নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : জীবনে সমাজে রাষ্ট্রে যা-কিছু সুখের, স্বাচ্ছন্দ্যের ও আনন্দের তা দ্রোহেরই দান। দ্রোহী মানুষই নতুনের, কল্যাণের উদ্গাতা ও প্রবর্তক। আজ জীবন, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেসব অর্জিত সম্পদে আমরা আনন্দিত, যেসব লব্ধ চিন্তা-গৌরবে গর্বিত, যেসব আদর্শ-গর্বে আমরা ধন্য, যেসব প্রাপ্তি সুখে আমরা তুষ্ট, যেসব কৃতি সাফল্যে আমরা হৃষ্ট, তার সবগুলোই দ্রোহীর দান।
![নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 2 নিষিদ্ধ চিন্তা - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/আহমদ-শরীফ-236x300.jpg)
আজ আমরা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তার আশু প্রতিষ্ঠা-স্বপ্নে বিভোর; মানবকল্যাণকর এসব আদর্শের রূপায়ণ প্রয়াসে উদ্যোগী। কিন্তু এর প্রত্যেকটিই এক কালের নিষিদ্ধ চিন্তার ফল। এ চিন্তা উচ্চারণ করতে যেয়ে কত মানববাদী মানুষকে লাঞ্ছিত ও নিহত হতে হয়েছে, তার হিসেব নেই।
সনাতনী প্রতিবেশে যারা সুখে ও স্বচ্ছন্দে থাকে, তারাই নতুন চিন্তার ও নতুন কথার বৈরী। গৃহপতি ও সমাজপতি, শাস্ত্রধর ও দণ্ডধরেরাই নিজেদের নিরাপদ নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন জীবনের ও জীবিকার বিঘ্ন স্রষ্টারূপে লাঞ্ছিত ও নিহত করেছে নতুন চিন্তার জনককে। নয়া চিন্তার ধারক, বাহক ও কথকরাও নিষ্কৃতি পায়নি। তবু চিন্তাবিদকে হত্যা করে কিংবা ধারক-বাহককে খতম করে চিন্তার বীজ নির্মূল করা যায়নি। সে বীজ দূর্বার মতো দুর্বার হয়েই বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।
![নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 google news](https://glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
সে বীজ রক্তবীজ হয়ে তৈরি করেছে অসংখ্য মন। বায়ুর মতো প্রবিষ্ট হয়েছে অগণ্য বুকে, সাড়া জাগিয়েছে মুমূর্ষু প্রাণে। তবু উচ্চারিত চিন্তার যে মৃত্যু নেই, বরং তার প্রসার ও বিবর্তন আছে, এ সত্য আজো স্বার্থসচেতন লোভী মানুষ গায়ের জোরেই অস্বীকার করে। এবং ঐ ঔদ্ধত্যের পরিণাম-যে কখনো শুভ হয়নি, এ উপলব্ধিও লিপ্সাবশে ভুলে থাকতে চায়। তাই আজো জীবনে, সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে কোথাও স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশেরও ও প্রচারের অবাধে অধিকার স্বীকৃতি পায় না।
![নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 নিষিদ্ধ চিন্তা - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/Ahmed-Sharif.jpg)
আগের যুগের যেসব নিষিদ্ধ চিন্তা ও নীতি আজকের মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ঘুচিয়েছে, সেগুলোর গুরুত্ব-চেতনা ও কল্যাণকরতা আজকের মানুষকে তাদের পূর্বপুরুষ—সেদিনকার গোঁড়া মানুষদেরকে অবজ্ঞা ও উপহাস করতে শেখায়। অথচ তারাই আবার ভবিষ্যতের মানুষের কল্যাণার্থে নতুন চিন্তার উদ্ভব ও লালন সহ্য করে না।
অতীতের যে-মানুষের নির্বুদ্ধিতার ও রক্ষণশীলতায় তারা বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ, তারা নিজেরা অতীতের নিষিদ্ধ চিন্তার প্রসাদভোগী হয়েও অবিকল সেই মানুষের মতোই আচরণ করে। ফলে আজো নতুন চিন্তার জন্ম, লালন, পোষণ, প্রকাশ ও প্রচারের জন্যে বহুকাল ধরে বহু মানবের ত্যাগ, নির্যাতন, নিধন বরণ আবশ্যিক হয়েই রয়েছে।
কারণ দুনিয়ায় লিপ্স্, ভোগী মানুষের সংখ্যাই সর্বাধিক। সুযোগ-সুবিধাকামী ও লাভ-লোভী মানুষ বিবেক-বুদ্ধির আনুগত্য করে না, তারা আপাতলভ্য বা লব্ধ সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও সম্পদ-সাচ্ছল্যের অনুগত হয়। তাই তারা সনাতনী ও স্থিতিকামী। পরিবর্তনকে তারা বিপর্যয় বলে মানে, তাই তারা নতুন-ভীরু ও প্রাচীন-প্রিয়। তারা আবর্তনকে নিয়ম ও নিয়তি বলে জানে, তাই বিবর্তনকে ভয় করে।
তাই তারা যা আছে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে; যা নেই তা পাবার প্রয়াস করে না, পেয়ে দুঃখ ঘুচাবার বাসনা রাখে না। এরও কারণ মানুষও আর দশটি প্রাণীর মতো স্বভাবেই বেড়ে ওঠে। মন-মানসের অনুশীলনে ও পরিচর্যায় প্রাণিশ্রেষ্ঠ যুক্তিবাদী বিবেকচালিত মানুষ হয়ে উঠবার জন্যে সচেতন প্রয়াস করে না। কাজেই রিপুতাড়িত মানুষে সর্বজনীন শ্রেয়স্কর কিছু প্রত্যাশা করাই বিড়ম্বনাকে বরণ করার নামান্তর মাত্র।
![নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 5 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
রাষ্ট্রিক স্বাধীনতাকে মানুষ তাই অকারণে অমূল্য সম্পদ বলে মানে। নিরবধি কাল পরিসরে কখনো কখনো কোথাও কোথাও বিদেশী-বিজাতি-বিধর্মী-বিভাষীর শাসন কায়েম থাকলেও স্বদেশী স্বজাতি স্বধর্মী স্ব-ভাষী, স্বদলের ও স্বমতের লোকশাসিত রাজ্য-রাষ্ট্র বিশ্বে কখনো বিরল ছিল না।
ই বলে মানুষ যে স্বাধীন স্ব-রাষ্ট্রে সুখে স্বচ্ছন্দে, নির্দ্বন্দ্বে নির্ভয়ে বাস করতে পেরেছে, তেমন কথা ইতিহাস বলে না। কারণ স্বাধীনতা স্বয়ং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নয় সুখ, শান্তি, আনন্দ, আরাম অর্জনের উপায় মাত্র। স্বাধীনতার পুঁজি প্রয়োগে ঐসব কাম্য সম্পদ অর্জন করতে হয়। দায়িত্বজ্ঞান, কর্তব্যবুদ্ধি ও অধিকার-চেতনার উদ্ভব ঘটিয়ে সেই বোধগত জীবনের বিকাশ-প্রসার কামনায় উদ্যোগী মানুষই কেবল দায়িত্ব পালনে, কর্তব্য সম্পাদনে এবং অধিকার অর্জনে ও রক্ষণে সমর্থ।
ঐসব গুণের উন্মেষ ও বিকাশ সাধনের জন্যে ব্যক্তিজীবনেও আত্মদ্রোহমূলক সংগ্রাম প্রয়োজন। সে সংগ্রামে জয়ী হয়ে আত্মবিধ্বংসী রিপুকে বশ করতে হয়। তা হলেই স্বাধীনতার প্রসাদ, লাবণ্য ও শ্রী নিজের আয়ত্তে আসে।
অবশ্য ব্যক্তিমানুষের অধীনতার সীমা-সংখ্যা মাত্রা নেই। ব্যক্তিমানুষ স্বভাবতই হাজারো বাঁধনে বদ্ধ। সে মনের অধীন, মেজাজের বশ। সে বিশ্বাসের পুতুল, সংস্কারের পিঞ্জর। সে লোভের বশ, ক্ষোভের শিকার। সে ঈর্ষার দাস, হিংসার পোষ্য ও ঘৃণার অনুগত। সে কামে আসক্ত, মোহে মুগ্ধ। সে মদে মত্ত, মাৎসর্যে অন্ধ। সে লিপ্সাতাড়িত ও লাভ-চালিত।
সে ভয়ে ভীত, ত্রাসে ত্রস্ত এবং শঙ্কায় শঙ্কিত। সে লজ্জা-ভীরু ও ক্ষতি-কাতর। সে শাস্ত্রোক্ত পাপ-ভীরু, সে সামাজিক জীবনে নিন্দা-ভীরু; সে রাষ্ট্র নির্দিষ্ট শাস্তি-ভীরু। সে রীতির বন্দি, নীতির অনুগত ও শরমে সংকুচিত । বন্দিত্ব, দাসত্ব ও দুর্বলতা রয়েছে তার দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে, রক্তে মাংসে জড়িয়ে। তাই সে স্বাধীন হতে পারেনা। কেননা কোনো বন্ধন—তা-নৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক কিংবা বিশ্বাস-সংস্কার-শরম-সংকোচের’ হোক, অথবা রুচি-আদর্শের হোক, তার থাকেই।
![নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 6 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-5-242x300.jpg)
এমন মানুষ কখনো গতানুগতিকতা পরিহার করে নতুন ভাব-চিন্তা-কর্মের অনুগামী হতে পারে না। সযত্ন অনুশীলনে-পরিশীলনে-পরিচর্যায় ঐসব বৃত্তি প্রবৃত্তি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। যারা অবহেলাপরায়ণ, যারা আত্মদর্শনে অক্ষম, আত্ম-জিজ্ঞাসায় অসমর্থ; তাদের নাগরিক স্বাধীনতা আত্মকল্যাণে প্রয়োগ মাত্রই তা সামাজিক-রাষ্ট্রিক অকল্যাণের নিমিত্ত হয়ে ওঠে।
সদাচারী মানববাদীর চিন্তা ও কর্ম সবসময়েই সামষ্টিক কল্যাণমুখী, তাই তারা মানবহিত-কল্পে নতুন করে ভাব, চিন্তা ও কর্ম উদ্ভাবনে নিষ্ঠ। মানুষের বৈষয়িক ও মানসিক উন্নয়ন উৎকর্ষ ওঁদেরই দান। জগতে চিরকাল ওঁদের সংখ্যা নগণ্য। জনবল ও গণসমর্থনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বার্থবাজ দুরাত্মারা তাঁদেরকে লাঞ্ছিত ও নিহত করে তাঁদের বাণী স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস পায়। চিন্তাবিদ মরে, কিন্তু উচ্চারিত বাণী মরে না।
কৃতকর্মও তার প্রভাব রেখে যায়। তাই তার ক্রিয়া মনুষ্যমনে ও সমাজে অদৃশ্যে মন্থরভাবে গভীর ও ব্যাপক হতে থাকে। একদিন সে-চিন্তা অধিকাংশকে আচ্ছন্ন করে এবং এমনি করেই নিষিদ্ধ চিন্তা স্বীকৃত তত্ত্ব, প্রমাণিত তথ্য ও গৃহীত সিদ্ধান্তরূপে সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে স্থিতি পায়। নির্বোধ গোঁড়া মানুষের ঔদ্ধত্যের জন্যেই মানব-মনীষা যুগে যুগে অপচিত হয়েছে ও হচ্ছে।
![নিষিদ্ধ চিন্তা [ Forbidden Thoughts ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 7 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-2-248x300.jpg)
তাই মনুষ্য-আরোপিত মানব- দুর্ভোগ আজো অবসিত হয়নি। মনুষ্য সভ্যতা-সংস্কৃতি ও মানব-মনীষা অগ্রসর হয়নি আনুপাতিক হারে। অতএব, রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার প্রসাদ পেতে হলে আগে বুনো মন-মেজাজকে পরিশীলিত বিবেকের অনুগত করতে হবে। তাহলেই দেশের মানুষ স্বাধীনতাপ্রসূত সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবে এবং তা উপভোগের যথার্থ যোগ্য হবে। নইলে স্বাধীনতা তাৎপর্যহীন বুলি হয়েই থাকে। অন্ধ যেমন দিবারাত্রি বোধবিরহী, তেমনি বিবেকের প্রভাব মুক্ত মানুষও হিতাহিত বোধবিহীন।
স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিককে অবশ্যই মুক্তিকামী হতে হবে। সে মুক্তি চাইবে অশিক্ষা থেকে, সংস্কার থেকে, অন্ধতা থেকে, অজ্ঞতা থেকে, অকল্যাণ থেকে, লিপ্সা থেকে, স্বার্থপরতা থেকে, অনুদারতা থেকে, অতীত-প্রীতি থেকে, স্থিতির মোহ থেকে। তাহলেই কেবল সরকার ও সাধারণ মানুষ কল্যাণকর নতুন ভাব-চিন্তা-কর্ম সহা করার, গ্রহণ করার যোগ্য হবে।
এবং তেমনি অবস্থাতেই কেবল ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য, সামাজিক জীবনে সাম্য ও স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবনে সংস্কার মুক্তি ও গ্রহণশীলতা, আর্থিক জীবনে সমসুযোগ ও সুবিচার, রাষ্ট্রিক জীবনে দায়িত্ব-চেতনা ও অধিকার বোধ, নাগরিক জীবনে পরমতসহিষ্ণুতা ও সৌজন্য প্রভৃতি কাম্যবস্তু অর্জন সম্ভব হবে।
এর জন্যেও নাগরিকের নতুন ভাব-চিন্তা-কর্মের অধিকার স্বীকৃত হওয়া আবশ্যিক। চিন্তা করবার, চিন্তা প্রকাশ করবার এবং প্রচার করবার অবাধ অধিকার যেখানে নেই, সেখানে রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা থাকা না থাকা সমান। কেননা বন্ধকূপের জিয়ল মাছ হয়ে বাঁচা মনুষ্যস্বভাব নয়। তার চোখ সুমুখে, তার পায়ের পাতা সামনে, তাই তার গতিও সামনের দিকে, তার জীবনও তাই চলমান।
কৃত্রিম উপায়ে গতি থামিয়ে দিলে তার জীবনও লক্ষ্যচ্যুত এবং তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। জীবনে চলমানতা আসে নতুন চিন্তার প্রভাবে ও নিয়ন্ত্রণে, নতুন অনুভবের প্রেরণায় এবং নতুন কর্মের উদ্যমে সেই প্রেরণার উৎসমুখ বন্ধ করে দিলে বন্ধ্যাজীবন বিকৃত-বিশুষ্ক হয়ে বিড়ম্বিত হয়। সমকালীন ও ভাবী মানুষের এতবড় ক্ষতি আর কিছুতেই হয়না।
[ নিষিদ্ধ চিন্তা – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: