এল না কেন? কাজ দিয়ে অশন বসনের সমস্যা মিটিয়ে দিলেই কি নারীর সামাজিক মর্যাদা রক্ষিত হয় কিংবা যৌবনজাত জীবন সমস্যা মেটে? গৃহগত জীবনে জায়া-জননীর অধিকার বঞ্চিতা নারীর ভাত-কাপড়ে কী সুখ?
তিথি স্নান, রথযাত্রা, উরশ প্রভৃতি নানা উপলক্ষে যেমন আমাদের দেশে এক থেকে এক সপ্তাহব্যাপী পার্বণিক মেলা বসে, তেমনি ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষেও জানুয়ারি থেকেই উৎসবের উদ্যোগ-আয়োজন চলতে থাকে। নিয়মিত পত্রপত্রিকা ছাড়াও অসংখ্যা পার্বণিক পত্রিকা বের হয়। তাতে ভাষা আন্দোলন ও শহীদ-সংপৃক্ত গল্প-কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ যা ছাপা হয়েছে, তা দিয়েই একটা ছোটখাটো গ্রন্থাগার ভর্তি করা যাবে।
তাছাড়া ওয়াজি মৌলবীর মতো এসময় একদল বক্তা সর্বত্র অগ্নিগর্ভ জ্বালাময়ী ভাষায় ও বজ্রকণ্ঠে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। এসব লিখিয়ে বলিয়েরা সারাবছর বাংলাভাষার উন্নতির জন্যে কিংবা গণহিতে কী কাজ করেন, সে-বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। তাঁরা নিজেরা কোনো দায়িত্বগ্রহণ কিংবা কর্তব্যপালন করেন না, কেবল উপদেশ খয়রাত করেন। এ করেই তাঁরা লোকপ্রিয় ও প্রখ্যাত।
আবার সাত কোটি অশিক্ষিত মানুষ যেখানে লিখিত ভাষার সঙ্গে সম্পর্কহীন, বাঙালীমাত্রেই যেখানে ঘরে-বাইরে বাংলা বুলিতে কথা বলছে, সেখানে নানা কারণে কয়েক হাজার বাঙালী অফিসের ফাইলে ও নিজেদের মধ্যে সরকারি বিষয়ে চিঠিপত্রে ইংরেজি লিখলে বাঙালীর সামাজিক, আর্থিক, কৃষি-শৈল্পিক, বাণিজ্যিক, নৈতিক ও বৈষয়িক জীবনে কি বৈনাশিক ক্ষতি হয়, আর বাংলা সর্বকাজে ব্যবহৃত হলেই বা সামাজিক, আর্থিক ও বৈষয়িক জীবনে কোন সমস্যা মিটবে, কী পরমার্থ লাভ হবে, তা কেউ খুলে বলে না।
এসব লিখিয়ে বলিয়ে বুদ্ধিজীবীরা গণ ও বয়স্কশিক্ষার কথা, নতুন কলকারখানা স্থাপনের কথা, কোনো সমবায় প্রতিষ্ঠানের কথা, কোনো যৌথ খামারের প্রস্তাব, এমনকি ভাগচাষীর তেভাগার কথাও উত্থাপন করেননি। ‘নাঙ্গল যার জমি তার ধ্বনি শুনলে তো তাঁরা ক্ষেপে যান। দেশ বলতে, জাতি বলতে, মানুষ বলতে কেবল মধ্যবিত্তকেই বোঝায়। ভাব-চিন্তা-কর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্য,রাজনীতি বিদেশনীতি সবটাই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বার্থেই নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত।
মধ্যবিত্তের জাগ্রত আত্মসম্মানবোধ অনাহত রাখবার জন্যই স্বাধীনতা কাম্য হয়। তাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য-সাচ্ছল্যের জন্যেই বিদেশী শোষণ-মুক্তি জরুরি হয়ে ওঠে। সমাজে তাদের প্রতিপত্তি লাভের জন্যেই মাথাগুনতি ভোটের প্রয়োজনে গণতন্ত্র তাদের বাঞ্ছিত হয়। জনগণের প্রয়োজনের নামে তারা মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার প্রসার দাবি করে, কিন্তু গাঁয়ে যেতে চায় না, আত্মসুখ সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমায়।
শহরের হাসপাতালে ভদ্রলোকদের সুবিধার জন্যে কেবিন বৃদ্ধির দাবি জানায়, বড় ডাক্তারের উপস্থিতি চায়, কিন্তু গাঁয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসার কামনা করে, কিন্তু লোকশিক্ষার ব্যবস্থা বা বিস্তার দাবি করে না। মধ্যবিত্তদের কর্মসংস্থান ও বেতনবৃদ্ধির কথা বলে, গণমানবের কর্মসংস্থান কিংবা খোরপোশের কথা চিন্তা করে না।
ভদ্রলোকের ছেলেরা নকল করে বয়ে যাচ্ছে –সে দুশ্চিন্তায় সবাই জর্জরিত; গণমানবের শিক্ষার যে কোনো ব্যবস্থাই নেই, সে-কথা কেউ ভাবে না, শিক্ষিতদের বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য সমাজ-সরকারের মাথাব্যথার অন্ত নেই। অশিক্ষিত বেকারদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার গরজও কেউ বোধ করে না। রেডিও-টিভি-ফোন ফ্যান-ফ্রিজ-গ্যাস-সি-ট্রাক-মোটর-কোচ, আভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন প্রভৃতি কাদের প্রয়োজনে আসে!
জাপানি টেট্রন কার জন্য, বিলাসসামগ্রী কার ভোগের জন্যে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা প্রদর্শনী কার মনোরঞ্জনের তাগিদে, পনেরোখানা খবরের কাগজ কাদের স্বার্থে, সিমেন্ট্র-পেট্রোল আমদানি কাদের প্রয়োজনে, শিল্প-সাহিত্য দর্শন-সংস্কৃতি সম্মেলন ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান কোন শ্রেণীর মানুষের জন্য, এমনকি কলকারখানা ব্যবসা-বাণিজ্য চলে মুখ্যত কাদের স্বার্থে?
গণমানবেরা কোনো কোনোটি থেকে পরোক্ষে উপকৃত হয় বটে, কিন্তু গণমানবের স্বার্থে একান্তই তাদের জন্য সরকারও সহজে কিছু করে না। এভাবে দেখলে বোঝা যাবে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে গণস্বার্থ গৌণ ও পরোক্ষ, আর মধ্যবিত্ত স্বার্থই মুখ্য ও প্রত্যক্ষ।
শহরে ভদ্দরলোকের জন্য এক বিঘার বাড়ি, চওড়া রাস্তা, পার্কের ব্যবস্থা রয়েছে, আর বস্তির এক বিঘা জমিতে গড়ে আড়াইশ মানুষ বাস করে গেরস্থের বাথানের চেয়েও ছোট এবং নিকৃষ্ট ঘরে। চাকুরেদের জন্যে সরকার-নির্মিত বাসগৃহও থাকে, কিন্তু বস্তিবাসীর পক্ষে বিনে-পয়সার প্রাকৃতিক আলোবাতাসের এক কণাও দুর্লভ। মধ্যবিত্তরা কি ওদের অধিকার ও দাবি স্বীকার করে?
অতএব দেশের নামে, জাতির নামে এবং জনগণের নামে সমাজে সরকারে যা-কিছু করা হয়, তা আসলে মধ্যবিত্তের স্বার্থে মধ্যবিত্তরাই করে। জমির খাজনা মাফ হয় মধ্যবিত্তেরই স্বার্থে। তেভাগার সুবিধেও যারা পেল না, সেই ভূমিহীন ভাগচাষীর কিংবা ক্ষেতমজুর কল শ্রমিকের এতে কী লাভ হল?
জমিদারি উঠে গেছে বটে, কিন্তু খাসজমি নামে-বেনামে রাখার ব্যবস্থা হল কাদের স্বার্থে? শহরে বাড়িভাড়া দিয়ে জমিদারের চাইতেও বড় ধনী হয় কারা? স্বস্বার্থেই এরা গণমানবকে উত্তেজনা দিয়ে দাঙ্গা বাধায়, ওদের দিয়ে সভা-মিছিল করিয়ে ওদের বাহুবলে ও ভোটবলে প্রতাপ-প্রতিপত্তি অর্জন করে। আর চিরকাল অজ্ঞ অসহায় মানুষকে প্রতারিত প্রবঞ্চিত করে।
শিক্ষার মাধ্যমে ওদের চোখ ফুটিয়ে না দিলে স্বার্থসচেতন ও লাভ-ক্ষতির হিসেব নিপুণ হয়ে ওরা আপন প্রাপ্য কখনো দাবি করতে জানবেও না, পারবেও না। জাতীয় বাজেটের কয় পয়সা একান্তই ওদের স্বার্থে ব্যয় হয়? মধ্যবিত্ত শহুরেদের হল-হোস্টেল-ক্লাব-স্টেডিয়াম-জিমনেসিয়াম সাঁতার সরঃ সরোবর তৈরি করতে ও টিকিয়ে রাখতে যত খরচ হয়, তার সিকিভাগ অর্থে একটি জিলার বয়স্কশিক্ষা সম্পন্ন হতে পারে।
দেশ গরিব বটে, কিন্তু ক্ষুদ্র-বৃহৎ যে-কোনো কাজ শুরু করার আগে ইমারত চাই, ধনে কাঙাল হলে কী হয়, সরকার কিন্তু মনে মেজাজে সামন্ত। অল্পে ও অনাড়ম্বরে তার সুখ নেই। সে তার সাধ ও সাধ্যের অসঙ্গতিকে মনে ঠাঁই দেয় না। তাই লক্ষ্য ‘মারি তো গণ্ডার, আর লুটি তো ভাণ্ডার। এজন্যে কোনো এক গাঁ, ইউনিয়ন, থানা বা মহকুমা পর্যায়েও কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ করা সম্ভব হলেও গোটা দেশে করা সম্ভব নয় বলে, তাও করে না।
মধ্যবিত্তরা দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থের জিগির সর্বক্ষণ মুখে জিইয়ে রাখে। বটে, কিন্তু কর্ম ও আন্দোলন সবটাই স্বস্বার্থ লক্ষ্যেই করে। তারা এমন বিবেকহীন অমানুষ যে, ঝড়-বন্যা-মারীগ্রস্ত মুমূর্ষু গণমানবের ত্রাণের জন্যেও গাঁটের পয়সা ছাড়তে চায় না।
নাচ-গান-নাটক-সিনেমা-ক্রীড়ার চ্যারিটি শো করে তাদের থেকে পয়সা আদায় করতে হয় কী বর্বর মন ও অমানবিক রুচি তাদের! ক্ষুধিত মুমূর্ষু মানবতা তাদের বিবেক বিচলিত করে না, ত্রাণ তহবিলে স্বেচ্ছায় পয়সা দেয় না প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্যে প্রতীকী প্রণামী রাখে। লক্ষ কোটি মানুষের যন্ত্রণার সময়েও তাদের আনন্দ- আমোদ উপভোগে লজ্জা হয় না।
স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আমাদের ভাব-চিন্তা-কর্ম পুচ্ছগ্রাহিতা-দুষ্ট, আবর্তনক্লিষ্ট ও অনুকৃতিপ্রবণ। নতুন কিছু আগে ভাবার আগে বলার ও আগে করার সাধ-সাধ্য যেন কারো নেই; সবার যেন বন্ধ্যা মন ও ভোঁতা রুচি, সবাই যেন কৃতার্থম্মন্য ও অতীত স্মৃতিরোমন্থন সুখে অভিভূত। জাগরণের, উদ্যমশীলতার, কল্যাণবুদ্ধির, মানবপ্রীতির, গণদরদের, উন্নয়নকামীর ও উঠতি-বাঞ্ছার লক্ষণ এ নিশ্চিতই নয়।
[ একগুচ্ছ প্রশ্ন – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: