This post is also available in:
বাংলাদেশ
উত্থান আর পতন নামে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান বইটি তুলে ধরেছেন ইয়াহিয়ার চরিত্র। আমাদের এই মার্চে “পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ” এর অংশ হিসেবে তার অনুসন্ধানগুলো তুলে ধরা হবে। পাকিস্তান আমাদের দীর্ঘ ২৩ বছর শোষণ করেছে। তবে সেই শোষণ মূলত করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানি এলিট। তাই পাকিস্তানি শাসন-শোষণ এর চেহারা সম্পর্কে জানার জন্য এদের জীবনাচার সম্পর্কে জানা জরুরী। বইয়ে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সব রকম অন্যায়, অপরাধ। ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত জীবন দেখাতে গিয়ে উঠে এসেছে সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়। “উত্থান আর পতন” অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন :
উত্থান আর পতন:
পাঠান বংশের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত কাজিলবাশ পরিবারে আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের জন্ম। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুই শাখায় তার পড়াশোনার রেকর্ড ছিল বেশ ভালো। কাজিলবাশ পাঠানরা সমাজে এমন একটা উচ্চ সম্ভ্রান্ত কমিউনিটি তৈরি করতে পেরেছিল যাদের সাথে আফগানিস্তানের পশতু ভাষার সুন্নি সম্প্রদায় ও বিরোধী শিয়া সম্প্রদায় উভয়ের সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিল। কাজিলবাশদের জায়গা জমি ছিল না কিন্তু তারা পাঠান সমাজে বেশ ভালো অবস্থান তৈরি করেছিল।
![উত্থান আর পতন - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ] 2 উত্থান আর পতন - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ]](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/03/Pakistani-General-Yahya-Khan-পাকিস্তান-জেনারেল-ইয়াহিয়া-খান-47-300x169.jpg)
ইয়াহিয়া খানের বাবা পাঞ্জাব পুলিশে কাজ করতেন। তিনি লাহোর, অমৃতসার, লালপুর ও আম্বালাতে পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন । তার বাবা পুলিশে কাজ শুরু করেছিলেন একজন হেড কনস্টেবল হিসেবে আর পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
করাচির আখবারে জাহানের সম্পাদক পাকিস্তানির বিখ্যাত সাংবাদিক মাহমুদ শাম জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বাবার পুলিশে কাজ করার সময় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে নিয়ে এসেছিলেন।
ঘটনা ছিল এই রকম যে ১৯৩১ এর ২৭ মার্চ লাহোর কারাগারে ব্রিটিশ সৈন্যরা শহীদ ভাগত সিং, রাজ গুরু, আর সুখ দেবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। ব্রিটিশ সৈন্যরা পুরো ঘটনাটা অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে করতে চেয়েছিল। সেই রাতেই তিন দেশপ্রেমিকের লাশ ফিরোজপুরে ‘সুতলিজ নদীর তীরে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন সেনা অফিসাররা। সেই সময় ইয়াহিয়া 1 খানের বাবা পুলিশের সাব ইনসপেক্টার ছিলেন। এই কাজের জন্য তাকে ডাকা হলে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা আর গোপনীয়তার সাথে কাজটা সম্পন্ন করেন। তাকে পুরস্কার স্বরূপ সেই সময় খান সাহেব উপাধি দেয়া হয়। এবং একই সাথে তিনি পদোন্নতি লাভ করেন।
ইউনুস সাহেবের মতে ইয়াহিয়া খান সাদামাটা ছাত্র ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো থেকে নিজেকে সব সময় দূরে রাখতে পছন্দ করতেন। ইউনুস সাহেবের নেতৃত্বে যতগুলো আন্দোলন হয়েছিল তার একটিতেও ইয়াহিয়া খান অংশগ্রহণ করেননি। তবে ব্যক্তিগতভাবে ইয়াহিয়া খান নিজের পড়াশোনার বিষয়ে অনেক পরিশ্রমী ছিলেন আর কমিশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেছিলেন। সেই সময় মেয়েঘটিত কোনো অপকর্ম, মদ্য পান, সিগারেট খাওয়া অল্পবয়সের তরুণরা সাধারণত যা করে তার কোনোটার সাথেই ইয়াহিয়া খানের সম্পর্ক ছিল না।
১৯৩৯ সনে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর ইয়াহিয়া খান ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশনড অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। তার শিক্ষাগত রেকর্ড খুব ভালো না হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীর পরীক্ষাগুলোতে বেশ ভালো নম্বর পেয়েছিলেন। সেই সময় সেনাবাহিনীতে খুব কম সংখ্যক পাঠান গ্রাজুয়েট অফিসার ছিলেন। অধিকাংশ অফিসারের গ্রাজুয়েশন ছিল না এবং তারা র্যাঙ্ক থেকে কমিশন লাভ করেছিলেন। ফলে উচ্চতর পড়াশোনা থাকার কারণে ইয়াহিয়া খান বিশেষভাবে সম্মানিত ছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসারদের মাঝে।
দেশ ভাগের পর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান মিলিটারি হাইকমান্ডে নীল চোখের বালক হিসেবে কদর পেতে শুরু করেন। এই সময়ের ভেতর তিনি পর পর দুবার জেনারেল আইয়ুবের সাথে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৯-৫০ সনে তিনি জেনারেল আইয়ুবের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানে বন্যার্তদের সাহায্য প্রকল্পে দারুণ সফলতার সাথে কাজ করেন। একই সাথে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে চোরাকারবারি ঠেকাতেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন।
জেনারেল আইয়ুবের বিশেষ নির্দেশে ১৯৫১ সনে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান আর্মিতে অল্প বয়সে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৫৮ সনে মার্শাল ল জারি হওয়ার পর আইয়ুব খান যখন পরবর্তী এগারো বছরের জন্য পাকিস্তানি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন তখন থেকে ইয়াহিয়া খান খুব ভালো কিছু করতে পারেননি যা তার সুখ্যাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তবে এই সময় ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে অর্জন ছিল ইসলামাবাদকে পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্পে সফলতা। হুবহু চণ্ডিগড় শহরের মতো গড়ে তোলা পাকিস্তানের রাজধানীর সিংহ ভাগ কৃতিত্বটুকু চলে যায় ইয়াহিয়া খানের ঝুড়িতে।
একজন ভারতীয় কূটনীতিক যিনি সেই সময় পাকিস্তানের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন তার মতে- পণ্ডিত নেহরু যখন চণ্ডিগড় শহরের উন্নতি চাকচিক্য নিয়ে কথা বলতেন তখন সেটা ইয়াহিয়া খানের পছন্দ হতো না। তিনি নেহরুকে হিংসা করতেন। এমনকি এই বিষয় কথা উঠলে তিনি মাঝে মধ্যে নিজের উত্তাপ ধরে রাখতে পারতেন না। একদিন ইয়াহিয়া খান রাগ করে বলেই ফেললেন যে দুই বছরের মধ্যে চণ্ডিগড়ের চেয়ে আরো উন্নত আর সুন্দর একটা রাজধানী তিনি তৈরি করবেন।
রাজধানী তৈরির সমস্ত পরিকল্পনা আগে থেকেই তৈরি ছিল। এর পর এই প্রকল্পের প্রধান প্রশাসক হিসেবে যখন ইয়াহিয়া খানকে নির্বাচিত করা হলো তখন তিনি পুনরায় নিজের সুখ্যাতি নিয়ে আবির্ভূত হলেন। অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি এই প্রকল্পটা বাস্তবায়ন করেন।
ইয়াহিয়া খানের হাত দিয়ে সেই সময় কোটি কোটি টাকার প্রকল্প আর চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই সময় তার বিরুদ্ধে একটি টাকা চুরির কিংবা অন্য কোনোধরনের দুর্নীতির ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তিনি ইসলামাবাদকে রাজধানী করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন। তার সাথে যারা কাজ করেছিল তাদের প্রত্যেককেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তিনি সূর্য ওঠার সাথে সাথেই নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সমস্ত কাজের তদারকি করতেন যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর সমস্ত কার্যক্রম যেন শেষ হয়।
পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সমাজে কেউ মিশলেই বুঝতে পারত এই সমস্ত সামরিক কর্মকর্তাদের প্রায় প্রত্যেকেই একাধিক বিয়ের সাথে জড়িত ছিলেন। আর সেই বিয়ের সময়কালও ছিল খুব কম- দুই থেকে চার
বছরের মধ্যে । একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের জরিপে দেখা যায় যে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি জেনারেলদের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল বৈবাহিক ক্ষেত্রে।
পাকিস্তানি আর্মির দুই ডজনেরও বেশি সেনাকর্মকর্তার এই ধরনের কুখ্যাতি ছিল। এদের মধ্যে ষোলোজন বিয়ে করেছিলেন দুইবার আর ছয়জন বিয়ে করেছিলেন পাঁচবারের বেশি। অবশ্য এই সময় চিফ অব কমান্ড আইয়ুব খান এই ধরনের বদনাম থেকে দূরে ছিলেন। শুধু তাই না আরো গুটিকতক সেনা অফিসারদের মধ্যে এই সময় ইয়াহিয়া খান আর টিক্কা খানও ছিলেন। তারা সেই সময় অবশ্য তত বড় সেনা অফিসার হয়ে উঠেননি।
পাকিস্তানের একজন সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে সেই সময় জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সামরিক অফিসারদের ক্লাব বারে রাত আটটার পরে দেখা যেত না। আটটা পর্যন্ত তিনি হয়তো অন্য অফিসারদের সাথে টুকটাক পান করতেন। তারপর আটটা বাজলেই পরিবারের লোকজনের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য চলে যেতেন। তার স্ত্রী যে তার মায়ের দিক থেকে খালাতো বোন ছিল তিনিও কখনো সেই সময় ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। অন্য সেনা অফিসারদের যেমন অন্য অফিসারদের স্ত্রীদের প্রতি আসক্তিজনিত বদনাম বা অভিযোগ থাকে সেই রকম কোনো অভিযোগ তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে কখনো করেননি।
একজন আমেরিকান পর্যবেক্ষক-লেখক পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের বিষয়ে গবেষণামূলক একটা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের বদনামের সময়গুলোতে ইয়াহিয়া খানকে পাওয়া গিয়েছিল। অত্যন্ত আদর্শবাদী একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি নিজের দায়িত্বে অত্যন্ত মনোযোগী আর কাজ অন্তপ্রাণ ছিলেন। একজন মুসলিম সেনাকর্মকর্তা হিসেবে যেমনটা ভাবা হতো তিনি ছিলেন তার সমার্থক। রোজার মাসে তিনি রোজা থাকতেন, সারা মাস সব ধরনের পানীয় থেকে দূরে থাকতেন।
ভারতের সাথে পাকিস্তানের ১৯৬৫ এর যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ইয়াহিয়া খান তার জীবনের সেরা সফলতাটুকু অর্জন করেন। এই যুদ্ধের বীরত্বের কারণে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে প্রশংসা কুড়ান। এক অনুষ্ঠানে আইয়ুব খান তখন ইয়াহিয়া খানকে হিলালে জুরাত (ক্রিসেন্ট অব ভেলর) উপাধি দেন। এই উপাধিটি তখন হাতে গোনা অল্প কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে দেয়া হয়েছিল।
অবশ্য পাকিস্তানের সাথে ভারতের এই যুদ্ধের সময়ই ভুট্টোর সাথে ইয়াহিয়া খানের এক ধরনের হিসেব নিকেশ শুরু হয়। ভুট্টো তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক সব কিছু দেখা শোনা করতেন। এই সময়ই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ মনোনীত হন। ভুট্টো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইস্তফা দেন। তিনি তখন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় নেতা। জনরোষ ফুঁসে উঠছিল তখন আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে। এই রকম পরিস্থিতিরে আইয়ুব খান তার কমান্ডার ইন চিফ ইয়াহিয়া খানের উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন।
ইয়াহিয়া খানের কট্টর সমালোচক এয়ার মার্শাল আসগর খান লাহোরের মাশরিক পত্রিকায় ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করে বলেন যে ১৯৬৯ এর সময় পাকিস্তানে যখন তীব্র জনরোষ আর বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তখন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
একটা প্রসিদ্ধ গল্প চালু আছে যে ১৯৬৮ এর প্রথম দিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোকে বলেছিলেন যে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনী জনতার সমস্যা সমাধানে এবং তাদেরকে একটা গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান করতে পূর্ণ প্রস্তুত। সাধারণ জনতার নেতারা অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতারা যদি জনতাকে নিয়ে সেরকম কোনো পরিস্থিতি কিংবা মঞ্চ তৈরি করতে পারেন তাহলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদেরকে আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত।
এই কথা বলে ইয়াহিয়া খান অবশ্য ভুট্টোকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো সেটা গ্রহণ করেননি। কারণ তার মতে এই রকম কোনো গণঅভ্যুত্থানের জন্য সেই সময়টা পরিপক্ক হয়নি।
মর্নিং নিউজের সম্পাদক জেড এ সুলুরি যার একই সাথে আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের সাথে সুসম্পর্ক ছিল এবং যিনি ইয়াহিয়া খানের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় এক সাংবাদিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের প্রথম ছয় মাস তিনি একদম পরিচ্ছন্ন ছিলেন। তার চরিত্রের রেকর্ড প্রথমদিকের মতোই অটুট ছিল। তবে পরিস্থিতি যত ঘোলাটে হতে শুরু করে এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে শুরু করে তখন রাজনৈতিক বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার দুর্বলতা, অদূরদর্শিতা সার্বিকভাবে এক জটিল পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিক গতিতে মদ আর নারী তার চরিত্রে ঢুকে যেতে শুরু করে। তিনি এতেই জটিল সময়গুলোতে আস্থা পেতে শুরু করেন। মদ আর নারী সব কিছুর উপর কর্তৃত্ব করা শুরু করে।
আমাকে পাকিস্তানের একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি আমাকে এই কথাগুলো বলেছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ইয়াহিয়া খান যখন কমান্ডার ইন চিফ অব দ্য আর্মি ছিলেন তখনও তিনি তার সাথে কাজ করেছেন। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা এই সেনাকর্মকর্তার ছিল। আমাকে তথ্যদাতা এই সেনাকর্মকর্তা অত্যন্ত ধার্মিক আর কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তিনি জীবনে মদ পান করেননি এমনকি কখনো সিগারেট খাননি। ইয়াহিয়া খানের নৈতিক পরিবর্তনের কারণ কী এই সম্পর্কে তিনি বলেন যে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ইয়াহিয়া খানের পতনের পেছনে অত্যন্ত শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র কাজ করেছিল।
আমার এই ধার্মিক সেনা অফিসার বলেন যে ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন তখন থেকেই একদল সুযোগ সন্ধানী লোক ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার সুযোগ গ্রহণ করতে থাকে। একই সাথে ভারতীয় রাশিয়ান চক্রও ইয়াহিয়া খানের বুদ্ধিগত বিষয়টাকে পরাস্ত করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
আমি তাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ বিষয়টা জানার পরেও কেন সেটা ইয়াহিয়া খানের গোচরে আনেনি? উত্তরে তিনি বলেন যে আল্লাহ যখন কাউকে ধ্বংস করতে চান তখন তাকে অন্ধ করে দেন।
পাকিস্তানের দুই তরুণ সাংবাদিক ইশতিয়াক আহমেদ ও শাহিদ সুলেমান বলেন যে ১৯৭০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান তার পূর্বের চরিত্রের মতোই সৎ ছিলেন। কিন্তু ‘৭০ এর নির্বাচনের পর সব কিছু পাল্টে গেল। ইয়াহিয়া খানের আর্মি ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ তাকে নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ দিতে ব্যর্থ হয়। তাদের হিসেব অনুযায়ী পশ্চিমে ভুট্টো ও পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান আশানুরূপ তেমন কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু নির্বাচনের পর তার হিসেব হলো উল্টো।
এই নির্বাচনের কারণে ইয়াহিয়া খানের একনায়ক হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। এই রকম উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতিতে নিজের হতাশা থেকে বের হয়ে আসার জন্য তিনি মদ পানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সুযোগবুঝে এই সময় সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সেনাকর্মকর্তারা তাদের স্ত্রী বান্ধবী কন্যাদেরকে নিয়ে ইয়াহিয়া খানের চারপাশে ভিড় করতে থাকেন। ইয়াহিয়া খান সেই সুযোগটা গ্রহণ করেন।
শাসকগোষ্ঠীর পরিবারের খুব কাছাকাছি আরেকজন মহিলা সাংবাদিক বলেন যে ১৯৭১ এর শুরুর দিকে বেগম ইয়াহিয়ার সাথে ইয়াহিয়া খানের সম্পর্কটা একদম স্বাদহীন আন্তরিকতাশূন্য হয়ে পড়ে। বেগম ইয়াহিয়া অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা ছিলেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর মধ্যবয়স্ক ইয়াহিয়া খানের শারীরিক চাহিদার ঠিক মতো সাড়া তিনি দিতে পারছিলেন না বলে ইয়াহিয়া খানের মধ্যেও একরকম হতাশা আর বিরক্তি চলে আসে। ফলে ইয়াহিয়া খানের মতো একটা শক্ত চরিত্র যখন একবার বিগড়ে যায় তখন আর ফিরে আসার সুযোগ থাকে না।
সমস্ত ব্যাখ্যার আড়ালে ইয়াহিয়া খান ছিলেন একজন ট্রাজিক হিরো। আধুনিক যুগের কিং লিয়ার যিনি নিজের রাজনৈতিক অদক্ষতা, নারী আর মদের লোভের কারণে একই সাথে ভিলেনও ছিলেন। তিনি শুধু নিজের ধ্বংসই নয় বরং একই সাথে পাকিস্তানের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই ধ্বংসের কাহিনি এক এক করে চলুন দেখা যাক।
তথ্যসূত্র:
বই : প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান
লেখক : দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ [ নির্মল পরিচ্ছন্ন অকপট ভাষায় এক দুঃসাহসিক কলমের অভিযান হলো ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ । ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার লেখনীর ভিতর দিয়ে একজন প্রাক্তন সামরিক স্বৈরশাসক, যৌনদানব, মাতাল, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলের অবিশ্বাস্য সব জানালা খুলে দিয়েছেন । সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে লেখালেখি করতেন । ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন সময় এবং এর পূর্বে ইয়াহিয়া খানের ভূমিকা, তার অন্ধকার জীবনের নানাদিক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে লেখক ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ বইটিতে লিখেছেন ।
অনুবাদ : রফিক হারিরি
আরও পড়ুন:
- শয়তানের নৃত্য – জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ]
- খুলে গেল সূর্যতোরণ : শেরপুরবাসীর ঘরে ঘরে আলোর পরশ
- বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস কাল
- প্রধানমন্ত্রী: কেউ যেন কষ্ট না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে
- বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ছয় দফা আন্দোলন ছিল ‘ম্যাগনা কার্টা’
- কাল সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন
This post is also available in:
বাংলাদেশ