একুশের ভাবনা [ Ekusher Bhabna ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : দুটো বহুলপ্রচলিত জনপ্রিয় আপ্তবাক্যের পুনর্বিবেচনা দরকার এবং যেগুলো লোকশ্রুত আস্থার দুর্গে আঘাত হানার জন্যে জরুরি। এর একটি হচ্ছে ‘ঐতিহ্য প্রেরণার উৎস এবং অপরটি হচ্ছে ‘ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়’।
ঐতিহ্য যদি প্রেরণা যোগাত তাহলে গ্রিস-রোম-ব্যাবিলন-মিশর-ইরানের কখনো পতন হত না, কিংবা এতিহ্যবিরহী কোনো নতুন দেশ-জাত-পরিবারের নবোখান সম্ভব হত না। ব্যক্তি-পরিবার-দেশ-জাত-বর্ণ কারো সম্পর্কেই উক্ত আপ্তবাক্য কখনো সাধারণভাবেও সত্য হয়নি। জীবন-জীবিকার তাগিদেই জ্ঞান-বুদ্ধি-উদ্যম-রুচি আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতির সুপ্রয়োগ-বাঞ্ছাই মানুষকে জিগীষু করে এবং সেই জিগীষাজাত নিষ্ঠা ও কর্মোদ্যমই এমন এক অমোঘ সামর্থ্য দান করে যা অদম্য, অজেয় এবং উদ্দিষ্ট ফলপ্রসূ। এ যখন যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতের মধ্যে জাগে, তখন জীবন-জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনে আবিষ্কারে, ভাবে চিন্তায়-কর্মে তার বিচিত্র বিকাশ বিস্তার সম্ভব হয় এবং তা-ই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক বলে সবাই মানে।
ইতিহাসও প্রেরণার উৎস নয় এবং ইতিহাস কখনো পুররাবৃত্ত হয় না, হয়নি। ঘটনা ও পরিণামের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জন্যে নয়, বরং তা এড়াবার জন্যেই ইতিহাসের শিক্ষা তথা ইতিহাস-চেতনা প্রয়োজন। ইতিহাস রচনার ও পাঠের সার্থকতা এখানেই – এই তাৎপর্যেই ইতিহাস প্রজ্ঞার আকর। ইতিহাস চেতনা জীবন, ঘটনা ও পরিণামের আবর্তন কামনা করে না, বিবর্তন ও অগ্রগতিই বাঞ্ছা করে। মানুষের প্রবৃত্তিগত ও জীবিকাগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলানুসন্ধিৎসা এবং মনুষ্যস্বভাবের সংযমণ ও উৎকর্ষসাধনের উপায় উদ্ভাবন লক্ষ্যেই ইতিহাস রচনা-পাঠের সার্থকতা।
ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, দৈশিক, রাষ্ট্রিক কিংবা জাতিক জীবনে ঐতিহ্য কোনটি? অতীতের সব কর্মপ্রচেষ্টাই ঐতিহ্য নয়। কেবল সাফল্যের সম্মানের, গৌরবের ও গর্বের অংশটুকই ঐতিহ্য। এর মধ্যেই রয়েছে আত্মপ্রবঞ্চনার ও আত্মদর্শন-ভীতির বীজ। জীবনের লজ্জার অংশ গোপন রেখে গৌরবের অংশ উচ্চকণ্ঠে প্রচারকে আমরা স্বাভাবিক বলেই জানি ও মানি বটে; কিন্তু এর মধ্যে চারিত্রিক দৌর্বল্য ও সামান্যতা আছে। এ ফাঁকিতে ফাঁক পূরণ হয় না। তাই সাধারণত ঐতিহ্যগর্বের রোমন্থন পরিণামে দুর্বলতার, নিষ্ক্রিয়তার ও ক্ষয়িষ্ণুতার পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। পিতৃধনের ক্ষয় আছে, বৃদ্ধি নেই। পিতৃগৌরবেরও তেমনি জীর্ণতা থাকে, অনুপ্রাণিত করবার শক্তি।
থাকে না। কারণ অনবরত পুনরাবৃত্ত হয়ে তা প্রভাবিত করার শক্তি হারায়। তাই তা দুর্বল, অসমর্থ ও অলস উত্তর-পুরুষের নিষ্ফল দাম্ভিকতার অবলম্বনরূপে, আত্মসম্মান রক্ষার হাস্যকর ভিতরূপে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যকে প্রেরণার আকর হিসেবে ঔজ্জ্বল্য ও গুরুত্ব দেয়ার জন্য ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করতে যেয়ে মানুষ কেবল আত্মস্বার্থে ও স্বপ্রয়োজনে তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছে আর কামনা করেছে। ঘটনার ও পরিণামের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু তাদের সে-বাঞ্ছা কোনোদিন সিদ্ধ হয়নি। হবার নয় বলেই হয়নি।
২১শে ফেব্রুয়ারী ছিল বিদেশী-বিভাষী শোষক-শাসকের প্রতি আমাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের, আত্মবোধন ও স্বজনের সংহতি কামনার দিন। আজ পরিবর্তিত পরিবেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের কার বিরুদ্ধে উত্তেজনা দেবে? কোন সংগ্রামে প্রবর্তনা দেবে? ব্রিটিশ আমলে পলাশী যুদ্ধ আমাদের দেশপ্রেম ও সংগ্রামী চেতনার উৎস ছিল। আজ পলাশী যুদ্ধ ইতিহাসের অসংখ্য যুদ্ধের একটিমাত্র। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সাড়ে তেরোশো বছর আগেকার কারবালা যুদ্ধ আজ মুসলমানদের কাছে একটা বার্ষিক পর্ব ও তাৎপর্যহীন আচার মাত্র।
জীবন বর্তমানেরই নামান্তর। কেননা জীবনের সব চাহিদাই সাময়িক। ব্যক্তি মানুষেরও শৈশব-বাল্য-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্যের চাহিদা অভিন্ন থাকে না। অতীত মাত্রই উপযোগ হারায়, আর ভবিষ্যৎ জাগায় প্রত্যাশা। অতীতকে পিছে ফেলে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা রেখে বর্তমানের প্রতিবেশে শারীর ও মানস বাঁচাই হচ্ছে জীবন। অতীতকে ধরে রাখা মানেই হচ্ছে বর্তমানকে অবহেলা করা ও ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করা। যে পিছনে তাকায় সে সুমুখ-দৃষ্টি হারায়। পিছু তাকাতে হলে দাঁড়াতে হয়, দেহ ফিরাতে হয়, সুমুখগতি স্তব্ধ হয়।
‘২১শে ফেব্রুয়ারি পর্ব’ উদযাপনে আমাদের আগ্রহ-উৎসাহ যত প্রবল থাকবে, সে পরিণামেই আমাদের মানস-বন্ধ্যাত্ব, উদ্যমহীনতা ও আকাঙ্ক্ষাহীনতা প্রকট হয়ে উঠবে। একে মুহররমের মতো এবং শহীদ মিনারকে ইমাম-বারার মতো করে তোলার মধ্যে নতুন চিন্তা-চেতনা ও কর্ম-পরিকল্পনার অভাবই পরিলক্ষিত হবে। ইতিমধ্যেই অবশ্য শহীদ মিনারের গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বাহান্নের চেয়ে একাত্তরের শহীদরা সরকারি সম্মানের বেশি দাবিদার বলে স্বীকৃত হয়েছে। এ-ই নিয়ম ও স্বাভাবিক। বেদনাদায়ক হলেও এ সত্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি চিরকাল এমনি উৎসাহে উদযাপন করবার মতো মন সঙ্গতকারণেই থাকবে না। প্রবহমান জীবনে আরো দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষের হাজারো সামাজিক, আর্থিক, রাষ্ট্রিক, আন্তর্জাতিক কারণ ঘটবে।
তাই নিয়ে আমরা বিচলিত, ক্ষুব্ধ, মত্ত ও সংগ্রামরত থাকব। চলমান জীবনে নিত্য-নতুন পথের বাধা অতিক্রম করে করে এগুতে হয়—পাথেয় সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য ভাব-ভাবনার প্রয়োজন হয় জীবন-জীবিকার সামগ্রিক বিকাশ-বিস্তার এভাবেই হয় সম্ভব। গতিই জীবন, স্থিতি জড়তা ও জীর্ণতার শিকার। তাই জীবনেরই তাগিদে প্রত্যাশা নিয়ে নতুন কিছু আগে ভাবার, আগে বলার, আগে করার লোক দরকার। সে-লোক আসে বুদ্ধিজীবীশ্রেণী থেকেই। তারা হুজুগের দাস নয়, নতুন হুজুগের স্রষ্টা। ঐতিহ্য ও ইতিহাস তাদের কাছে উৎসব-পার্বণের বিষয় নয়, প্রজ্ঞাদৃষ্টিলাভের সহায়ক মাত্র। এ দৃষ্টিলাভের জন্য অতীতের লজ্জা-গৌরব দুটোই সমগুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে হিতবাদী ও হিতকামী করতে হলে ভালো-মন্দ, লজ্জা-গৌরব দুটোই স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। সত্য ও সৎদৃষ্টি এভাবেই লভ্য। আত্মপ্রত্যয় আসে নিজের শক্তি ও দুর্বলতার সমন্বিত পরিমাপ-চেতনা থেকেই। তাহলেই সতর্ক প্রয়াসে অভীষ্টসিদ্ধি সম্ভব।
বুদ্ধিজীবীর বন্ধ্যা নেতৃত্বই মানুষকে কেবল ভাব-চিন্তা-কর্ম ও পার্বণের আবর্তনে তৃপ্ত রাখে। বন্ধ্যাত্বের সাধারণ নাম রক্ষণশীলতা। সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী নেতৃত্ব নতুন ভাব চিন্তা-কর্মে দীক্ষা ও দিশা দেয়। প্রচারণার মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারির পার্বণিক পালনে উৎসাহ-উদ্দীপনা দানের ফলে যে কৃত্রিম দায়িত্ব-চেতনা লোকমনে সঞ্চার করা হয়, তা কোনো শ্রেয়সে উত্তরণ ঘটায় না। বরং স্বতস্ফূর্তভাবে যারা যতটুকুই এই দিনটি স্মরণ করে, ততটুকুই খাঁটি এবং ব্যক্তিক বা সামাজিক জীবনে আত্ম-বোধনের ও হিত চেতনার সহায়ক। প্রবহমান জীবনে নিত্যনতুন চলার পথে সমস্যা ও যন্ত্রণা এড়িয়ে কেবল সম্পদ ও আনন্দ আহরণ করা যায় না। বস্তুত সমস্যা আছে বলেই সম্পদের প্রয়োজন, যন্ত্রণা-মুক্তির জন্যই আনন্দের আয়োজন।
জ্ঞানী-গুণী-প্রাজ্ঞ মনীষী বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে বর্তমান ও সম্ভাব্য ব্যক্তিক, নৈতিক, আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক সম্পদ ও সমস্যা, আনন্দ ও যন্ত্রণা সম্পর্কে সতর্ক সচেতন করে দেয়া, দায়িত্ব ও কর্তব্যবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা, শোষণ-পেষণ-পীড়ন প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রেরণা দেয়া, শ্রেয়বোধ জাগিয়ে, হিতচেতনা দিয়ে পাপ ও পীড়ন থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা। পুরাতনের রোমন্থনে এ কখনো সম্ভব নয়, কেবল নব-নব উদ্ভাবনে ও আবিষ্কারেই সম্ভব। সমকালীন প্রতিবেশে প্রয়োজনানুগ সম্পদ সৃষ্টির ও সমস্যা বিনষ্টির, আনন্দবৃদ্ধির ও যন্ত্রণামুক্তির উপযোগী নতুন ভাব চিন্তা-কর্ম ও বিবেক সৃষ্টিই বৃদ্ধিজীবীর দায়িত্ব। এভাবেই গণমনে প্রত্যাশা ও উদ্যম জাগে—তখন প্রাণে জাগে প্রেম, চিত্ত হয় হেম, দিল হয় দরিয়া, প্রিয়া হয় পৃথিবী, জীবন হয় ঐশ্বর্য।
কিন্তু জ্ঞানী যদি গুণী না হয়, বুদ্ধিমান যদি ধূর্ত হয়, জ্ঞান যদি প্রজ্ঞায় পরিণতি না পায়, বৃদ্ধিজীবী যদি সমাজের বিবেকের দায়িত্ব ও দেশের মঙ্গলের প্রতিরক্ষীর ভূমিকা পালন না করে, তাহলে বাবিস্তার বাচালতায়, কর্মপ্রচেষ্টা ব্যক্তিক ও দলীয় স্বার্থপরতায় বিকৃতি পায়। বুদ্ধিজীবীর পরিচয় তার চিন্তা-কর্মের অনন্যতায়, নতুনত্বে ও শ্রেয়স্করতায়। ফেরুস্বভাব বুদ্ধিজীবীতে অভাবিত। যদি নতুন কিছু ভাবা কিংবা করা সম্ভব না-ই হয়, তাহলে অন্তত ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আজকের এই মুহূর্তের চলতি শোষণ-পীড়ন, অন্যায়-অশুভ, অভাব-আপদের প্রতিকার, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ বা প্রতিশোধ দিবসরূপে উদযাপন করাই বাঞ্ছনীয়।
[ একুশের ভাবনা – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন:
- সাহিত্যের বিবর্তন – আহমদ শরীফ
- আহমদ শরীফ
- –
- শহীদ শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী আগামীকাল
- ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হবে না ’ – ব্যাংকক পোস্টের প্রতিবেদন
- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে বিএনপির মিথ্যাচার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার অপপ্রয়াস মাত্র : ওবায়দুল কাদের
- দেশবাসীর প্রতি ওবায়দুল কাদেরের আহ্বান সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূদের অপপ্রচারে যেন বিভ্রান্ত না হয়