স্বাধীনতার দায় [ The responsibility of freedom ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : First deserve then desire— আগে যোগ্য হও, পরে কামনা কর’-বলে একটি আপ্তবাক্য চালু রয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে কোনো নতুনকে, কোনো বাঞ্ছিতকে পেতে হলে, তা পাবার জন্যে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। কেননা অকালে ও অপাত্রে প্রকৃতি কিংবা বিধাতা কিছুই দান করে না।
জিজ্ঞাসা থেকে অভাববোধ, অভাবচেতনা থেকে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে প্রয়াস, জাগে উদ্যম, শুরু হয় উদ্যোগ। জিজ্ঞাসা জাগে তখনই, যখন পুরোনো নীতির দুর্গে ফাটল ধরে, পুরোনো রীতি উপযোগ রায়, পুরোনো বিশ্বাস জীর্ণতা পায়, পুরোনো সংস্কার নিগড়রূপে প্রতিভাত হয়, পুরোনো পাথেয় অকেজো হয়ে যায়, পুরোনো জীবিকা-পদ্ধতি অভাব পূরণে ব্যর্থ হয়, পুরোনো সম্পদ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
অতএব, পুরোনো জীবননীতি ও জীবিকারীতির প্রতি সন্দেহ, অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস না জাগলে নতুনের আকাঙ্ক্ষা জাগে না, আর আকাঙ্ক্ষা না জাগলে প্রাপ্তির প্রয়াসও থাকে অনুপস্থিত। পুরোনোতে আস্থা হারালেই প্রাপ্তির প্রয়াস প্রাকৃতিক নিয়মেই হয় শুরু। এটি কোনো বিশেষ মানবিক গুণ নয়, নিতান্ত জৈবিক প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, মানবিক প্রয়াস মাত্রেরই পেছনে রয়েছে প্রাণী হিসেবেই মানুষের জৈবিক চাহিদা।
![স্বাধীনতার দায় [ The responsibility of freedom ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 google news](https://glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
বিদ্বানেরা বলেন, মানুষের যাবতীয় বিকাশ জীবিকাসংপৃক্ত। অর্থাৎ জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ্যে মানুষ জীবিকার ক্ষেত্রে অনবরত যে অনলস প্রয়াস চালিয়েছে বা আজো চালিয়ে যাচ্ছে, তারই ফলে সমাজে ও শাস্ত্রে, সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে মানুষ আজকের এই মুহূর্তের বিকাশের স্তরে উন্নীত।
যে-মানুষের জিজ্ঞাসা নেই—কৌতূহল নেই, সে মানুষ কেবল পোষা প্রাণীর মতো পরান্নজীবী ও পরবুদ্ধি-নির্ভর হয়ে যান্ত্রিকভাবে জীবনের দিনগুলো নষ্ট করে মৃত্যুর শিকার হয়। গোত্র বা জাতির সম্পর্কেও এ তথ্য প্রযোজ্য, তাই দুনিয়ায় আজো আদি আরণ্যমানব সুলভ এবং একদা-বদ্ধিষ্ণু বহু গোত্র আজ নিশ্চিহ্ন।
![স্বাধীনতার দায় [ The responsibility of freedom ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-6.jpg)
চেতনায় নতুন স্বপ্ন না জাগলে, নতুন কিছু চাওয়া কিংবা পাওয়া অসম্ভব। আগে অভাববোধ, পরে প্রাপ্তি-প্রয়াস, আগে পরিকল্পনা, পরে বাস্তবায়ন। চাওয়া-বিরহী পাওয়া-বস্তু সম্পদ নয়, কেননা উপযোগবুদ্ধি বিজড়িত নয় বলে তা অকেজো।
জীবনকে ঐশ্বর্য বলে যারা জানে, স্বাধীনতাকে তারাই সম্পদ বলে মানে। জীবনবৃক্ষে ফুল ফোটাবার জন্যে, ফল ফলাবার জন্যে স্বাধীনতা দরকার। বিকাশ কেবল স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার মধ্যেই সম্ভব। এ ব্যক্তিক জীবনে যেমন, জাতীয় জীবনেও তেমনি প্রয়োজন।
অতএব স্বাধীনতাকে যারা সম্পদরূপে আবিষ্কার করে না, অর্জন করে না, তাদের কাছে স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচারের অধিকারই স্বাধীনতা। তেমন মানুষের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন কিংবা রক্ষণ সম্ভব নয়, কেননা স্বাধীনতার উপভোগ সামর্থ্য তার নেই বলেই স্বাধীনতার মূল্য-মহিমাও তার অজ্ঞাত এবং সে-কারণে স্বাধীনতার প্রসাদ তার অনায়ত্ত ও অনাস্বাদিত।
স্বাধীনতা অনুভবের ও উপভোগের সম্পদ। এর জন্য যোগ্যতা প্রয়োজন, ব্যষ্টিমনে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও নৈতিক দায়িত্বচেতনা এবং কর্তব্যবুদ্ধি স্পষ্ট হয়ে না জাগলে এবং ব্যক্তি-মানুষ তা পালনে নিষ্ঠ না হলে প্রাপ্তির ও ভোগের দাবি ও অধিকার জন্মায় না, দাবির সঙ্গে দায়িত্ব ও অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য বর্তায়।
অন্যায়, অসুন্দর ও অকল্যাণের প্রতি ঘৃণা, বিবেকবুদ্ধির আনুগত্য, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবুদ্ধি, দাবি ও অধিকার-চেতনা প্রভৃতিই নাগরিকের যোগ্যতার নিদর্শন। এমনি মানুষই কেবল স্বাধীনতা অর্জন, রক্ষণ ও উপভোগের যোগ্য। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই সব কল্যাণ-চিন্তার ও সুফলপ্রসূ কর্মের উৎস। সেবা, সততা ও ত্যাগবৃত্তি ঐ ভালোবাসারই প্রসূন। আগের যুগে স্বদেশী, স্বধর্মী ও স্বজাতি দেশের শাসক হলেই লোকে নিজেদের স্বাধীন বলে গর্ববোধ করত।
আদিকালে স্বাধীনতা ছিল কেবলই গৌরব-গর্বের বিষয়, গণমানবের তেমন কোনো বৈষয়িক সুখ-সুবিধা প্রত্যক্ষভাবে কিংবা লক্ষণীয়ভাবে স্বাধীনতা-সংলগ্ন ছিল না। এ যুগে রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা সামগ্রিকভাবে প্রতি মানুষের জীবন-জীবিকা বিজড়িত। আজকের দিনে স্বাধীনতা ব্যষ্টি-মানুষের অস্তিত্বেরই অপরিহার্য অঙ্গ। এই নতুন তাৎপর্যে স্বাধীনতা মানুষের জীবনে জীবিকায় নিরাপত্তার স্বাচ্ছন্দ্যের ও বিকাশের ভিত্তি ও অবলম্বন। এ কারণেই সামরিক স্বনির্ভরতা ও আর্থিক স্বয়ম্ভরতাই হচ্ছে এ-যুগের স্বাধীন সার্বভৌম তথা অনপেক্ষ শক্তির প্রতীক।
তাই স্বাধীনতা উপভোগের জন্য অনুকূল প্রতিবেশ সৃজন করতে হয়—যে প্রতিবেশে থাকবে ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য, সামাজিক জীবনে সাম্য ও স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবনে শ্রেয়ঃ বরণের ও সংস্কার বর্জনের প্রবণতা, জীবিকার ক্ষেত্রে সমসুযোগ ও সুবিচার, রাষ্ট্রিক জীবনে দায়িত্ব-নিষ্ঠা ও অধিকার-চেতনা। আমাদের চেতনার মধ্যে স্বাধীনতার এ গুরুত্ব সম্যকস্বরূপে ধারণ করা আশু প্রয়োজন। তাহলেই দুর্লভ চরিত্র ও সুদুর্লভ স্বাচ্ছল্য আমাদের আয়ত্তে আসবে।
[ স্বাধীনতার দায় – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: