ইতিহাস তত্ত্ব [ History Theory ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : মানুষের চিন্তা-ভাবনার কিংবা কর্মপ্রয়াসের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের বা ক্রমবিবর্তন ধারার তথ্যই ইতিহাস। এ দৃষ্টিতে মানব-অভিব্যক্তির সবকিছুরই ইতিহাস তথা ইতিবৃত্ত রয়েছে। এমনকি সৃষ্টির এবং প্রকৃতির পুষ্টি ও বিবর্তনধারার ইতিহাসও আছে। কিছু আগের কালের মানুষের ইতিহাস সম্বন্ধে এই ব্যাপক ধারণা ছিল না।
তাই আদিকালে মানুষ দেও-দেবতার কাল্পনিক ইতিবৃত্ত তৈরি করেছে এবং সামস্তযুগে তারা রাজরাজড়ার সন্ধিবিগ্রহ ও জয়-পরাজয়ের কাহিনীকেই কেবল ইতিহাস বলে মানত। সামাজিক মানুষের সামগ্রিক জীবনপ্রবাহই যে ইতিহাসের উপাদান ও উপকরণ, সে বোধ জাগতে সময় লেগেছে কয়েক হাজার বছর।
তারপর আধুনিক যুগে সর্বপ্রকার মানব-অভিব্যক্তিকেই ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করবার গরজ মানুষের বোধগত হয়। কেননা ইতিহাস জানা মানার জন্যে নয়, প্রতিবেশের পরিপেক্ষিতে মানব-স্বভাব বোঝার জন্যে, শ্রেয়সকে আবিষ্কার করার জন্যেই। এর ফলে এ-যুগে কেবল দেশ-কাল-সমাজেরই ইতিহাস রচিত হয় না, জ্ঞান-বিজ্ঞানের, ধর্মদর্শনের, ভাবচিন্তার কিংবা কৃষি-শিল্প বাণিজ্য প্রভৃতি সর্বপ্রকার মানবিক প্রয়াসেরই ইতিবৃত্ত রচিত হচ্ছে।
কিন্তু ইদানীং পূর্বযুগ অবধি মানুষ রাজরাজড়ার কাহিনী-মুখ্য ইতিহাসকে প্রেরণার উৎস বলে জানত। এই মারাত্মক ভুল ধারণার বশে দেশে দেশে মানুষ জাতীয় কিংবা স্থানীয় ইতিহাস বিকৃত-তথ্যে পূর্ণ করে গৌরব-গর্বের আকর করবার চেষ্টা করেছে। ফলে সত্যসন্ধ মানুষের কাছে ইতিহাস Legends agreed upon’ বলে নিন্দিত ও অবজ্ঞাত হয়েছে।
ইতিহাস কিংবা ঐতিহ্য কখনো প্রেরণার উৎস হতে পারে না। যদি তাই-ই হত, তবে গ্রিস-রোম-পারস্যের পতন হত না এবং ইতিহাস বা ঐতিহ্যের অভাবে দুনিয়ায় কোনো নতুন সভ্যতা-শক্তির উন্মেষও ঘটতে পারত না।
প্রেরণার আকর হিসেবে ইতিহাস তৈরি করতে যেয়ে মানুষ কেবল আত্মস্বার্থে ও স্বপ্রয়োজনে তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছে আর কামনা করেছে ঘটনার ও পরিণামের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু তাদের সে-বাঞ্ছা কোনোদিন সফল হয়নি। কেননা সত্য অতিরঞ্জিত হয়ে মিথ্যায় পরিণত হয় এবং বানানো তথ্য লোকপ্রিয় হলেও সত্য হয় না। কাজেই প্রতিজ্ঞা (Premise) যদি ভুল হয়, সিদ্ধান্ত (Inference) অসার-অসত্য হতে বাধ্য।
স্বার্থবশে এতকাল মানুষ দেদার মিথ্যার বেসাতি করেছে, তাই ইতিহাস-পাঠ ফলপ্রসূ হয়নি। বরং ইতিহাস-পাঠে উত্তেজিত মানুষ কখনো কখনো কোথাও কোথাও ক্রোধবহ্নি ও অসুয়াবিষ ছড়িয়ে বৈনাশিক উল্লাসে মত্ত হয়েছে। তাই আজ অবধি মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাস রিপুপরবশ মানুষের রক্তস্নানের ইতিকথারই নামান্তর মাত্র।
আসলে ইতিহাস প্রেরণার উৎস নয়, বরং তা এড়াবার জন্যেই ইতিহাস রচন ও পঠন প্রয়োজন। ইতিহাস চেতনা জীবনে আবর্তন কামনা করে না, বিবর্তন ও অগ্রগতিই বাঞ্ছা করে। মানুষের জীবিকাগত ও রিপুগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণ নিরূপণ এবং মনুষ্য-স্বভাব সম্পর্কে সতর্কতার ও তার সংশোধনের এবং তার উৎকর্ষের ও উন্নয়নের বুদ্ধি ও পন্থা লাভ লক্ষ্যেই ইতিহাসের রচন ও পঠন নিয়ন্ত্রিত হওয়া কাম্য।
এই বোধের অনুগত হয়েই আজকের জ্ঞানী মনীষীরা ইতিহাসকে বিজ্ঞানরূপে গ্রহণ করেছেন এবং দেশকালগত মানুষের সামগ্রিক জীবনজিজ্ঞাসা, জীবিকাপ্রয়াস ও জীবনপ্রবাহগত আনন্দ ও যন্ত্রণাকে এবং সম্পদ ও সমস্যাকে ইতিহাসের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই আজকের ইতিহাস কেবল তথ্যের সংকলন নয় শুধু লাভ-ক্ষতির পরিসংখ্যানও নয়, এমনকি ভূত-ভবিষ্যতের তৌলে মূল্যায়নও নয়, বিশ্বমানবিক সমস্যার আলোকে আন্তর্জাতিক কার্য-কারণ সূত্রের নিরিখে বিশ্লেষণাত্মক সিদ্ধান্তও।
অতএব, এ-যুগের কোনো আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন তথ্যের আকর হিসেবে অবাঞ্ছিত—–একে বিশ্বসংলগ্ন হতেই হবে। আজকের সংহত বিশ্বে মানুষের ব্যক্তিক চিন্তা এবং কর্মও আপেক্ষিক। আজ তাই ইতিহাস রচকের বা পাঠকের কেবল ইতিহাসজ্ঞ হলেই চলবে না। তাকে আনুষঙ্গিক বিষয়েও অবহিত থাকতে হবে।
কেবল সত্যসন্ধ ও তথ্যপ্রিয় হলেই ইতিহাস পড়ার বা লেখার যোগ্যতা বর্তাবে না, সে-সঙ্গে তাঁকে দেশকালগত সামাজিক, ধার্মিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, আর্থিক, প্রশাসনিক চিন্তা চেতনা এবং লৌকিক বিশ্বাস-সংস্কার ও নৈতিক নিয়ম-রেওয়াজ সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। এক কথায় সামগ্রিক জীবনপ্রবাহের পটভূমিকায় সত্যসন্ধ তথ্যনিষ্ঠ প্রজ্ঞাবান ও কারণ-করণ বিশ্লেষণ-বুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্বানই কেবল ইতিহাস রচনার ও আলোচনার যোগ্য। তেমন মানুষই শুধু ইতিহাসপাঠের ফলশ্রুতি মানবিক সমস্যার সমাধানে সুপ্রয়োগ করতে পারেন।
দেশের ইতিহাস-প্রিয় ও ইতিহাসবেত্তা জ্ঞানী-মনীষীরা নিজেদের উদ্যোগে ও যোগ্য নেতৃত্বে আমাদের দেশের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বিস্মৃত, অর্ধ-বিস্তৃত, বিকৃত ও বিশৃঙ্খল ইতিহাসের আলো-আঁধারি ঘুচাবেন, অপসারিত করবেন আমাদের বিভ্রান্তি ও বিমূঢ়তা এবং ইতিহাস-বিজ্ঞান ও ইতিহাস-দর্শন প্রয়োগে সুপরিকল্পিতভাবে সামগ্রিক সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত জীবনপ্রবাহের বিশ্লেষণমূলক যুগোপযোগী দৈশিক ইতিহাস রচনায় ব্রতী হবেন, তাঁদের কাছে এইটি আমাদের প্রত্যাশা নয় কেবল, দেশের গণমানবের স্বার্থে জাতীয় জীবনের স্বরূপ উপলব্ধির প্রয়োজনে আমাদের দাবিও।
আজকের দিনে মানবিক সমস্যার সমাধানের জন্যেই; বিশ্বমানবের সহাবস্থান, সহযোগিতা ও সর্বাত্মক কল্যাণের জন্যেই যথার্থ ইতিহাস-চেতনার বড় প্রয়োজন।
জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি ও কীর্তি সাফল্যের চিহ্ন এবং গৌরব-গর্বের অবলম্বন বলে। ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকে কিন্তু জাতির নৈতিক ও চারিত্রিক দুর্বলতার কথাও স্মরণে না রাখলে কেবল গৌরব-গর্বের আস্ফালনের মধ্যে শক্তি ও প্রেরণা পাওয়া যায় না, ফাঁকি দিয়ে অন্যকে প্রতারিত করা গেলেও নিজেকে প্রতারণা করা চলে না।
নিজের শক্তি ও দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন না থাকলে আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রত্যয় অকৃত্রিম হয় না, তাতে চোরাবালির উপর পা রাখার মতো জাতীয় জীবনে সংকট ও সম্ভাবনার মুহূর্তে বিড়ম্বনার, বিপর্যয়ের ও অসাফল্যের শিকার হতে হয়। এই জন্যই নবজাগ্রত স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রকৃত পরিচয় – তার বক্র ও বিচিত্র বিকাশ ও বিবর্তন ধারার ইতিকথা জানা ও জানানো আবশ্যিক।
এই ইতিহাসই দেবে জাতিকে প্রজ্ঞা-দৃষ্টি দেবে আঁধার পথে আলোকবর্তিকার মতোই নির্ভুল পথের দিশা। ইতিহাসে লভ্য প্রজ্ঞাই হবে জন জাতীয় জীবনের পাথেয়। আগের যুগে এবং এখনো অনেক দেশে শাস্ত্র, সমাজ ও সরকারের আপাত স্বার্থে ইতিহাসের ঘটনা ও পরিণামকে বিকৃত করার রেওয়াজ চালু ছিল ও রয়েছে, কিন্তু এ বৃথা প্রয়াসের ফল কখনো ভালো হয়নি। মহাকালের অমোঘ নিয়মেই শেষ অবধি সত্যকে মিথ্যার আবরণে গোপন করা যায়নি। আমরা আশা করব আমাদের দেশেও সমকালীন তথা বর্তমানের ইতিহাস রচনায় কোনো সরকারি বাধা থাকবে না।
[ ইতিহাস তত্ত্ব – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: