বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য [ Characteristics & Thinking of Bengali ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : ১৯৭৪ সনের ২২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ দর্শন সম্মেলনে শাখা-সভাপতির ভাষণ।
সমবেত দর্শনবিৎ ও সুধীবৃন্দ,
দর্শন আমার অধীত বিষয় নয়। দর্শনচর্চায় আমি অনধিকারী। কিন্তু ক্রিয়া বিশ্লেষণ করে কারণ আবিষ্কার কিংবা লক্ষণ বিচার করে রোগ নির্ণয় ও নিদান নিরূপণ যেমন সম্ভব, তেমনি বাঙালীর আচার-আচরণে যে নীতি-আদর্শ অভিব্যক্তি পেয়েছে, তার বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করে বাঙালীয়ানার বা বাঙালীত্বের স্বরূপলক্ষণ জানা যাবে, এ বিশ্বাসে আমি বাঙালীর ঐতিহাসিক আচরণের ধারা অনুসরণ করছি। এ বাঙালীর কোন্ জীবন-দৃষ্টির ও জগৎভাবনার ইঙ্গিত বহন করে তার দার্শনিক স্বরূপ নিরূপণের দায়িত্ব দর্শনশাস্ত্রবিদদের।
প্রাণীমাত্রই বাঁচতে চায়, আর বাঁচার প্রয়োজনেই আসে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের বৃদ্ধি ও প্রয়াস। অন্য প্রাণীর কাছে তা সহজাত বৃত্তি প্রবৃত্তিমাত্র, মানুষের তা-ই জীবনসাধনা।
যেখানে অজ্ঞতা সেখানেই ভয়-বিস্ময়-অসহায়তা। তাই জীবনের নিরাপত্তার জন্য জীবনকে ও জীবনপ্রতিবেশকে চেনা-জানার মানবিক প্রয়াসও শুরু হয়েছে মানুষের আদিম অবস্থাতেই। মানবশিশুর মতো মানবিক প্রয়াসও হাত-পা নাড়ার, হামাগুড়ির ও হাঁটতে শেখার স্তর অতিক্রম করে আজকের অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।
যেখানে উদ্যোগী উদ্যমশীল বুদ্ধিমান মানুষ সুলভ ছিল, সেখানকার সমাজের বিকাশ হয়েছে দ্রুত। এভাবে কেউ সৃজন করে আর কেউ অনুকরণ করে এগিয়েছে। যারা সৃজনও করতে পারেনি, গ্রহণও করেনি, সেই আরণ্য-মানব আজো প্রায় আদিম স্তরেই রয়ে গেছে।
মানুষের মন-বুদ্ধি-প্রয়াস নিয়োজিত হয়েছে দুইভাবে ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মিটানোর কাজে এবং মননের উৎকর্ষসাধনে। মূলত সবটাই ছিল জীবন জীবিকা সংপৃক্ত। বিকাশের ধারায় জীবন যখন বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য পেয়ে-পেয়ে জটা জটিল হয়ে উঠল, তখন তনু-মনের চাহিদা বাহ্যত ভিন্ন হয়ে দেখা দিল। একদিকে আজ গ্রহাভিসারী যন্ত্র যেমন দেখছি, অন্যদিকে অস্তিত্ববাদাদি নানা তত্ত্ব-চিন্তারও তেমনি উদ্ভব হয়েছে। অজ্ঞতাপ্রসূত ভয়-বিস্ময়-কল্পনাই ক্রমে মানুষকে কারণ-ক্রিয়া সচেতন করে তোলে।
ভয়-বিস্ময় থেকে যে-জিজ্ঞাসার উৎপত্তি এবং অজ্ঞের কল্পনা দিয়ে তার উত্তরস্বরূপ যে-জ্ঞান লব্ধ, তা কখনো যথার্থ হতে পারে না। তবু কৌতূহলী। মন বুঝ মানে না। তাই চাওয়া ও পাওয়ার, সাধ ও সাধ্যের, প্রয়াস ও প্রাপ্তির অন্তরায়রহস্য মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। সেই ভাবনা সর্বপ্রাণবাদ, জাদুবিশ্বাস, টোটেম-টেবু তত্ত্ব প্রভৃতির জন্ম দিয়েছে। তার বিসূক্ষ্ম ও পরিশীলিত রূপ পাই পুরাতত্ত্বে বা Metaphysics-এ।
অদৃশ্যকে দেখার, অধরাকে ধরার, অচিন্ত্যকে চিন্তাগত করার, অজ্ঞেয়কে জানার এই প্রয়াস নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অসাফল্যে বিড়ম্বিত। তবু ‘নিশি-পাওয়া’ লোকের মতো কিংবা বিবাগীর মতো পথ চলে পথের দিশা খুঁজে অনিঃশেষ পথে বিচরণের আনন্দটাকে বিশ্বাসীজন জীবনের পরম সার্থকতা বলেই মানে।
![বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য [ Characteristics & Thinking of Bengali ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 google news](https://glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে বিশ্বাসের জন্ম। বন্ধ্যা মনেই বিশ্বাসের লালন, যুক্তিহীনতার বিশ্বাসের বিকাশ। কাজেই যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা পুতুলে চলু বসিয়ে দৃষ্টিশক্তি দানের অপপ্রয়াসেরই নামান্তর।
কিন্তু চিরকাল অজ্ঞ-অসহায় মানুষ বিশ্বাসকে আশ্রয় করে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে ভরসা পেতে চেয়েছে, চেয়েছে নিশ্চিন্ত হতে। তাই তার কল্পনালব্ধ জ্ঞান তাকে চিরকালই আশ্বস্ত করেছে।
এই জ্ঞানই তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে প্রজ্ঞা নামে হয়েছে পরিচিত এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞাশ্রয়ী শাস্ত্রই ধর্ম ও ধর্মরোধ রূপে সমাজে পেয়েছে স্থিতি। শাস্ত্র অবশ্য সেদিন গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে বৃহত্তর গণসমাজ গড়ে তুলে মানুষের বিকাশ ত্বরান্বিত করেছিল। তাই তখনকার শাস্ত্রের কালিক উপযোগ অবশ্য স্বীকার্য। এই Metaphysical জ্ঞানতত্ত্ব বিশ্বাসের অঙ্গীকারে দৃঢ়মূল হয়ে আচার-সংস্কারে পরিণতি পায়।
তখন লালিত বিশ্বাস সংস্কারই মানুষের জীবনযাত্রার ভিত্তি ও জীবনযাপনের দিশারী হয়ে ওঠে। তখন বিশ্বাস-সংস্কারের নিয়ন্ত্রণেই মানুষের জীবন যান্ত্রিকভাবে হয় চালিত। তখন তনুর জীবন ও মনের জগৎ হয়ে পড়ে আলাদা এবং মানুষ তখন তনুকে তুচ্ছ জেনে মনকে করে তোলে উচ্চ। তেমন স্তরের মনের প্রেরণায় উচ্চারিত হয়
“বিনা প্রয়োজনের ডাকে
ডাকব তোমার নাম
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই
পুরবে মনস্কাম।”
এই Metaphysical তত্ত্বের প্রসারে পাই Philosophy. Philosophy’র সাধারণ অভিধা হচ্ছে ‘প্রজ্ঞা-প্রীতি’, ‘দর্শন’-এর সাধারণ লক্ষ্য অদৃশ্যকে দেখা। দুটোই মূলত এক চেতনার গভীরে জীবন সংম্পৃক্ত জগৎকে কিংবা জগৎ-প্রতিবেশে জীবনকে তার সামগ্রিক স্বরূপে ও তাৎপর্যে উপলব্ধি বা ধারণ করার চেষ্টা।
![বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য [ Characteristics & Thinking of Bengali ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-5.jpg)
সাধারণভাবে দর্শনশাস্ত্রাশ্রয়ী অর্থাৎ শাস্ত্রের তাত্ত্বিক তাৎপর্য সন্ধানই ছিল দার্শনিকদের লক্ষ্য। এতে যে প্রত্যয়ানুগত্য, প্রতিজ্ঞানুসরণ ও লক্ষ্য-নির্দিষ্টতা ছিল, তাতে সংকীর্ণ-সরণীতে মানস-বিচরণ সম্ভব ছিল বটে কিন্তু নিরপেক্ষ, অনপেক্ষ কিংবা সার্বিক শ্রেয়সের তত্ত্ব থাকত অনায়ত্ত। বলতে গেলে পুরোনোকালে কেবল গ্রিসে ও ভারতেই বিশুদ্ধ তত্ত্বচিন্তা কিছুকাল প্রশ্রয় পেয়েছিল।
কোনো সীমিত চিন্তাই অখণ্ড তত্ত্ব বা সত্যের সন্ধান পায় না। শাস্ত্রীয় দর্শনও তা ই দেশ-কাল-জাত-বর্ণ-গোত্রের ছাপ এড়িয়ে সর্বজনীন হতে পারেনি। আবার বিশুদ্ধ তত্ত্ব-চিন্তাও শাস্ত্রানুগত বিশ্বাসী মানুষকে তার সংস্কার লালিত পুরোনো প্রত্যয়ের দুর্গ থেকে মুক্ত করতে পারে না।
তাই দর্শনচর্চা ব্যক্তিক রুচি, মন ও মনন যতটা উন্নত ও প্রসারিত করে, সমাজমনে তার প্রভাব ততটা পড়ে না। তবু একসময় আচার সংস্কাররূপে তার তাত্ত্বিক প্রভাব গোটা সমাজ-মানসকে চালিত করে। দর্শনের গুরুত্ব ও সার্থকতা তাই অপরিমেয়। বলা চলে মনুষ্য-সংস্কৃতির উৎকর্ষ পরোক্ষে দর্শন ও দার্শনিকেরই দান।
ভূমিকা না বাড়িয়ে এবার বাংলার ও বাঙালীর দর্শনের কথা বলি। বাঙালীরা রক্তসঙ্কর জাতি। বিভিন্ন গোত্রীয় রক্তের আনুপাতিক হার অবশ্য আজো অনির্ণীত। তবু প্রমাণে অনুমানে বলা চলে শতকরা সত্তরভাগ অষ্টিক, বিশভাগ ভোট চীনা, পাঁচভাগ নিগ্রো এবং বাকি পাঁচভাগ অন্যান্য রক্ত রয়েছে বাঙালী-ধমনিতে।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং ভৌগোলিক বিচারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই অন্তর্গত। বাহ্যত প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে শাস্ত্র, শাসন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উত্তরভারত-প্রভাবিত হলেও অন্তরে এর মানস-স্বাতন্ত্র্য এবং স্বভাবের বৈশিষ্ট্য কখনো হারায়নি। মিশ্ররক্তপ্রসূত স্বভাবের সাঙ্কর্যই হয়তো বাঙালীর এই অনন্যতার কারণ। অবশ্য তার সবটা কল্যাণপ্রসূ হয়নি কখনো।
জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র বরণের মাধ্যমে বাঙালীর সঙ্গে উত্তরভারতীয় ভাষা সংস্কৃতি-সভাতার পরিচয় ঘটে। এভাবেই বাঙালীর আর্যায়ন সম্ভব হয়। এতে বর্বর যুগের বাঙালীর ভাষা-পোশাক, বিশ্বাস-সংস্কার, নিয়মনীতি, প্রথা-পদ্ধতির প্রায় সবখানিই বাহ্যত পরিত্যক্ত হয়। তবু থেকে গেছে। বিশ্বাস-সংস্কারের অনেকখানি যার স্থিতি বাঙালীর মর্মমূলে। এই থেকে যাওয়া অবিমোচ্য স্বাতন্ত্র্য ও স্ব-ভাবই তার অনন্যশক্তির উৎস এবং স্বতন্ত্র-স্থিতির ভিত্তি।
বাঙালী বিদেশী ধর্ম গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু কোনো ধর্মই সে অবিকৃত রাখেনি। জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও ইসলামকে সে নিজের পছন্দমতো রূপ দিয়ে আপন করে নিয়েছে। নৈরাত্ম্য নিরীশ্বর বৌদ্ধধর্ম এখানে মন্ত্রযান, কালচক্রযান, বজ্রযান-সহজযানে বিকৃতি ও বিবর্তন পায় । বৌদ্ধ চৈত্য হয়ে ওঠে অসংখ্য দেবতা-অপদেবতার আখড়া। জৈনধর্ম পরিত্যক্ত হয়, ব্রাহ্মণ্যধর্মও স্থানিক দেবতা-উপদেবতা-অপদেবতার প্রবল প্রতাপের চাপে পড়ে যায়।
ইসলাম ও ওয়াহাবি-ফারায়েজি আন্দোলনের আগে পীরপূজায় অবসিত হয়। বিদ্বানেরা এর নাম দিয়েছেন লৌকিক ইসলাম। উল্লেখ্য যে, এসব দেবতা-পীর ঐহিক জীবনেরই ইষ্ট বা অরিদেবতা পারত্রিক পরিত্রাণের নয়। এতেই বোঝা যায় বাঙালী ঐহিক জীবনবাদী অর্থাৎ জীবনজীবিকার নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যকামী ভোগলিপ্স। অবশ্য সব ধর্মই কালে কালে স্থানে স্থানে বিকৃত হয়, কিন্তু বাঙালীর ধর্মের বিকৃতিতে বাঙালী-স্বভাব ও মনন যত প্রকট, এমনটি অন্যত্র বিরল। বাঙালী তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পেরেছে, তার কারণ বাঙালী কখনো তার অনায়।
সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র নামের দর্শনে ও চর্যায় তার আস্থা ও আনুগত্য হারায়নি। ঐ নিরীশ্বর তত্ত্বে ও চর্যায় তার নিষ্ঠা কিছুতেই কখনো বিচলিত হয়নি। তার কারণ বাঙালী মুখে মহৎ বুলি আওড়ায় বটে, কিন্তু আসলে সে এ জীবনকেই সত্য বলে মানে এবং পারত্রিক সুখকে সে মায়া বলেই জানে। তাই সে এই মাটির মায়াসক্ত জীবনবাদী।
সে বস্তুতান্ত্রিক, ভোগলিপ্সু, তাই সে সশরীরে অমরত্বকামী। এজন্যেই সাংখ্যের প্রাণ রসায়নতত্ত্ব, আয়ুবর্ধক যোগ ও শক্তিদায়ক তন্ত্র তার প্রিয় হয়েছে। চিরকালই তার সর্বপ্রকার জিজ্ঞাসা ও প্রয়াস জীবনভিত্তিক ও জীবনকেন্দ্রী। তার সাধনা বাঁচার জন্যেই। তাই সে দেহাত্মবাদী। সে জানে দেহাধারস্থিত চৈতন্যই জীবন। দেহ ও আত্মার আধার আধেয় সম্পর্ক, একের অভাবে অপরের অস্তিত্ব অসম্ভব। তার কাছে ভবসমুদ্রে দেহ হচ্ছে মন-পবনের নাও।
মন-পবনের সংস্থিতি ও সহস্থিতিই রাখে দেহ-নৌকা ভাসমান ও সচল। তবে যৌগিক চর্যার মাধ্যমে দেহকলে বায়ু সঞ্চালন আয়ত্তে রাখতে হয়। আর ভূতসিদ্ধির জন্যে তান্ত্রিক সাধনা স্ব-স্ব আঙুলের মাপের চৌরাশি অঙুলি পরিমিত দেহ নৌকাকে কাণ্ডারীর মতো স্বেচ্ছা-পরিচালনার শক্তি যে অর্জন করে সে-ই হচ্ছে চৌরাশি সিদ্ধা। এ সাধনা ভোগলিপ্সর দীর্ঘ জীবনোপভোগের সাধনা।
আত্মরতিই তার মূল জীবন-প্রেরণা। তাই স্ব-স্বার্থেই সে নিঃসঙ্গ সাধনা করে। আত্মকল্যাণেই সে সদ্গুরুর দীক্ষা কামনা করে বটে, কিন্তু তার আত্মিক কিংবা অধ্যাত্মসাধনায় সমাজ-চেতনা নেই। এই জীবনতত্ত্ব তার বৈষয়িক জীবনকেও গভীরভাবে করেছে প্রভাবিত। বজ্রযানী ও সহজযানীরা ছিল যোগতান্ত্রিক – তাদের লক্ষ্যই ছিল আত্মকল্যাণ ও আত্মমোক্ষ বজ্র সহজযানীর উত্তরসাধক সহজিয়া বৈষ্ণব কিংবা বাউলেরা আজো তাই ভোগমোক্ষবাদী।
শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমমোক্ষবাদও কোনো পার্থিব কিংবা সামাজিক শ্রেয়সের সন্ধান দেয়নি। সবাই আত্মকল্যাণেই বৈরাগ্যবাদী। বাস্তব ও বৈষয়িক জীবনকে তুচ্ছ জেনে ঐসব পরান্নজীবী মোক্ষকামীরা বাঙালীর সমাজে-সংসারে বৈরাগ্য মাহাত্ম্য প্রচার করে। বাঙালীর ক্ষতি করেছে অপরিমেয়। কেননা, যে মানুষ ভোগলিপ্স অথচ কর্মকুণ্ঠ তার জীবিকা অর্জনের পথ দুটো ভীরুর পক্ষে ভিক্ষা এবং সাহসীর জন্যে চুরি।
বৈষয়িক দায়িত্বে ও কর্তব্যে ঔদাসীন্য ও ভিক্ষাজীবিতা এদেশে অধ্যাত্মসিদ্ধির রাজপথ বলে অভিনন্দিত হয়েছে সেই ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন মুনি-ঋষি-যোগী-শ্রমণদের আমল থেকেই। ফলে আজো ভিখিরিরা সাধু-ফকির রূপে সম্মানিত।
এদেশের বামাচারী-ব্রহ্মচারী যোগী-সন্ন্যাসী কিংবা পীর-ফকিরেরা পারত্রিক শ্রেয়সের নামে মানুষকে দায়িত্ব ও কর্তব্যভ্রষ্ট করে বৈষয়িক জীবনকে বন্ধ্যা করে রাখতে চেয়েছে; চিরকালানুতিক কর্মে ও কর্তব্যে কখনো তাদের অনুপ্রাণিত করেনি কেউ। কিন্তু তত্ত্বকথা শুনতে ভালো হলেও তাতে জৈব প্রয়োজন মেটে না, তাই মানুষ প্রবৃত্তিবশেই জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে আত্মকল্যাণ খুঁজেছে। বহুজন-হিতে বহুজন-সুখে যেহেতু কখনো সংঘবদ্ধ প্রয়াসের প্রেরণা মেলেনি, সেহেতু বাঙালীমাত্রই ব্যক্তিক লাভ ও লোভের সন্ধানে ফিরেছে কালো পিঁপড়ের মতো।
সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রিক জীবনে সামগ্রিক কল্যাণলক্ষ্যে যে যৌথপ্রয়াস আবশ্যিক, তার অভাবে বাঙালী কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি স্বয়ম্ভর কিংবা স্বাধীনভাবে। তাই সে চিরকাল বিদেশী-বিভাষী-শাসিত ও শোষিত। বিরুদ্ধ পরিবেশে তার বুদ্ধি ধুর্ততায়, তার উদ্যম স্বার্থপরতায়, তার শক্তি ঈর্ষায়, অসূয়ায় ও পরস্বাপহরণে অবসিত এবং সে আত্মপ্রত্যয়হীন হয়ে দেবানুগ্রহে ও পরানুগ্রহে বাঁচতে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সে স্বসৃষ্ট দেবাশ্রিত।
লৌকিক দেবতা কাল্পনিক পীরপূজার উদ্ভব ও প্রসার বাংলাদেশে এভাবেই ঘটেছে এবং ঘটেছে অন্তত ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধযুগ থেকে। জীবন-জীবিকার অনুকূল ও প্রতিকূল শক্তিকে তোয়াজে-তোষামোদে তুষ্ট রেখে দেবানুগ্রহে নিশ্চিন্ত-নিষ্ক্রিয় জীবনোপভোগকামী বলেই কর্ম ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে আত্মশক্তির ও পৌরুষের প্রয়োগ বাঙালী জীবনে বিরলতায় দুর্লভ।
অতএব কর্মকুণ্ঠ ভোগলিপ্সু বাঙালীর জীবনচেতনা ও জগৎম্ভাবনা দুভাবে প্রকটিত হয়েছে : এক, দীর্ঘজীবনলাভ ও জীবনকে নির্বিঘ্নে উপভোগ-বাঞ্ছায় অলৌকিক শক্তিধর হবার জন্যে দেহাত্মবাদী বাঙালীর যোগতান্ত্রিক সাধনায় এবং তুক-তাক, বাণ-টোনা, ঝাড়-ফুক, দারু-উচাটন, জাদুমন্ত্র, কবজ-মাদুলি, মারণ-বশীকরণ প্রভৃতির অনুশীলনে ও প্রয়োগে; দুই, বিভিন্ন শক্তি ও ফলপ্রতীক স্বসৃষ্ট লৌকিক দেবতা ও পীরের স্তুতি স্তাবকতায়। এবং সবটাই চলেছে বিদেশাগত বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামি শাস্ত্রের নামে।
যদিও তখনো মূল শাস্ত্রগুলোও শাস্ত্রবিদ ও সমাজপতির স্বার্থে ক্ষীণভাবে চালু ছিল। ধর্মদর্শনের ক্ষেত্রে বাংলায় স্মরণীয় পুরুষ বিরল ছিলেন না। মীননাথ গোরক্ষনাথ -শীলভদ্র-দীপঙ্কর-অম্বরনাথ-হাড়িপা-কানুপা-রামনাথ-রঘুনাথ-রঘুনন্দন-চৈতন্য রামমোহন-রামকৃষ্ণ প্রমুখ অনেকেই বাঙালী মনীষার প্রমূর্ত প্রতীক। কিন্তু এঁদের দেহাত্মবাদ, নির্বাণবাদ, মোক্ষবাদ, প্রেমবাদ, সেবাবাদ কিংবা শাস্ত্রানুগত্য মাটির মানুষের কোনো জাগতিক কল্যাণ সাধন করেনি।
![বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য [ Characteristics & Thinking of Bengali ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 5 কাজী নজরুল ইসলাম এর সাথে আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif](https://glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/কাজী-নজরুল-ইসলাম-এর-সাথে-আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif.jpg)
মধ্যযুগে বিজাতি-বিদেশী-বিভাষী বিধর্মীর ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের ফলে ব্রাহ্মণ্য সমাজের নির্জিত শ্রেণীর মধ্যে যে চেতনা, চাঞ্চল্য ও দ্রোহ দেখা দিল, উত্তর-ভারতীয় আদলে ইসলামি সাম্য ও সুফিতত্ত্বের অনুসরণে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের দেশ বাঙলায় চৈতন্যদেবের প্রেমধর্ম প্রচারের মাধ্যমে তা রূপ পেল। এই বৈরাগ্যপ্রবণ প্রেমবাদ সেদিন ব্রাহ্মণ্য সমাজের ভাঙন এবং ইসলামের প্রসার রোধ করেছিল বটে, কিন্তু তা পরিণামে বাঙালীর পক্ষে কল্যাণকর হয়নি।
আবার উনিশ শতকে কোলকাতার – স্নেচ্ছস্পর্শ দোষে সমাজ-পরিত্যক্ত ভদ্রলোকদের হিন্দু রাখার প্রত্যক্ষ প্রেরণায় রামমোহন প্রবর্তন করেন ব্রাহ্মমত। উভয়ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু কোনটাই সমাজ-বিপ্লবের রূপ নিয়ে বাঙালী জীবনে সামগ্রিক প্রভাব বিস্তার কিংবা চেতনায় নবরাগ সৃষ্টি করতে পারেনি।
বাস্তব ও বৈষয়িক জগৎকে আড়াল করে দেহাত্মবাদী বাঙালী নিঃসঙ্গভাবে যে আত্ম ও আত্মিক উন্নয়ন কামনা করেছে, প্রাচীন ও মধ্যযুগে তা মনন ও অধ্যাত্মক্ষেত্রে গৌরব গর্বের বিষয় ছিল। তার মনন ও জীবনদৃষ্টি ঐহিক পারত্রিক সুখলোভী আস্তিক মানুষের আত্মপ্রীতিপ্রবণ চাহিদা মিটিয়েছিল। এদেশে আজীবিক ছিল, কপিল-চার্বাকচেলা নাস্তিক ছিল, বৌদ্ধ নির্বাণবাদপ্রসূত উচ্চ দার্শনিক চিন্তার প্রসূন শূন্য ও বজ্রতত্ত্ব উদ্ভূত হয়েছিল।
গুণরত্ন-চেলাদের লোকায়তিক দর্শন বিকাশ পেয়েছিল। প্রতিবেশী ভোট-চীনার প্রভাবে যোগতান্ত্রিক সাধনাও প্রাধান্য পেয়েছিল। আজো বাঙালীর অধ্যাত্মসাধনামাত্রই যোগতন্ত্রভিত্তিক শ্রীচৈতন্যের অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদ, গৌড়ীয় ন্যায়, গৌড়ীয় স্মৃতি, পীর নারায়ণ সত্যের অভিন্ন অঙ্গীকারে মানুষের মিলনসাধনা, শাক্তদের নরমাতৃতত্ত্ব —রামপ্রসাদ রামকৃষ্ণে যার বিকাশ; রামমোহনের ব্রহ্মবাদ প্রভৃতি মননক্ষেত্রে বাঙালীর বিশ্রুত ও অক্ষয় কীর্তি।
আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো বাঙালী মননের ঐ ধারায় ত্রুটি আবিষ্কার করবেন। তাঁরা বলবেন, চিরশোষিত দারিদ্র্যক্লিষ্ট লোকজীবনের যন্ত্রণামুক্তির অবচেতন অপপ্রয়াসে অসহায় মানুষ অধ্যাত্মতত্ত্বে স্বস্তি ও শক্তির, প্রবোধ ও প্রশান্তির প্রশ্রয় কামনা করেছে।
এভাবে পার্থিব পরাজয়ের ও বঞ্চনার ক্ষোভ ও বেদনা ভুলবার জন্যে আসমানী চিন্তার মাহাত্ম্য প্রলেপে বাস্তবজীবনকে আড়াল করে ও তুচ্ছ জেনে মনোময় কল্পলোক রচনা করে সেই নির্মিত ভুবনে বিহার করে সার্থককাম ও আনন্দিত হতে চেয়েছে পৌরুষহীন, কর্মকুণ্ঠ, দুস্থ ও দুঃখী মানুষ। কিন্তু রক্তসঙ্কর বাঙালীর মন ও রুচি আলাদা। কবির ভাষায় তার বক্তব্য হয়তো এরূপ:
এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ
চাহিনে করিতে বাদ প্রতিবাদ
যে কদিন আছি মানসের সাধ
মিটাব আপন মনে।
যার যাহা আছে তার থাকা তাই
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই
একটি নিভৃত কোণে।
দেহতাত্ত্বিক বাঙালীর বিশ্বাস যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা-ই আছে দেহভাঙে। তাই আজো সে দেহাধারে সব-পাওয়ার সাধনা করে। তাই রবীন্দ্রনাথও বলেন :
আপনাকে এই জানা আমার
ফুরাবে না
এই জানারই সাথে সাথে
তোমায় জানা।
এটি এদেশের সুপ্রাচীন উচ্চারিত আকাঙ্ক্ষা। মর্ত্যজীবনের মাধুর্যে আকুল, দেহাধারে অমৃত সন্ধানী বাঙালী বলে :
কিংতো দীবে কিংতো নিবেজে
কিংতো কিজ্জই মস্তহ সেব্ব।
কিংতো তিথ-তপোবন জাই
মোক্খ কি লবভই পানী হাই।
– কী হবে তোর দীপে আর নৈবেদ্যে? মন্ত্রের সেবাতেই বা কী হবে তোর? তীর্থ তপোবনই বা তোকে কী দেবে? পানিতে স্নান করলেই কি মুক্তি মেলে?
আজকের বাউল-সাধকেরও সে-বিশ্বাস অটুট :
সখীগো জন্মমৃত্যু যাঁহার নাই
তাঁর সনে প্রেম গো চাই।উপাসনা নাই গো তাঁর
দেহের সাধন সর্ব সার
তীর্থ ব্রত যার জন্য –
এ দেহে তার সব মেলে।
দেহাত্মবাদী নিরীশ্বর বাঙালী বিদেশী শাস্ত্রের প্রভাবে আস্তিক হলেও তার দেহভিত্তিক সাধনা ও দেহানুরাগ বিচলিত হয়নি কখনো। তাই লালন কিংবা রবীন্দ্রনাথের মুখে একই ব্যাকুলতা ধ্বনিত হয়।
লালন বলেন :
আমাদের এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে
তারে জনমভর একবার দেখলাম নারে
ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে।
অথবা
এই মানুষে সেই মানুষ আছে
আমার হল কি ভ্রান্ত মন
আমি বাইরে খুঁজি ঘরের ধন।একবার আপনারে চিনলে পরে।
যায় অচেনারে চেনা।
এবং
রবীন্দ্রনাথও বলেন :
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে
দেখতে আমি পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি
হৃদয় পানে চাইনি।
কাজেই বাঙালী মননের তথা জীবনচেতনার ও জগৎভাবনার গতিপ্রকৃতিই আলাদা এবং তা দুহাজার বছর ধরে মূলত অভিন্নই রয়েছে। আদিকালের বাঙালীমাত্রই দেহাত্মবাদী ও নিরীশ্বর। সাংখ্যই তার দর্শন, যোগ-তন্ত্রই তার চর্যা। এবং বিদেশীতত্ত্ব প্রভাবিত অধ্যাত্মবাদী বাঙালীমাত্রই অদ্বেতবাদী ও কায়াসাধক।
বাঙ্গালী মুসলিমের ক্ষেত্রেও এ তথ্য প্রযোজ্য। মধ্যযুগের মুসলিম কবি-সাধকরাও ছিলেন যোগপ্রিয় ও অদ্বৈতবাদী। এমনকি বামাচারও কেউ কেউ পছন্দ করতেন। সৈয়দ সুলতান, হাজী মুহম্মদ, শেখ চান্দ, মীর মুহম্মদ শফী, আলী রজা, শেখ মনসুর, শেখ যাহিদ, নেয়াজ, মোহসিন আলী, শেখ জেরু, রমযান আলী, রহিমুল্লাহ, সিহাজুল্লাহ প্রভৃতি তো যোগ ও অদ্বৈততত্ত্ব সম্বন্ধে গ্রন্থই রচনা করেছেন। রহিমুল্লাহর গ্রন্থের নাম তনতেলাওৎ মানে কায়াসাধন। গর্ভলক্ষণ, প্রাণসস্কলি, শুক্রতত্ত্ব, নাড়িতত্ত্ব ও মৃত্যুলক্ষণ প্রায় সব গ্রন্থেরই মুখ্য আলোচ্য বিষয়।
![বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য [ Characteristics & Thinking of Bengali ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 6 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-6.jpg)
বাঙালী চিরকাল দেহতত্ত্ব দিয়েই জীবনরহস্য ও জগতত্ত্ব বুঝাবার সাধনা করেছে। এভাবেই তার আনন্দিত জীবন-স্বপ্ন রূপ পেয়েছে। সবটাই অবশ্য আত্মরতিপ্রসূত আত্মসাধন সংম্পৃক্ত। তবু সংকীর্ণ সরণীতে হলেও সে উচ্চমার্গের সূক্ষ্ণ ও জটিল চিন্তায় সমর্থ হয়েছে। মানব-মনীষার ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালীর এ অবদান চিন্তাজগতে তথা বিশ্বের মনন সাহিত্যে আমাদের কীর্তিমিনার।
বাঙালীর জীবনদৃষ্টি এরূপ ভিন্ন ছিল বলেই সে অতীতে কখনো রাজ্যগৌরব, শাসনদণ্ড, ধনগর্ব, ক্ষমতার দাপট কিংবা বাহুবলের প্রতাপ কামনায় বা অর্জনে উৎসাহবোধ করেনি। সে নিজের মতো করে নিজেকে জেনেই তৃপ্ত থেকেছে, আত্মসমাহিত জীবনে সে আনন্দিত ও পরিতুষ্ট রয়েছে। দুর্বৃত্তের সামাজিক ও দুর্ধর্ষের রাষ্ট্রিক শাসন-পীড়ন, শোষণ-পেষণ তাকে মনের দিকে বিচলিত করেনি, করেনি স্বভাবভ্রষ্ট। কিন্তু সমাজস্বার্থ নিরপেক্ষ ঐ জীবনতত্ত্ব বাঙালীর বৈষয়িক ও নৈতিক জীবন বিড়ম্বিত করেছিল।
সমাজের বিশেষ মানুষ যখন জীবনতত্ত্ব বিশ্লেষণে ও মোক্ষতত্ত্ব আবিষ্কারে নিষ্ঠ ও একাগ্রচিত্ত, তখন সাধারণ মানুষ জৈবিক ও বৈষয়িক প্রয়োজনে, শ্রেষ্ঠ মানুষের নেতৃত্বের ও নির্দেশের অভাবে, ব্যক্তিগত প্রয়াসে প্রাণ বাঁচানোর যথেচ্ছ উপায় অবলম্বনে ব্যস্ত। যারা বাঙালীর জীবনদৃষ্টির খবর জানত না, সেই বিদেশী শাসক পর্যটকরা হাটের-ঘাটের বাটের মাঠের ইতর মানুষকে বাঙলার ও বাঙালীর প্রতিনিধি স্থানীয় মানুষ বলে পটু বলে বাঙালীর নিন্দা রটিয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। নিন্দিত বাঙালী আজো তা স্মরণে লজ্জিত হয়।
এ অবধি আমরা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালীর জগৎচেতনা ও জীবনভাবনার বৈশিষ্ট্য বুঝতে প্রয়াস পেয়েছি। এবার আধুনিক বাঙালীভাবনার পরিচয় নেবার চেষ্টা করব।
উনিশ শতকের গোড়া থেকে প্রতীচ্য শাসন ও শিক্ষার, বিদ্যা ও বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে বিশ্বের উন্নত ও জাগ্রত জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালীর মানস-সংযোগ ঘটে। এর ফলে এদেশের জড় সমাজে বিচলন ও সংস্কার-জীর্ণ বন্ধ্যাচিত্তে একটা চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
বন্দর নগরী ও রাজধানী কোলকাতায় নবশিক্ষিতরা দেখল রেনেসাঁস-রিফর্মেশন-রেভেলিউশনের প্রসাদপুষ্ট ও ইনকুইজিশন মুক্ত বুর্জোয়া য়ুরোপ বিজ্ঞানে-দর্শনে সাহিত্যে, শিল্পে-বাণিজ্যে সাম্রাজ্যে, ধনে-যশে মানে, সেবায় সৌজন্যে-মানবতায় উদ্যোগে-উদ্যমে-প্রাণময়তায় প্রতাপে-প্রভাবে- দাপটে প্রদীপ্ত ভাস্করের মতো আশ্চর্য বিভায় শোভমান। আর নিজেদের প্রতি তাকিয়ে দেখল সংস্কারজীর্ণ, আচারক্লিষ্ট বন্ধ্যাসমাজ মধ্যযুগের বর্বর নারকীয় পরিবেশে স্থির হয়ে আছে।
এ লজ্জা তাদের শিক্ষার্জিত নবজীবন-চেতনায় ও নবলব্ধ আত্মসম্মানবোধে প্রচণ্ড আঘাত হানল। য়ুরোপীয় আদলে জীবন রচনার ও সমাজ গড়ার এক অতি তীব্র অন্ধ আবেগ তাদের পেয়ে বসল। জীবন ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে নতুন কিছু করার জন্যে তাই তারা ব্যস্ত হয়ে উঠল—বলা চলে আবেগ-প্রাবল্যে উৎকণ্ঠাবশে তারা দিশেহারার মতো ছুটোছুটি শুরু করল।
কিন্তু গোড়ায় রয়ে গেল গলদ। য়ুরোপ তাদের মনে যত আকাঙ্ক্ষা জাগাল, যত উত্তেজনা দিল, সে পরিমাণে ‘য়ুরোপীয় চিত্ত’ তাদের বোধগত হল না। তাই তাদের আন্তরিক প্রয়াস প্রত্যাশা পূরণে হল ব্যর্থ। প্রতীচ্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারীর মর্যাদা, জাতীয়তা, স্বাধীনতাপ্রীতি, কল্যাণবাদ, মানবতা, প্রগতি, লোকহিত, পরমতসহিষ্ণুতা প্রভৃতির কোনোটাই স্বরূপে উপলব্ধি করবার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে স্বেচ্ছাচারিতাকে, প্রগতির নামে নির্লক্ষ্য দ্রোহকেই তারা বরণ করে।
লোকহিত তাদের কাছে ছিল স্বশ্রেণীর কল্যাণবাঞ্ছা মাত্র। জাতীয়তা তাদের কাছে স্থান-কালহীন স্বধর্মীর সংহতি মাত্র। বাঙলার প্রশাসনিক ক্রান্তিকালে অন্ধ বিজাতি-বিদ্বেষ যেমন ফকির-সন্ন্যাসীদের নির্লক্ষ্য লুটেরা বানিয়েছিল, তেমনি ওহাবিদের কিংবা আর্যসমাজীদের করেছিল স্থান-কালহীন স্বধর্মীর হিতবাদী, তেমনি রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম হয়েছিলেন স্বশ্রেণীর কল্যাণকামী।
সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জেগেছিল বটে, কিন্তু বিধবা-বিবাহ প্রচলনে, বহুবিবাহ নিবারণে কিংবা নারী-পর্দা বর্জনে ও নারীশিক্ষা দানে বাস্তব উৎসাহ দেখা যায়নি। স্বাধীনতা-প্রীতি জাগল, ফরাসি বিপ্লব মুগ্ধ করল এবং সাম্য-ভ্রাতৃত্ব-স্বাধীনতা সার্বক্ষণিক উচ্চারণের বিষয় হল বটে, কিন্তু নিজেদের জন্য তারা স্বাধীনতা কামনা করেনি, সমর্থন পায়নি সিপাহি-বিপ্লব।
কোঁতের হিতবাদ ও নাস্তিকতা শিক্ষিত বাঙালীর বঙ্কিমেরও মন হরণ করল বটে, কিন্তু নাস্তিক রইল দুর্লভ, গণমানবের হিত-কামনা রইল বিরল। রামকৃষ্ণের-বিবেকানন্দের লোকসেবা দেবোদ্দেশ্যে নিবেদিত মানবতার নামে উৎসর্গিত নয়। জমিদারসমিতি গড়ে উঠল, কৃষকসমিতি তৈরী হল না। য়ুরোপে দেখল রাষ্ট্রিক জাতীয়তা, আর নিজেদের জন্যে কামনা করল ধর্মীয় জাতিসত্তা। তাই বাঙ্গালী হিন্দু শিক্ষিত হয়ে হিন্দু হয়েছে, মুসলিম হয়েছে মুসলিম—কেউ বাঙালী থাকেনি।
হিন্দু কংগ্রেস ময়দানী বক্তৃতায় ভারতবাসী মাত্রেরই মিলন ও সংহতি কামনা করেছে কিন্তু নির্জিত স্বধর্মীর কায়িক স্পর্শকে জেনেছে অপবিত্র বলে। তাই হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগই এদেশে টিকল, বাঙালী হিন্দু দিল্লির অভিভাবকত্বে পেল স্বস্তি, বাঙালী মুসলিম করাচীর কর্তৃত্বে হল নিশ্চিন্ত। বাংলা ও বাঙালী যে খণ্ডিত হল, বিচ্ছিন্ন হল, তাতে দুঃখ করবার রইল না কেউ। দেশ নয়, ভাষা নয়, গোত্র নয় ধর্মই আজো বাঙালী জাতীয়তার ভিত্তি।
উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালী-হিন্দু প্রেরণার উৎসস্বরূপ গৌরব-গর্বের ঐতিহ্যিক অবলম্বন খুঁজেছে আর্যাবতে, ব্রহ্মাবর্তে, রাজপুতনায় ও মারাঠা অঞ্চলে মুসলিমরা ছুঁড়েছে আরবে, ইরানে ও মধ্য এশিয়ায়। এমনকি দেশের এ-যুগের মহত্তম মানবতাবাদী পুরুষ রবীন্দ্রনাথও এ সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি।
পাণ্ডববর্জিত বাঙলার অধিবাসী হয়েও ব্রাহ্মণ্যসংস্কারবশে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের আর্য। উত্তরভারতে, রাজপুতনায়, মারাঠা অঞ্চলে, শিখ ইতিহাসে ও বৌদ্ধপুরাণে স্বজাতির গৌরব গর্বের ইতিকথা খুঁজেছেন, বিদেশী তুর্কি-মুঘলের প্রতি অশ্রদ্ধাবশে সাতশ’ বছরের ভারত-ইতিহাসকে তিনি এড়িয়ে গেছেন এবং তাঁর সাহিত্যে অস্বীকৃত হয়েছে। সাতশ বছরকাল পরিসরে দেশী মুসলিমের অস্তিত্ব।
স্বাধীনতাকামী সন্তানরূপে হিন্দুভারতেরই স্বাধীনতা কামনা করেছে, তার আগেও হিন্দুমেলাওয়ালারা স্বধর্মীর বাঙলা তথা ভারতেরই স্বপ্ন দেখেছে। সন্ত্রাসবাদী স্বদেশপ্রেমিক অরবিন্দ ঘোষ মানবকল্যাণকামী হয়েও অবশেষে যোগীসাধক শ্রীরবিন্দ রূপে প্রাচীন আধ্যাত্মিকতার চোরাবালিতে মানবমুক্তির সন্ধান করেছেন।
মোটামুটিভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধপূর্ব বাঙলায় বা ভারতে হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষিতদের কেউ মনের দিক দিয়ে সুস্থ ও স্বস্থ ছিলেন না। তাঁরা কেবল হিন্দু কিংবা শুধু মুসলমান ছিলেন। যে প্রতীচ্য বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য সমাজ-রাষ্ট্র তাঁদের আধুনিক জীবনভাবনায় অনুপ্রাণিত করেছে, তার Spirit চেতনার গভীরে ধারণ করা যায়নি বলে তাঁদের চিন্তায় কর্মে বিকৃতি ও বৈপরীত্য এসেছে। ফলে তাঁদের সব প্রয়াস অসামঞ্জস্যের শিকার হয়ে বিড়ম্বিত ও ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতীচ্যের অনুকৃতি ও প্রাচ্য-স্বভাবের টানাপোড়নে আলোচ্য যুগের কথায় ও কর্মে কিছু জটিলতা দেখা দিলেও আধুনিকতার আবরণ উন্মোচন করলে রামমোহন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম রামকৃষ্ণ-রবীন্দ্রনাথ-অরবিন্দ-তিতুমির-দুদুমিয়া-মেহেরুল্লাহ-মৌলানা বাকী আকরম খাঁ সবাইকেই আদি ও অকৃত্রিম বাঙালী মন ও মননের প্রতিভূরূপেই দেখতে পাই। সেই শ্রেণী-চেতনা, সেই স্বাধর্ম, সেই বৈরাগ্য, সেই আধ্যাত্মিকতা, সেই সংকীর্ণজীবন চেতনা ও বাস্তব বিমুখতা, সেই নিঃসঙ্গতা, সেই আত্মরতি তাদের মনে-মননে, কথায় কর্মে অবিকৃতভাবেই অবিরল রয়েছে।
চোখ ধাঁধানো ও মন-ভোলানো আধুনিকতা তাদের মনে-মননে প্রলিপ্ত চন্দনের মতোই বিজড়িত বটে কিন্তু অন্তরঙ্গ নয়। তাই যে মাটি মায়ের বাড়া, হাজার বছরের পরিচিত জ্ঞাতি-বিধর্মী যে প্রতিবেশী তাদের পর করে পরকে প্রিয় ভাবতে তারা এতটুকু বেদনাবোধ করেনি। গত দেড়শ বছর ধরে বাঙলাদেশে বঙ্গপ্রবাসী হিন্দু ছিল মুসলমানও ছিল কিন্তু বাঙালী ছিল না।
দৈশিক জাতীয়তায় বাঙালী দীক্ষিত হয়নি, এ যন্ত্রযুগেও যৌথকর্মে পায়নি দীক্ষা। জনে জনে জনতা হয়, মনের ‘সায়’ না থাকলে একতা হয় না, একত্রিত হওয়া সহজ কিন্তু মিলিত হওয়া সাধনা সাপেক্ষ। সে-সাধনা বাঙালী করেনি, তাই আবেগবশে সে ক্ষণিকের জন্যে উদার হয়, উত্তেজনাবশে সে ক্ষণিকের জন্য মরণপণ সংগ্রামে নামে, মৌহুর্তিক স্বার্থবশে ঐক্যবদ্ধও হয় কিন্তু কোনোটাই টেকে না। তাই চৈতন্যের সাম্য ও প্রীতিভিত্তিক প্রেমবাদও বাংলায় ব্যর্থ হল।
এজন্য বাঙালী বৈষয়িক জীবনে কোনো বৃহৎ কর্মে উদ্যেগী হলেও সফল হয় না। লীগ-কংগ্রেসের জন্ম বাঙলায়, বিদ্বান বুদ্ধিমানও বাঙলায় সুলভ ছিল, তবু নেতৃত্ব বাঙালীর হাতে থাকেনি। সঙ্ঘশক্তি নেই বলে সে চিরকাল বিদেশী শাসিত-শোষিত ও দুস্থ। নিজে বঞ্চিত স্বধর্মীর গৌরব ও ঐশ্বর্যগর্বে সে গর্বিত ও আনন্দিত থাকে।
![বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য [ Characteristics & Thinking of Bengali ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 7 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-7.jpg)
আজো বাঙলাদেশে এমন একজন অবিসম্বাদিত সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানববাদীর আবির্ভাব হয়নি, যাঁকে আদর্শ মানুষ ও মানবপ্রেমিক বা নিরপেক্ষ গণকল্যাণকামী পুরুষ বা নারী হিসেবে সন্তানের সামনে অনুকরণীয় বলে স্মরণ করা যায় কিংবা ঘরে। প্রতিকৃতি টাঙিয়ে রাখা চলে অনুপ্রাণিত হবার সদুদ্দেশ্যে। সমাজের বা ইতিহাসের এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে!
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে আমাদের দেশে মার্কসবাদ জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত হতে থাকে। তার কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দুনিয়ায় দরিদ্রদেশের মানুষ পুরোনো যোগ্যতমের উর্দ্ধতনবাদ সমর্থিত কেড়ে-মেরে-শোষণে-বঞ্চনায় বাঁচার তত্ত্বে আস্থা হারিয়ে সমস্বার্থে সহিষ্ণুতা, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের অঙ্গীকারে মার্কসীয় বণ্টনে বাঁচাতত্ত্বে ভরসা রাখে।
মানবিক সমস্যা সমাধানের এই নতুন প্রত্যাশা হতাশ মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বস্ত করে তোলে। তাই আজকের দুনিয়ায় নিঃস্ব, দুস্থ গণমানবের জিগির ও স্বপ্ন হচ্ছে সমাজবাদ ও সাম্যবাদ। এ-তত্ত্বের মূলকথা আধুনিক কায়াসাধন-তনুর সেবা। কাজেই এ-তত্ত্বে আসমানী কিছুই নেই, আছে মানুষকে প্রাণী হিসেবে গণ্য করে প্রাণে বেঁচে থাকার জন্মগত মৌলিক ও সঙ্গত অধিকারে স্বীকৃতি দান।
শারীরিক ক্ষুৎপিপাসা নিবারণতত্ত্বভিত্তিক বলেই এ হচ্ছে নিতান্ত বস্তুবাদী দর্শন। কাজেই সমাজ বা সাম্যবাদী মাত্রই মানববাদী এবং মানববাদের দীক্ষার প্রথম শর্ত হচ্ছে দেশ-জাত-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে কেবল ‘মানুষ’ হিসেবে জানতে ও মানতে হবে; মানুষের মৌল মানবিক অধিকার সর্বাবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে।
অতএব সমাজবাদ কিংবা সাম্যবাদ অঙ্গীকার করতে হলে পুরোনো শাস্ত্রে এবং সেই শাস্ত্রভিত্তিক সমাজে ও সরকারে আনুগত্য পরিহার করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কারণ এগুলোর ভিত্তিই হচ্ছে দল চেতনা। মানুষে মানুষে বৈরিতা ও স্বাতন্ত্র্য জিইয়ে রাখার অঙ্গীকারেই দলীয় সংহতির স্থিতি। সম ও সহস্বার্থেই দল গড়ে ওঠে।
মনের, মতের ও স্বার্থের ঐকাই দল গঠনের ভিত্তি। কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বী বা ভিন্নদলগুলোকে পর, সন্দেহভাজন ও শত্রু না ভাবলে স্বদলের স্বাতন্ত্র্য ও সংহতি রক্ষা সম্ভব হয় না। সুতরাং অন্য দলের প্রতি অবজ্ঞা, ঈর্ষা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব পোষণ না করলে স্বদলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পায় না।
সব দলই একরকম। পার্থক্য কেবল এই যে, শাস্ত্রীয় দল অর্থাৎ ধর্মসম্প্রদায় ঐহিক পারত্রিক জীবন সংপৃক্ত বলে অনন্ত শাস্তির ভয়ে ঐটিতে মানুষের জীবনব্যাপী অনড় আনুগত্য থাকে। অন্য পার্থিব দল সময় ও সুযোগমতো স্বার্থবশে ক্ষতির ঝুঁকি না নিয়েই বদল বা লোপ করা চলে। কিন্তু শাস্ত্রীয় দল অবিনশ্বর। এ কারণে ধর্মীয় দলের কোন্দল চিরন্তন ও মারাত্মক। অতএব শাস্ত্রীয় আনুগত্য পরিহার করেই কেবল মানুষ উদার মানবতাবোধে নির্বিশেষ মানবের মিলন-ময়দান তৈরি করতে পারে।
কেননা শাস্ত্রে আস্থা হারালেই মনবুদ্ধি মুক্ত ও নিরপেক্ষ হয়। অন্য পার্থিব দল ক্ষণজীবী, সেজন্য সেগুলো কোন স্থায়ী ও সর্বজনীন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে না। তাই অন্য দল মানবিক সমস্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতএব সমাজবাদী বা সাম্যবাদী তথা মানববাদী হতে হলে প্রথমেই শাস্ত্রীয় আনুগত্য তথা শাস্ত্রে আস্থা পরিহার আবশ্যিক। তাহলে সে-সঙ্গে শাস্ত্রভিত্তিক পুরোনো সমাজ-সরকারে আনুগত্যও লোপ পাবে।
আজকের মানবশাস্ত্র ও মানবধর্ম হবে সমস্বার্থে সহিষ্ণুতা, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের স্বীকৃতিতে বণ্টনে বাঁচার অঙ্গীকার।
উগ্রজাতীয়তা, গোত্রদ্বেষণা, বর্ণবিদ্বেষ ও ধর্মভেদপ্রসূত অভিশাপ বিমোচনের অঙ্গীকারে ডক্টর গোবিন্দ দেব প্রমুখ চিন্তাবিদেরা সহিষ্ণুতাভিত্তিক যে সমন্বয়ী মানবতার তত্ত্ব প্রচারে উৎসুক, তা বুর্জোয়া উদারতার পরিচায়ক মাত্র। শুনতে ভালো হলেও সেই পুরোনো তত্ত্বে মানবিক সমস্যা সমাধানের শক্তি নেই, কোনোকালে ছিলও না।
ধার্মিক মানুষের সেক্যুলার হওয়ার চেষ্টা সোনায় পাথরবাটি বানানোর মতোই অবাস্তব ও অসম্ভব। কেননা স্বধর্মে নিষ্ঠা এবং পরধর্মে অনাস্থা ও অবজ্ঞাই শাস্ত্রানুগত্য বা ধার্মিকতার মৌল শর্ত। একজন ধার্মিক বা আস্তিক বড়জোর সহিষ্ণু হতে পারেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কিন্তু পরশাস্ত্রে কখনো শ্রদ্ধাবান হতে পারেন না।
আজ দেশে সমাজতন্ত্রের জিগির উঠেছে, এ উচ্চারিত বুলি বুকের সত্য হয়ে উঠলে আমাদের প্রত্যাশিত সুদিন শিগগিরই আসবে। কেননা শাস্ত্রে আস্থা পরিহার করলে বাঙালীর স্বভাব বদলাবে। বাঙালী আধুনিক জাগ্রত ও স্বস্থ বিশ্বের নাগরিক হয়ে উঠবে আর একান্তই বাঙালী থাকবে না। নিরীশ্বর-নাস্তিক অন্তত শাস্ত্রদ্রোহী মুক্তবুদ্ধি মানববাদী বাঙালীর উপর নির্ভর করছে বাঙালীর সুন্দর ভবিষ্যৎ। সামনে নতুন দিন। প্রত্যাশী ও আশ্বস্ত আমরা সেই নতুন সূর্যের উদয়-লগ্নের প্রতীক্ষায় থাকব। অতএব মাভৈঃ। কথায় বলে
সজ্জনাঃ গুণমিচ্ছস্তি
দোষমিচ্ছন্তি পামরাঃ।
আমি আজ পামরের ভূমিকাই পালন করলাম—তবে সবটাই সদুদ্দেশ্যে। আপনাদের সৌজন্যের সুযোগ নিয়ে আপনাদের ধৈর্যের উপর এতক্ষণ পীড়ন চালিয়েছি, সেজন্য ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিচ্ছি।”
[ বাঙালীর মনন-বৈশিষ্ট্য – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: