গোড়ার গলদ – আহমদ শরীফ : জীবন সম্পর্কে শ্রেয়স্কর মতবাদই ধর্ম। এবং এই মতবাদের তাত্ত্বিক ও আচারিক নির্দেশাবলিই হচ্ছে শাস্ত্র। কাজেই ধার্মিক মাত্রই সজ্জন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তাকে তেমন দেখিনে কেন? ধর্মবোধ যখন একটা মতবাদ, বোধ-বুদ্ধিই তার ভিত্তি হওয়া উচিত এবং আচারও শ্রেয়স্কর সচেতন লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মানুষের ধর্মাচার দেখে শেখা এবং ধর্মবোধও শুনে পাওয়া সংস্কার মাত্র।
![গোড়ার গলদ [ Root Fault ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 2 গোড়ার গলদ - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/আহমদ-শরীফ-236x300.jpg)
কুচিৎ কারো জীবনে ধর্মবোধ সাধনালব্ধ। ফলে অনুকৃত আচার ও শুনে-জানা তত্ত্ব ও জ্ঞান শৈবালের মতো কেবল বোধ-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাই আমাদের পরিচিত ধার্মিক মানুষ মাত্রই এক একজন তোতাপাখি কিংবা কলের পুতুল। এই যান্ত্রিক মানুষ সমাজের সম্পদ নয়, সমাজের জগদ্দল পাথর। সমাজের তার অস্তিত্ব সর্বক্ষণ দৃশ্যমান কিন্তু তার অবদান অদৃশ্য।
সমাজে মানুষে মানুষে ব্যবধান সৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্যরক্ষায়, পুরোনো প্রীতিতে, নতুন ভীতিতে, স্থিতিকামনায়, গতিবিরূপতায় বলতে গেলে তার জুড়ি নেই। এই লক্ষ্যভ্রষ্ট পথিক, তত্ত্ববিচ্যুত মরমী ও রেওয়াজের অনুবর্তী আচারিক সমাজে বোঝা হয়ে, বাধা হয়ে কিন্তু মাকালের রূপ নিয়ে ও সজ্জনের মর্ষদা নিয়ে শোভা পায়। তার বহিঃরূপ আত্মিক স্বরূপের প্রতিরূপ বলে প্রতিভাত হয়।
এই প্রাতিভাসিক রূপটাই অকল্যাণের উৎস। কেননা এটিই সাধারণ্যে ধার্মিকতা বলে পরিচিত। তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনাবিচ্যুত আচার যে পচাদ্রব্যের মতোই অস্বাস্থ্যকর, তা সাধারণের চোখে কখনো ধরা পড়ে না, বিশেষত ধার্মিকে যখন নিষ্ঠার অভাব নেই এবং কাপট্য অনুপস্থিত, তখন তাকে অস্বীকার করবার কিংবা তার প্রতি শ্রদ্ধা হারাবার কারণ থাকে না। তার সব নিষ্ঠা, সাধনা ও সদিচ্ছা যে বোধের অভাবে অর্থহীন ও পণ্ড হয়, তা কখনো চক্ষুগ্রাহ্য করার জো নেই। তাই যুগ যুগ ধরে এই বিভ্রান্তি ও বিড়ম্বনা সগৌরবে চালু থাকতে পেরেছে এবং হয়তো চিরকাল পারবে।
![গোড়ার গলদ [ Root Fault ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 google news](https://glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
যথার্থ ধার্মিক মানুষমাত্রই পাপী-তাপী-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মানুষের বন্ধু ও অভয়শরণ হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা তথাকথিত ধার্মিকদের এ-গুণ দেখিনে ধার্মিকের দুর্বুদ্ধিপ্রসূত উত্তেজনা দুনিয়াতে মানুষের যত বুকের রক্ত ঝরিয়েছে, এমনটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সম্ভব হয়নি। ধার্মিক জিতেন্দ্রিয় হবে, রিপুর প্রভাব সংযত রাখবে— এ-ই মানুষ আশা করে। কিন্তু অভিপ্রেত মানুষ চিরকালই দুর্লভ দুর্লক্ষ্য রয়ে গেছে।
ধর্মনীতির তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করবে তেমন মানুষের সংখ্যা সমাজে বৃদ্ধি পাবে তেমন ভরসা পাওয়ার কারণ বড় ক্ষীণ। বরং ভরসার ইঙ্গিত রয়েছে অন্যত্র। আজকের দিনে নাস্তিক, সংশয়বাদী ও মানববাদীর সহিষ্ণুতাই মনুষ্যসমাজে নিরাপত্তা ও স্বস্তিদান করেছে। এমন মানুষের সংখ্যাধিক্যে মানুষের সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক জীবনে সুদিন আসবে।
![গোড়ার গলদ [ Root Fault ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 গোড়ার গলদ - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/Ahmed-Sharif.jpg)
মগ্নচৈতন্যের এক কর্তব্য-বুদ্ধি মানুষকে শাস্ত্রের অনুগত করে। কিন্তু তা জীবনের তাৎপর্য-সচেতনতাবিরহী বলে যান্ত্রিক আচরণে পরিণতি পায়, ফলে তা অনুদারতা, অসহিষ্ণুতা ও ভেদ-বুদ্ধির জন্ম দেয়; ধর্মবুদ্ধির ও শাস্ত্রানুগত্যের এই গোড়ার গলদ মানুষের জীবনের সব বৃহৎ আদর্শ ও সম্ভাবনাকে বীজে বিনষ্ট করে। ধার্মিকের এই ত্রুটি অজ্ঞাত ও অনিচ্ছাকৃত বলেই তা কখনো সংশোধিত কিংবা বিমোচিত হবার নয়। তাই ধার্মিককে আমরা কখনো তার ইপ্সিত ভূমিকায় ও অভিপ্রেত সত্তায় পার না।
ধার্মিকের মৌল লক্ষ্য—মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। জীবনকে যথাসাধ্য পুষ্পিত ও ফলবন্ত করাই উদ্দেশ্য। মানুষের সমাজে তার স্থিতি মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে। মানুষকে প্রীতিদান ও মানুষের প্রতি অকপট শুভেচ্ছাই তার ধার্মিকতার প্রসাদ। এমনি যথার্থ ধার্মিক সমাজের অভিভাবক এবং নিরাপত্তার ও শান্তি-স্বস্তির প্রহরী আর মনুষ্য-মহিমার প্রতীক। কিন্তু এমন ধার্মিক দুর্লভ। কেননা তারা ধর্মের আচারিক তাৎপর্য ও নির্দেশের ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতে অসমর্থ। তত্ত্ববিরহী আচার এবং আচারবিরহী তত্ত্ব-চেতনা দু-ই বৃথা ও ব্যর্থ, “প্রখ্যাত সাধক সন্ত কবীরের উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য
প্রেমের রঙে মন না রাঙিয়ে কাপড় রাঙাল যোগী
আহার বিহার ত্যাগি তাহার সাজিল নেহাত রোগী।
জীবে না তুষিয়া, শিবে না ভজিয়া পাথর পূজিল গৃহী
প্রেম না দিয়া দিল ধুপ দীপ, দিল ফলমূল ত্রিহী।
বলেছি, জীবন সম্পর্কে শ্রেয়স্কর মতবাদই ধর্মশাস্ত্র। এই মতবাদ নানা মানুষে নানারূপ। এই বিভিন্নতা সত্ত্বেও ধার্মিকে ধার্মিকে দ্বন্দ্ব হওয়ার কথা নয়। কারণ যথার্থ ধার্মিক প্রেমিক ও সহিষ্ণু না হয়ে পারে না। প্রসন্নদৃষ্টিতে বিধাতার সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও আপাত-অসঙ্গতির অন্তর্নিহিত নিগূঢ় তত্ত্ব অনুধাবন ও উপলব্ধির চেষ্টাই হচ্ছে তার সাধনা। বিস্মিত মুগ্ধ আপ্লুত চিত্তে মহিমময় কুশলী বিধাতার প্রতি তার আত্মনিবেদনই তার উপাসনা।
![গোড়ার গলদ [ Root Fault ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 5 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
বিধাতার সৃষ্টিকে ধার্মিক প্রসন্নদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করবে এই প্রত্যাশাই করে মানুষ। সৃষ্টির সবটাই সুন্দর নয়, সুসমঞ্জস্যও নয়; এতে ভাঙা-মরা-শুকনা-পচা বন্ধুর সবকিছুই রয়েছে। এই আপাত-অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য বৈচিত্র্যের মধ্যে সঙ্গতির সামঞ্জস্যের ও কল্যাণের ইঙ্গিত আবিষ্কারই ধার্মিকের ব্রত ও লক্ষ্য। সমাজে তেমন স্রষ্টা ও সৃষ্টি প্রেমিক ধার্মিকই আবশ্যক। সাম্প্রদায়িক কিংবা দলীয় নেতারূপী শাস্ত্রবিদ ধার্মিক কখনো বাঞ্ছনীয় নয়।
ধার্মিকের কাছে মানুষ করুণা ও মৈত্রীর প্রত্যাশী-ঘৃণা বিদ্বেষ কিংবা পীড়নের নয়; অথচ ধার্মিকরা প্রায়ই অভিভাবক ও শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াতে উৎসাহী। বিভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী হলেও যথার্থ ধার্মিকে ধার্মিকে বিরোধ থাকার কথা নয়। কেননা পথ ভিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য অভিন্ন, গন্তব্য এক। সবাই সেই পরমের কাঙাল, —তাঁর দয়ার ও দানের, তাঁর প্রীতির ও প্রসন্নতার প্রত্যাশী।
[ গোড়ার গলদ – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: