প্রেসিডেন্সিয়াল হারেম – জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ]

প্রেসিডেন্সিয়াল হারেম নামের অধ্যায়ে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান বইটি তুলে ধরেছেন ইয়াহিয়ার চরিত্র। আমাদের এই মার্চে “পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ” এর অংশ হিসেবে তার অনুসন্ধানগুলো তুলে ধরা হবে। পাকিস্তান আমাদের দীর্ঘ ২৩ বছর শোষণ করেছে। তবে সেই শোষণ মূলত করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানি এলিট। তাই পাকিস্তানি শাসন-শোষণ এর চেহারা সম্পর্কে জানার জন্য এদের জীবনাচার সম্পর্কে জানা জরুরী। বইয়ে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সব রকম অন্যায়, অপরাধ। ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত জীবন দেখাতে গিয়ে উঠে এসেছে সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়। “প্রেসিডেন্সিয়াল হারেম” অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন :

প্রেসিডেন্সিয়াল হারেম :

ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ১১ দিন পর ১৯৭২ এর জানুয়ারির ১ তারিখ লাহোর টেলিভিশন নতুন বছরের জন্য একটা ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারের পরিকল্পনা করল।

প্রথমবারের মতো তারা জনতার সামনে এমন কতগুলো সুন্দরী রমণীর ছবি প্রচার করা শুরু করল যাদের সাথে ইয়াহিয়া খানের গভীর সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের কারণে হতাশ পাকিস্তানিরা টেলিভিশনে ইয়াহিয়া খানের গোপন এই কুৎসিত চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেল।

কেউ কেউ এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারের বিরোধিতা করল। কারণ গোঁড়া মুসলিম পরিবারগুলোতে যেখানে পরিবারের সবাই এক সাথে বসে টিভি অনুষ্ঠান দেখে সেখানে এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার দর্শকদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। আবার কেউ কেউ এটা বলতে শুরু করল যে পাকিস্তানের শত্রুরা এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য ষড়যন্ত্র করছে। কারণ তারা এর মাধ্যমে পাকিস্তানের পরাজয়ের পেছনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের নৈতিক স্খলনকে মূল কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে।

 

প্রেসিডেন্সিয়াল হারেম - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ]
পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও নুর জেহান [ Pakistani General Yahya Khan & Singer Noor Jehan ]

তবে এই ধরনের অভিযোগ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন। তিনি বরং নির্দেশ দিলেন ইয়াহিয়া খানের হারেম জীবনের সব কিছু খুঁটিনাটি যেন সাধারণ মানুষকে দেখানো হয়। সাধারণ মানুষের জানা উচিত কেন এবং কীভাবে তারা যুদ্ধে হেরেছিল। কিছু মানুষ বিশেষ করে জামাতে ইসলামি ভুট্টোর এই ধরনের কাজের তীব্র সমালোচনা তারা যে ভুট্টো নিজের ইমেজকে আরো স্বচ্ছ ও জোরালো করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে পর্যুদস্ত পরিকল্পনা করছে।

ঘটনা যাই হোক না কেন ভুট্টো নিজেই টেলিভিশন মিডিয়াকে উৎসাহিত করেছিলেন ১১ মাসে সেনাবাহিনীর ভিতর যা ঘটেছিল তার সব পাকিস্তানি সমাজের উচ্চস্তর থেকে শুরু করে নিম্নস্তর পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে যেন প্রকাশ করে পৌঁছে দেয়া হয়। প্রথমবারের মতো ইয়াহিয়া খানের হারেমের ‘অন্তর্বাস দলের’ চারজন সুন্দরী নারীর ছবি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলো। তবে এই চারজন রমণীর ভাগ্যে যে পরিণাম এসেছিল পরবর্তীতে আরো যাদের ছবি প্রকাশ করা হলো যেমন চিত্রনায়িকা তারানা, কালো সুন্দরী, ম্যাডাম নুরজাহান, মিস দুরানি ও কোমল এদের ভাগ্যে তেমন খারাপ পরিণতি ডেকে আনল না। পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যমের দীর্ঘদিনের একটা তর্ক ছিল এমন যে কেন এই মহিলাদের নাম পাকিস্তানি মিডিয়াতে সর্বপ্রথম আসেনি এবং কেনই বা তাদের নিয়ে খুব হইহুল্লোড় হয়নি।

ইয়াহিয়া খানের হারেম জীবনে যে সমস্ত নারীর প্রভাব প্রতিপত্তি অপেক্ষাকৃত কম ছিল সম্ভবত তাদেরকে সর্বপ্রথম টেলিভিশনে প্রচার করতে লাহোর টেলিভিশনের কাছে কোনো অফিসিয়াল নির্দেশনা ছিল।

এই ধরনের নারীদের মধ্যে একজন ছিল শরিফান। সে ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিজীবনের সাথে জড়িত হওয়ার আগেই লাহোরে দেহব্যবসায় অত্যন্ত সুপরিচিত ছিল।

সৈনিকদের একটি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে শরিফান নাচতে আর গান করতে আসলে সেখানে তার সাথে ইয়াহিয়া খানের পরিচয় হয়। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার দুদিন পর ইয়াহিয়া খান তাকে করাচি গভর্নমেন্ট হাউসে দেখা করতে বলেন। একই সাথে শরিফানের ব্যবসায়িক কার্যালয় লাহোর থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।

শুধু তাই নয় ইয়াহিয়া খানের সাথে শরিফানের গভীর সম্পর্কের কারণে সে একটা উপাধি পেল। পদোন্নতি প্রত্যাশী সেনা অফিসার, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোকজন নিজেদের উন্নয়নের জন্য শরিফানকে ডাকত প্রপার চ্যানেল বলে। কারো কোনো ধারণাই ছিল না কীভাবে শরিফান তাদের বস্ ইয়াহিয়া খানকে নিয়ন্ত্রণ করে সবধরনের আবদার আদায় করে নিত।

পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]
পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]

তবে করাচিতে উচ্চবিত্ত সমাজে এমন একটা গল্প প্রচলিত ছিল যে শরিফান তার ক্রেতাদের কাছ থেকে যে কোনো ধরনের সুবিধা আদায়ের জন্য যেমন কোনো লাইসেন্স বা পদোন্নতির তদবিরের নির্দিষ্ট হারে উপঢৌকন গ্রহণ করত। এই ধরনের কাজে শরিফানের পারিশ্রমিক ছিল পঞ্চাশ হাজার রুপি থেকে শুরু করে এক লাক রুপি।

কিছু কিছু পাকিস্তানি সংবাদপত্র যেমন মুসাওয়াত, যেটা সে সময় পাকিস্তানি পিপলস পার্টির মুখপাত্র ছিল, তারা এমন রিপোর্ট প্রকাশ করে যে ইয়াহিয়া খান নির্দিষ্ট হারে শরিফানের এই ধরনের উৎকোচের উপর ভাগ বসাতেন। শরিফানকে তার আরো দুই ভাতিজা এই কাজে সাহায্য করত।

ইয়াহিয়া খানের লাম্পট্যের বিষয় নিয়ে নানা রকম গাল গল্প থাকলেও সম্পদ আহরণের প্রতি তার অন্ধ ভালোবাসা ও আসক্তির বিষয়ে তেমন কোনো গল্প প্রচলিত ছিল না। সুইস ব্যাংকে তার কোটি কোটি রুপি অবৈধভাবে জমা থাকার প্রমাণের পরেও সম্পদ আহরণে তার দুর্নীতির বিষয়ে খুব একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি।

তার সম্পদ আহরণের ও লাম্পট্য জীবনের আরেক কুখ্যাত চরিত্র ছিল পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী নুর বেগম। পাকিস্তানি উচ্চবিত্ত সমাজে যে চাচি নামে পরিচিত ছিল।

নুর বেগম একই সাথে ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলের সহযোগী হিসেবে শরিফানের সাথে কাজ করত এবং পদোন্নয়ন, লাইসেন্স দেয়া বিভিন্ন ধরনের সরকারি অনুমতি বিষয়ক তদবিরের কাজও সে করত। তবে তার মূল দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন টিভি মিডিয়ায় সংবাদ পাঠিকা আর উপস্থাপিকাদের উপর নজর রাখা। তাদের মধ্য থেকে আকর্ষণীয় উপস্থাপিকাদেরকে সে ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করত।

সেই সময় করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি শহরগুলোয় চটুল কথাবার্তা জারি ছিল এই উপস্থাপিকাদেরকে নিয়ে। বাবা মারা খুব অনিচ্ছায় তার সুন্দরী মেয়েদেরকে টিভি উপস্থাপিকা হিসেবে পাঠাত। এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছিল যে কোনো সুন্দরী উপস্থাপিকার কাছে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে ফোন আসার পর সেই মেয়ের বিষয়ে টিভি স্টুডিওতে আর কোনো খবর পাওয়া যেত না।

ইয়াহিয়া খানের নারী সঙ্গীদের মধ্যে তৃতীয় যে নারীকে নিয়ে লাহোর টেলিভিশন মাতামাতি করছিল তার নাম হলো ফেরদৌসি। এই নামে অবশ্য একজন পাকিস্তানি অভিনেত্রী আছে। তবে সে আর এই নারী ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। ফেরদৌসি তার অন্য দুজন সহকর্মীর মতো কাজ করত না। তার মূল দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্টকে দিয়ে যে সব উত্তপ্ত উন্মাতাল অনুষ্ঠান হতো সেই সমস্ত অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জন করা।

শুধু তাই নয় ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ এর মার্চ মাসে যখন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় যায় শেখ মুজিবের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করতে তখনো ফেরদৌসিকে সাথে নিয়ে যান।

 

Akleem Akhtar was a Pakistani woman who ran a brothel. She was President General Yahya Khan’s girlfriend, confidante & his main, sole advisor.
Akleem Akhtar was a Pakistani woman who ran a brothel. She was President General Yahya Khan’s girlfriend, confidante & his main, sole advisor.

 

পাকিস্তানি সাংবাদিকদের মতে ফেরদৌসি ছিল অত্যন্ত ধুরন্ধর আর নীতিভ্ৰষ্টা ডাইনি। তাকে বিদেশি শক্তিগুলো গোপনে নিয়োগ দিয়েছিল যাতে করে সে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার ইয়াহিয়া খান আর পূর্ব বাংলার শেখ মুজিবের সাথে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যেখান থেকে ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ সহজে বের হয়ে আসতে পারবেন না।

ফেরদৌসিকে নিয়ে আরো বড় রহস্যময় ষড়যন্ত্র হলো তাকে নিয়ে লাহোর টেলিভিশন যখন খুব মাতামাতি করছে আর সে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ঠিক তার দুই মাসের মধ্যেই ভোজভাজির মতো তাকে নিয়ে সমস্ত কানাঘুষা বাতাসে মিলিয়ে গেল।

১৯৭১ এর মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সিয়াল হারেমে ইয়াহিয়া খানের আনন্দময় জীবনের আরো দুজন নারী চরিত্র ছিল। রানি আর নুরজাহান। তবে ফেরদৌসির প্রভাবের কারণে তাদের নাম খুব ভালোভাবে উঠে আসতে পারেনি।

ফেরদৌসিকে নিয়ে আরেকটা ব্যাখ্যা এমন ছিল যে ইয়াহিয়া খানের পতনের পর ভুট্টোর আমলের সরকারের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। ফেরদৌসিকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে তাদের চরিত্রের অন্ধকার দিকও বের হয়ে আসবে- এই ভয়ে সরকারের ঊর্ধ্বমহল থেকে লাহোর টেলিভিশনকে চাপ দেয়া হয় যাতে করে ফেরদৌসিকে নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করা না হয়। মনে করা হয় এই গোপন নির্দেশের কারণেই ফেরদৌসিকে নিয়ে সব ধরনের আওয়াজ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

লাহোর টেলিভিশন চতুর্থ যে নারীটির কথা প্রচার করেছিল সে হলো কাউসার। তার বয়স তুলনামূলক কম ছিল। সে করাচি টিভি স্টেশনে ঘোষক হিসেবে কাজ করত। তার অনিন্দ রূপ সৌন্দর্যের জন্য প্রেসিডেন্ট তাকে খুব পছন্দ করতেন।

প্রায় সময়ই করাচি গভর্নমেন্ট হাউসে তাকে নিমন্ত্রণ করা হতো। ইয়াহিয়া খান নিজ হাতে তাকে অনেক দামি নেকলেস উপহার দিয়েছিলেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই মাস পূর্বে ১৯৭১ এর অক্টোবরে ইয়াহিয়া খান পর পর দুই রাত্রি কাউসারকে নিয়ে কারারানের একটি উপকূলীয় বিনোদন হাউসে কাটিয়েছিলেন।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের নাম জড়িয়ে আরো একটা মজার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে লাহোরের নৃত্য শিল্প গোষ্ঠী ও সংগীত শিল্পী গোষ্ঠী পৃথিবী সুপরিচিত পেশা সংগীত ও নৃত্যকে নিয়ে ইয়াহিয়া খানের মতো একজন দুশ্চরিত্রবানের সাথে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা এ জন্য সংবাদ মাধ্যমকেও দোষারোপ করছে এবং নিন্দা জানাচ্ছে।

পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]
পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]

বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে যেহেতু সংবাদ মাধ্যমগুলো ঢালাওভাবে নৃত্য শিল্পী আর দেহব্যবসায়ী রমণীদেরকে ইয়াহিয়া খানের সাথে জড়িত করে দায়ী করা হচ্ছিল তাই নৃত্য শিল্পী গোষ্ঠীর সেই প্রতিবাদ ও ব্যাখ্যায় লাহোরের প্রভাবশালী দেহব্যবসায়ী ইনায়েত বেগম বলে যে ইয়াহিয়া খানের চরিত্র স্খলনের মূল কারণ হিসেবে কেবল মোটা দাগে আমাদেরকেই দায়ী করা হয়। অথচ তার পতনের মূলে আমরা নই বরং তার পতনের মূলে ছিল ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও তাদের সুন্দরী কন্যারা যারা সব সময় ইয়াহিয়া খানকে মনোরঞ্জন করে বেড়াত।

তাদের এই প্রতিবাদ কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এদের মধ্যে উর্দু পত্রিকা হুররিয়াত ১৯৭১ এর ২৪ মার্চ সংখ্যায় উল্লেখ করে যে আমাদের এই পতনের জন্য গুটিকতক দেহব্যবসায়ী নারীকে জড়িয়ে ইয়াহিয়া খানের চরিত্রের যেই চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সেটা সত্যিকার অর্থেই বোকামি। আমাদের এই পতনের অন্যতম অংশীদার পত্রিকা মাধ্যম যারা এই কাজটা তিনমাস আগে থেকে শুরু করলে আমরা অনেক লাভবান হতাম। আমাদের পতনের জন্য মূল দায়ী এই তথাকথিত নারীরা নয় বরং আমাদের শাসন ব্যবস্থাই দায়ী।

দেশের পতনের জন্য ইয়াহিয়া খান নিশ্চিতভাবেই দায়ী এবং তার ব্যক্তি জীবনের পতন কোনোভাবে এড়ানো যাবে না। তার আশপাশে যে নারী আর পুরুষেরা ছিল তারাও প্রত্যেকেই উন্মাদ আর চরিত্রহীন লোভী লম্পট ছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মুহূর্তে তাদের নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব তত আমাদের উপকার। আমাদের সকলের জন্য সেটা মঙ্গল বয়ে আনবে।

আমাদেরকে এটা ভুললে চলবে না যে আমরাই এই শাসক আর তার চারপাশের মানুষগুলোকে নির্বাচিত করেছি আমাদের দেশটাকে শাসন আর ধ্বংস করার জন্য । এখন আমাদের উচিত আমাদের তিক্ত অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং এই শপথ নেয়া যে আমরা ভবিষ্যতে আর এই ধরনের কাজ কিছুতেই হতে দেব না।

পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]
পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]

বাস্তব দিক থেকে ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে অনেক যুক্তিপূর্ণ তথ্য থাকলেও অনেকে অবশ্য তার এই সমস্ত লাম্পট্য বিষয়ের ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেছেন। তবে ইয়াহিয়া খানের বিশ্বস্ত একজন সেনা কর্মকর্তা ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে সত্য ভাষণ দিয়েছে। তার নাম হলো জেনারেল রানি। সে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে দাবি করেছে যে ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় শরিফান ও নুর বেগম ছিল অত্যন্ত কাছের মানুষ। তারা ইয়াহিয়া খানের বিনোদনের বিষয়ে সব আয়োজন করত। শুধু তাই নয় এই দুজন নারী ইয়াহিয়া খানের ঘরের কাজের বিষয়েও দেখাশোনা করত এমনকি তারা প্রমোশনের বিষয়ে তদবির করার মূল চ্যানেল ছিল।

তবে ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিজীবনে টিভি মিডিয়া যেভাবে বলছে এই চার নারীই কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিল না। বরং তাদের সাথে আরো ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রীরা এবং সমাজের উচ্চ স্তরের নারীরা ছিল, তাদের ক্ষমতা ও দাপট এতটাই বেশি ছিল যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মিডিয়া কথা বলার সাহস করেনি।

নারী বিষয়ক ইয়াহিয়া খানের আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ছিল ১৯৭১ এর যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে নারী বিষয়ক জটিলতায় তিনি একবার কমান্ড হামলার শিকার হন এবং কাকতালীয়ভাবে সে আক্রমণ থেকে বেঁচে যান।

করাচির জঙ্গ নামের একটি পত্রিকা ১৯৭২ এর মার্চ সংখ্যায় এই বিষয়ে একটা প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে তারা উল্লেখ করে যে এটা পাকিস্তানের জন্য দুর্ভাগ্য ছিল যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ড আক্রমণে ইয়াহিয়া খান বেঁচে গিয়েছিলেন।

করাচি রেডিওর ধারাভাষ্যকার জনৈক অল্প বয়সী সুন্দরী তরুণীর প্রেমে ইয়াহিয়া খান একবার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৭১ এর শেষের দিকে। সেই সুন্দরীর মূল দেশ ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু তার বাবা মা কাজ করত করাচিতে। করাচির উচ্চবিত্ত সমাজে তাদের বেশ ভালো প্রভাব ছিল। ঘটনাক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু স্বাধীনতাকামী যুবকের সাথে তার বেশ সখ্যতা ছিল। তরুণদের এই দলটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একটা কমান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল।

তরুণদের এই দলটির প্রধান ছিল জাফর ইকবাল নামের এক যুবক। সে পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ছেলে ছিল। কাকতালীয়ভাবে সেই সময় করাচি রেডিওর সুন্দরী ধারাভাষ্যকারের সাথে তার পরিচয় হয়। সেই সুন্দরী তখন বেশ কয়েকবার গভর্নমেন্ট হাউসে যাতায়াত করেছিল।

সুন্দরী ধারাভাষ্যকার তখন ইয়াহিয়া খানকে গোপনে ছদ্মবেশে অন্য এক গোপন জায়গায় দেখা করার অনুমতি চাইল। ইয়াহিয়া খান রাজি হয়ে গেলেন এই প্রস্তাবে। এই ধরনের গোপন অভিসারে ছদ্মবেশে ইয়াহিয়া খান আরো বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন তার অন্যান্য বারবনিতাদের সাথে। ঠিক হলো রাত সাড়ে এগারোটায় তাদের দেখা হবে।

পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]
পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]

জাফর ইকবাল ও তার দুই বন্ধু মিলে ইয়াহিয়া খানের জন্য অপেক্ষারত তার বান্ধবীর নির্দিষ্ট ফ্লাটে গোপনে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সময় সেই সুন্দরী ধারাভাষ্যকারের আরেক ধনবান বন্ধু ঘরের দরজায় এসে শব্দ করে। সেই লোক আগেও বেশ কয়েকবার সুন্দরী বান্ধবীকে তার সাথে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিল। তো সেই লোক ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই লুকিয়ে থাকা তিন বাংলাদেশি মুক্তি ফৌজ অন্ধকারের মধ্যেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। যুদ্ধের সময় করাচিতে প্রায় সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ থাকত না। পুরো করাচি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যেত। একটু পরই যুবতির ঘরে ফোন আসে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে। তাকে বলা হয় বিশেষ সমস্যার কারণে ইয়াহিয়া খান আজকের প্রোগ্রাম বাতিল করেছেন।

করাচি পুলিশ তিন যুবককে গ্রেফতার করে এবং পুরো বিষয়টা গোপনীয়তার সাথে মিটমাট করে ফেলে। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আমি যতদূর শুনেছি (লেখক) জাফর ইকবাল ও তার ধারাভাষ্যকার বান্ধবী ও তার অন্য বন্ধুরা কারাগারেই বন্দী ছিল। এটা সত্যিই বেশ অবাক করা বিষয় যে ভুট্টো যে তিনজন যুবক পাকিস্তানের স্বৈরশাসককে হত্যা করে পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য ঘোচাতে চেয়েছিল সেই যুবকদেরকে মুক্তি দেয়াটা উপযুক্ত মনে করেননি। এর পরে অবশ্য তাদের বিষয়ে আর কিছু শোনা যায়নি। তাদেরকে কি বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করা হয়েছে নাকি অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে আর কিছুই জানা যায়নি।

তথ্যসূত্র:

বই : প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান

লেখক : দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ [ নির্মল পরিচ্ছন্ন অকপট ভাষায় এক দুঃসাহসিক কলমের অভিযান হলো ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ । ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার লেখনীর ভিতর দিয়ে একজন প্রাক্তন সামরিক স্বৈরশাসক, যৌনদানব, মাতাল, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলের অবিশ্বাস্য সব জানালা খুলে দিয়েছেন । সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে লেখালেখি করতেন । ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন সময় এবং এর পূর্বে ইয়াহিয়া খানের ভূমিকা, তার অন্ধকার জীবনের নানাদিক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে লেখক ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ বইটিতে লিখেছেন ।

অনুবাদ : রফিক হারিরি

আরও পড়ুন:

Leave a Comment