পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : মানুষের প্রবৃত্তির গভীরে নিহিত রয়েছে জিগীষা। সেই ভিনি-ভিডি-ভিচির প্রেরণা। আমি জানি, আমি পারি এবং আমি করি—এই গৌরব-গর্ব অর্জনে মানুষ সদা উন্মুখ। আবার জিগীষায় পরমাণুর মতো নিহিত রয়েছে অনন্যতার প্রশংসা প্রাপ্তির লিপ্সা। ঘরে বাইরে পরিবারে সমাজে সর্বত্র নানা ক্ষুদ্র, বৃহৎ, উচ্চ তুচ্ছ কর্মে ও আচরণে মানুষ এই কৃতি গৌরব প্রশংসা-সম্পদ ও কৃতজ্ঞতা-সুখ-সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 2 পৈশাচিক জিগীষা - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/আহমদ-শরীফ-236x300.jpg)
এই সুখ-সম্পদ-গৌরব বিচিত্রভাবে অর্জিত হয়—কখনো প্রীতি দিয়ে, কখনো প্রীতি পেয়ে, এমনিভাবে সোহাগ করে, সোহাগ পেয়ে কেড়ে নিয়ে, সেধে দিয়ে, আত্মসাৎ করে, আত্মত্যাগ করে, সেবা দিয়ে, সেবা পেয়ে, মার খেয়ে, মার দিয়ে, উপকার করে, অপকার করে, মরে, মেরে, হেরে, জিতে, উদ্দেশ্যভেদে ও স্থান-কাল ব্যক্তির পার্থক্যে, বিভিন্ন সম্পর্কে ও অবস্থায় এবং ভিন্ন ভিন্ন রিপুর প্রবলতায়। সুখ-সম্পদ-গৌরব সম্বন্ধে ধারণাও বহু এবং বিচিত্র।
কাজেই জিগীষাও বহু ও বিচিত্ররূপে মানবমনকে প্রভাবিত করে। বাহ্যত জরু-জমি জওহর তজ্জাত ধন-মন-যশ প্রাপ্তির তথা আত্মপ্রতিষ্ঠার বাঞ্ছাই জিগীষা। কিন্তু এতো যথার্থই বাহা। এই সরল পথে যে স্থুল জয় সম্ভব, মানুষের অন্তরের চাহিদা তার চেয়ে অনেক সূক্ষ্ম, জটিল ও অধিক। হারিয়ে পাওয়া ও বিলিয়ে পাওয়ার তত্ত্ব আরো গভীরে নিহিত এ তত্ত্ব স্বরূপে উপলব্ধি না করেও মানুষ এ পাওয়ার তাড়নায়ও প্রিয় পরিচিতের কাজ করে চলেছে।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 google news](https://glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
কারো মুখে একটু হাসি ফুটাবার জন্য, কারো মনে একটু স্বস্তি দেবার জন্য, একটি হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা পাবার জন্য, মানুষ অন্যত্র ছলচাতুরী-কৌশল প্রয়োগে কিংবা জোর-জুলুম করে প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহে কিংবা কর্মসম্পাদনে অনুপ্রাণিত।
বাস্তবজীবনে এই জিগীষা চরিতার্থ করবার পথে বিধিনিষেধের বাধা আছে। শক্তি সামর্থ্যেরও সীমা আছে, তাই মানুষ ক্রীড়ার মাধ্যমে এই জিগীষাবৃত্তির চরিতার্থতা খোঁজে। প্রতিপক্ষ পরমাত্মীয় হলেও মানুষ নিজের জয়ই কামনা করে, আবার এমনকি, চিত্তের গভীরে প্রিয়জনের অমঙ্গল কামনাও জাগে- তার ক্ষতির জন্যে নয়, কেবল প্রিয়জনের দুর্যোগ-দুর্ভোগের দিনে তার সেবা করে, তাকে সাহায্য করে, তার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করে কৃতজ্ঞতার ও কৃতার্থমন্যতার সুখ অনুভবের জন্যে।
এই জিগীষার মধ্যে কোনো মহৎ আদর্শ-উদ্দেশ্য নেই; আছে প্রবল আত্মরতি। এর প্রভাবে মানুষ অভিভূত, ফলে তার শ্রেয়বোধও হয় বিপর্যস্ত, অবলুপ্ত। তাই দুনিয়ার সর্বত্র মানুষ এই জিগীষা বা দিশাহারা জয়ের মালা চেয়ে চেয়ে প্রায়ই হার মানছে। এতে তার মনের ভুবনে ক্ষয়-ক্ষতি যা-ই হোক ব্যবহারিক জগতে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে, সামাজিক রীতিনীতির লঙ্ঘনে বহু মানুষের জীবনে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করে। শ্রেয়-চেতনা ও সার্থকতাবোধের এই বিকৃতি ও বিপর্যয়ে মানুষের ইতিহাস দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও দুঃখ-যন্ত্রণার ইতিকথার অন্য নাম।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 পৈশাচিক জিগীষা - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/Ahmed-Sharif.jpg)
আত্মকল্যাণই এই পরপীড়নের কারণ। অথচ ব্যক্তিক জীবনে প্রায় সবাই আস্তিক এবং তারা ধর্মশাস্ত্র মানে । শাস্ত্র হচ্ছে সার্বভৌম আসমানী শক্তির আনুগত্যের অঙ্গীকারে মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার-বিধি বা জীবন-যাত্রানীতি। স্ব স্ব দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের সীমায় আঘাত না দিয়ে এবং আঘাত না-পেয়ে স্ববৃত্তে অটল থেকে নির্বিঘ্ন জীবনযাপনই লক্ষ্য।
অর্থাৎ ব্যক্তির প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে—সে মানুষ। তার মানবিক দায়িত্ব গ্রহণের ও কর্তব্যকরণের প্রতিজ্ঞা পূরণার্থে স্বাধিকার সীমায় মানবিক গুণের ও রোধের বিকাশসাধন তথা মনুষ্যত্বে উত্তরণই সবার লক্ষ্য। অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে উত্তরণের জন্যে কারো শাস্ত্রীয় নীতি ইসলাম, কারো মুসাপ্রদর্শিত পদ্ধতি, কারো গৌতম-নির্দেশিত উপায়, কারো যিশু-প্রবর্তিত পন্থা কারো বা ব্রাহ্মণ্য-বিধি।
অতএব মানুষের নাম, নিবাস ও বৃত্তির মতো এক্ষেত্রেও তাঁর পরিচয়ের অভিজ্ঞান— সে মানুষ, আর লক্ষ্য মনুষ্যত্ব এবং সে লক্ষ্য অর্জনে তার সম্বল হচ্ছে তার মনোনীত নীতি পদ্ধতি। প্রাণীর মধ্যে সে মানুষ, গন্তব্য তার মনুষ্যত্ব এবং তার বাহন তার মনোনীত শাস্ত্রীয় নীতি-পদ্ধতি। অথচ উদ্দেশ্য তার কবে হারিয়ে গেছে, সে উপায়কেই উদ্দেশ্য বলে জানে এবং লক্ষ্য বলে মেনে নিশ্চিন্ত।
তাই স্ব স্ব উপায়ের শ্রেষ্ঠত্ব, গৌরব ও গর্ব জাহির করার প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালু রাখাই তার জীবনের মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই ধর্মদ্বেষণা ও বিধর্মী-বিদ্বেষের অবসান আজো দুর্লক্ষ্য। এর সঙ্গে জাত-বর্ণ-দ্বেষণাও যুক্ত।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 5 কাজী নজরুল ইসলাম এর সাথে আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/কাজী-নজরুল-ইসলাম-এর-সাথে-আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-300x288.jpg)
এবং সমাজের সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী মানুষেরা এই বিদ্বেষকে আর্থিক, বৈষয়িক ও রাষ্ট্রিক জীবনে পুঁজি হিসেবে কাজে লাগায়, আর রেষারেষি, কাড়াকাড়ি, মারামারিও হানাহানি চিরকাল জিইয়ে রাখে। ফলে সংখ্যালঘু দুর্বল পক্ষ চিরকাল বঞ্চনা ও পীড়নের শিকার হয়ে দুর্বহ অভিশপ্ত জীবন অতিবাহনে বাধ্য হয়। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বোধে-বুদ্ধিতে মানুষ এত এগিয়েছে, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ও উপভোগের এত সামগ্রী সৃষ্টি হয়েছে, সুখ শান্তির জন্যে এত আয়োজন রয়েছে, কিন্তু তবু দুনিয়ায় দুর্বল মানুষের দুঃখ ঘুচল না।
দৈশিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক জীবনেই জাত-জন্ম বর্ণ-ধর্ম-দ্বেষণা সীমিত নেই। আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রিক জীবনেও তা তার নখদন্ত নিয়ে অনুপ্রবিষ্ট। এখানেও সেই আত্মরতি ও জিগীষা ঐ দ্বেষণা ও পীড়নের রূপ নিয়ে প্রকটিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে যদিও রাষ্ট্রনায়করা মুখে শ্বেতকপোত, কিন্তু স্বভাবে বাজ ও আচরণে বাঘ। তাই তাদের শাঠ্য-কাপট্য জোর-জুলুম কোনো আবরণে ঢাকা থাকে না।
এখানেও যার ধনবল ও অস্ত্রবল আছে তার অন্যায়, তার দুর্নীতি, তার জুলুমের সমর্থনে এগিয়ে আসে। কৃপাজীবী-সুবিধাবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূমিকা সেই মোসাহেব চাটুকারের। জাতিসঙ্ঘ সংস্থার সভায় সেই সামন্তযুগের দরবারি আবহই বর্তমান। সেখানেও প্রবল শক্তিগুলোর প্রতিবেশী-সুলভ দ্বেষ-দ্বন্দের খেলা ঈর্ষা-অসুয়ার সর্পিল প্রকাশ, সেই জিগীষার ক্রুর কুটিল অভিব্যক্তি।
দলাদলিতে কড়ুয়নের মতো যেন একটি আপাতসুখ আছে, তাই মানুষ অনেক সময় ঈর্ষা-অসূয়া ও জেদের বশে দলাদলিতে মাতে। এটি রাষ্ট্রিক সম্পর্কেও সর্বত্র প্রকট। জাতিসঙ্ঘ সংস্থা গঠনে আদর্শিক সদুদ্দেশ্য থাকলেও আন্তরিক সদিচ্ছা সঙ্ঘ-প্রতিষ্ঠাতা বৃহৎ শক্তিবর্গের যে ছিল না, তা গোড়াতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাদের ভেটো প্রয়োগের অধিকার দাবিতে। সেই থেকে বিবদমান দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে তারা যেরূপ বেদেরেক ব্যবহার করছে, তাতে অভিবড় আশাবাদীরও নিরাশ হতে হয়।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 6 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature এবং আহমদ সফা](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-6-300x208.jpg)
পরিণামে তাদের এই নিষ্ঠুর খেলার শিকার হয় কোটি কোটি নিরীহ মানুষ যারা আত্মীয়-পরিজন নিয়ে রোগশোক দুঃখদৈন্যের মধ্যেও স্নেহ-মমতার নীড়ে জীবনে তিক্রমধুর স্বাদ পাবার প্রত্যাশী। শক্তির দম্ভে মত্ত এইসব বৃহৎ রাষ্ট্রনায়করা বিনাদ্বিধায় ঘর ভাঙে, দেশ ভাঙে, সুখের নীড়ে বিভীষিকা জাগায়। হত্যা-পীড়ন-অনটন তাদের খেলার হাতিয়ার। দু হাজার বছর ধরে দেশত্যাগী আওয়ারা ইহুদি এনে বসায় ফেলিস্তিনে হাঘরে ইহুদিদের প্রতি মানবিক মমতার উছিলায়।
আদর্শের প্রতি আনুগত্যবশে যেমন তারা জার্মানি, কোরিয়া, ইন্দোচীন, আয়ারল্যান্ড, মেসোপটেমিয়া দ্বিখণ্ডিত করে, তেমনি ঐ নীতি-আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবশেই ইরাক-কঙ্গো-নাইজেরিয়া ভারত-ইথিওপিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের অসন্তুষ্ট মানুষের গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য স্বীকারে ও তাদের স্বাধীনতার দাবি সমর্থনে বৃহৎ শক্তিগুলো অসম্মত। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার রোডেশিয়ার সংখ্যাগুরু অধিবাসী কালো মানুষদের ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে তারা উদাসীন।
মানবতার সেবায়ও অবশ্য তাদের আগ্রহ কম নয়। জর-ঝড়-খরা কম্পন-বিধ্বস্ত কিংবা দুর্ভিক্ষ মহামারী-কবলিত মানুষের সেবায় তারা এগিয়ে আসে। কিন্তু মানুষকে সুকৌশলে ক্রীড়ার আনন্দে দুস্থ বানিয়ে পরে দুস্থ মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়া যেন গরু মেরে জুতো দানের তত্ত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। আন্তরিকভাবে মানববাদী না হয়ে মানবতার প্রতি এই মমতা অভিনয়ের মতো দেখায়, এই প্রত্যয়হীন প্রয়াসে মানুষের স্থায়ী পরিত্রাণের কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইন্দোনেশিয়ায়, পাকিস্তানে সামরিক জান্তা দখলীকৃত সরকার বিদ্রোহ দমনের নামে পোকা-মাছি-পিঁপড়ে মারার মতো দানবীয় দাপটে গণহত্যা চালাল, কয়েক লক্ষ মানুষের রক্তে মাটি হল কাদা, নদী হল লাল, দেশ হল নরকঙ্কালে-করোটিতে আকীর্ণ। নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউ নিষ্কৃতি পেল না। নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার করল, ঘরবাড়ি পোড়াল, কোটি লোক প্রাণ নিয়ে দেশান্তরে পালাল।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 7 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-5-242x300.jpg)
এক কথায় রক্তে আগুনে প্রলয়কাণ্ড ঘটাল, তবু তা বিশ্বরাষ্ট্রগুলোর কাছে অভ্যন্তরীণ শাসন-শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়ম রেওয়াজমাফিক ব্যবস্থা মাত্র। গণহত্যা কখনো কারো ঘরোয়া ব্যাপার হতে পারে! নিজের সন্তানকেও তো হত্যার অধিকার মা-বাপের নেই। দেশের সরকার দেশের নাগরিকের শাসক বলে কি তার জানেরও মালিক। পরের ছেলেকে পথে পেয়ে সোহাগ করা চলে কিন্তু তাকে আঘাত করার অধিকার মেলে না।
মঙ্গল করবার মানবিক আগ্রহ আর নির্যাতন-নিধনের দানবিক দৌরাত্ম্য দু’টোই কিন্তু জাতিসঙ্ঘের সমান সমর্থন পায়। জাতিসঙ্ঘ সংস্থা যেন বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি-কূটনীতি খেলার জন্য। তৈরী ক্লাব। অবশ্য রাজনীতিকদের নিষ্ঠুর খেলা চিরদিন এমনিভাবেই চলে। কিন্তু যখন মানববাদের মহৎ বুলি আওড়াচ্ছে সবাই, তখন মানুষের জানমাল নিয়ে এই দানবীয় দৌরাত্ম্যে মানববাদীর বেদনা বাড়ে।
আমাদের আপত্তিও এজন্যই। বাজের মতলব নিয়ে শ্বেত-কপোতের ছদ্মবেশে বিচরণ করতে থাকলে আশ্বাস-প্রত্যাশী প্রতারিত মানুষের যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে ওঠে। জাতিসঙ্ঘ সংস্থা বাহ্যত গড়া হয়েছে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের শান্তি ও নিরাপত্তার তত্ত্ববধায়ক হিসেবে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, মানব-প্রয়োজন মিটানো ও মানবকল্যাণ সাধনই এর লক্ষ্য। এজন্য মানবাধিকার, সেবা, শিশু, স্বাস্থ্য, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, বিপদত্রাণ, শ্রমিকস্বার্থ রক্ষণ প্রভৃতি বিবিধ উপসঙ্ঘ, সংস্থা ও পরিষদ রয়েছে।
সর্বপ্রকার সদুদ্দেশ্য, সৎকর্ম ও হিতচিন্তার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। বিশ্বরাষ্ট্রগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে সমস্বার্থে সহিষ্ণুতা, সহ-অবস্থান ও সহযোগিতার অঙ্গীকারে জাতিসঙ্ঘ সংস্থা গঠিত হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিযোগিতা চলছে অস্ত্রসংগ্রহের ও নির্মাণের – এ কোন্ মহৎ মতলবে! কার সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হবার জন্যে! জাতিসঙ্ঘের সদস্যরা তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিহারের জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 8 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-4-232x300.jpg)
পয়োমুখ বিষকুত্তের মেসাল বুঝি এক্ষেত্রেই প্রযোজ্য মানুষকে ভালো না বেসে মানববাদী হওয়া যায় না। মানবপ্রেমই মানুষকে মানববাদী করে। আর মানববাদী না হলে কারো পক্ষে কম্যুনিস্ট হওয়া সম্ভব নয়। কেননা দুস্থ মানবের প্রতি দরদই মানুষকে সমাজবাদী ও সাম্যবাদী হতে অনুপ্রাণিত করে। বাঙলাদেশে গণহত্যার ব্যাপারে চীন-যে কেবল উদাসীন ছিল তা নয়, সে জল্লাদ-সরকারকে হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিতও করেছে সক্রিয়ভাবে।
তা হলে কম্যুনিস্ট চীনের মানবদরদ কি ছলনা মাত্র! তাও নয়, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রেরও রাজনীতি-কূটনীতি আছে ; এটি সে-নীতিরই বাস্তবায়ন। ভারত-বিদ্বেষবশেই মুখ্যত পাকিস্তানের জল্লাদ সরকারের সমর্থনে ও সাহায্যে এগিয়ে এসেছে চীন। কিন্তু খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় হিতৈষীর বেশে দেখা দিলেও চীন পাকিস্তানেরও হিতকামী নয়। পাকিস্তানকে দিয়েই পাকিস্তান ভাঙার পথ তৈরি করেছে। কেননা তারা Self-help এ স্বনির্ভরতার নীতিতে আস্থা রাখে, স্বাবলম্বনে ভরসা রাখে।
‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে তত্ত্বে ও অঙ্গীকারে আস্থা রেখে কংসের রাজ্যে ভগবান কৃষ্ণের মতো কিংবা ফেরাউন-ঘরে মুসার লালনের মতো তারা দেশেই সরকার-বৈরী তৈরি করায়। সরকার অনুষ্ঠিত হত্য কাণ্ডের পর বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহী বাঙালী যে আপসহীন সংগ্রামের সংকল্প ও শপথ গ্রহণ করবে এবং তা যেমন গেরিলা পদ্ধতিতে হবে পরিচালিত, তেমনি তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা হবে সমাজবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত এ অনুমান করা অসঙ্গত ছিল না।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 9 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
কাজেই বাঙলাদেশে কম্যুনিজমের দ্রুত প্রসার লক্ষ্যেই চীন পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন ও সাহায্য দিচ্ছিল। তাছাড়া গণহত্যা কিংবা রক্তের বন্যা দেখলে সাম্রাজ্যবাদীদের মতো কম্যুনিস্টরাও বিচলিত হয় না। এ রক্তে হোলিখেলার দীক্ষা নিয়েই তাদের যাত্রা হয় শুরু। নরহত্যার মাধ্যমে নর-সেবার স্থায়ী সুযোগ করে নেয়াই তাদের নীতি। বিরুদ্ধ শক্তিকে হত্যা করে উচ্ছেদ করার নীতিতে তারা আস্থাবান। কাজেই বাঙলাদেশে তাদের নীতি-আদর্শের খেলাফ হয়নি। এখানেও সেই আত্মরতি! জিগীষার এ-ও আর-এক রূপ।
আসলে পুঁজিবাদী ও কম্যুনিস্ট বৃহৎ শক্তিগুলো নবতর সাম্রাজ্যবাদে আসক্ত। দুনিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে তারা তাদের প্রভাবিত ও সংরক্ষিত তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে সচেষ্ট, যাতে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যের মতোই আর্থিক শোষণ চালু রাখা যায়। আদর্শবাদের নামে পর-প্রীতির আবরণে বিশ্বমানব কল্যাণের অজুহাতে আত্মপুষ্টির এ এক আধুনিক উপায়। দুর্বল রাষ্ট্রের মানুষ যে এ কপটতা না বুঝে তা নয়। কিন্তু তার দারিদ্র্য ও বলহীনতা ‘রা’ করার সাহস থেকেও তাকে বঞ্চিত রেখেছে।
পৃথিবীর ঘরে ঘরে মানববাদীর সংখ্যা না বাড়লে এই উপদ্রব থেকে মানুষের নিষ্কৃতি নেই, মুক্তি নেই দুর্বল দরিদ্রের। স্বার্থের ও লিপ্সার জগতে জিঘাংসা জিগীষার প্রায়ই নিত্যসঙ্গী। তাই আজকের জগতে দানবিক জিগীষা ও পৈশাচিক জিঘাংসা সর্বত্রই সহচর। আর এ প্রবৃত্তির শিকার হচ্ছে দুনিয়ার দুস্থ মানবতা। যারা বিশ্বাস করে এবং বলে মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়, তারা কিসের ভরসায় এবং কোন্ আশ্বাসে এ কথা বলে জানিনে।
![পৈশাচিক জিগীষা [ Poichashik Jighangsha ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 10 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-2-248x300.jpg)
মানববাদী-সাম্যবাদী সাম্রাজ্যবাদী নায়কদের অন্তরের পৈশাচিক রূপ এবং আচরণের দানবিক দাপট দেখে মনে হয় না গণমানবের কখনো সত্যিকার জয় হবে, দেহে-মনে সে মুক্তির স্বাদ পাবে। যে-সুন্দর বিশ্বে সুন্দর মনের ও সচ্ছল জীবিকার স্বচ্ছন্দ জীবনের উদ্ভিক্ত কল্পনাও স্বপ্ন নিয়ে দুনিয়ার দুস্থ মানুষ আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে ও ভরসায় বুক বেঁধে দিন গুনছে, তা কী কখনো সত্য ও বাস্তব রূপ নেবে! স্বপ্নভঙ্গের বিড়ম্বনা ও আশাহতের বেদনা এড়ানোর জন্যে অন্তত প্রত্যয় ও প্রত্যাশা রাখা যাক—শতাব্দীর সূর্য আমাদের প্রতারিত করবে না।
[ পৈশাচিক জিগীষা – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: