This post is also available in:
বাংলাদেশ
খুলনা জেলার কিংবদন্তি [ Legends of Khulna District ] : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীন কোনো জলাশয়, বয়সী বৃক্ষ, ভগ্ন প্রাসাদ কিংবা ধর্মীয় পীঠস্থানকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে নানারকম জনশ্রুতি, যেগুলো মূলত কিংবদন্তি নামে আখ্যায়িত। খুলনা অঞ্চলেও আমরা বেশ কিছু জলাশয়, মন্দির, পুরনো বাড়ি নিয়ে কিছু কিংবদন্তির সন্ধান পেয়েছি। নিম্নে সেগুলো প্রদান করা হলো :
![খুলনা জেলার কিংবদন্তি, যত সব আশ্চর্য ঘটনা [ Legends of Khulna District ] 2 খুলনা জেলার কিংবদন্তি, Khulna District Logo, খুলনা জেলার লোগো, বাঘের গর্জন, সমৃদ্ধি ও অর্জন](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/01/Khulna-District-Logo-খুলনা-বিভাগের-লোগো-বাঘের-গর্জন-সমৃদ্ধি-ও-অর্জন-150x150.jpg)
Table of Contents
খুলনা জেলার কিংবদন্তি
১. পির খানজাহান আলী, পিরালী মুসলিম
পির খানজাহান আলীর অবস্থান কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় ব্যক্তির ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সংক্রান্ত একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দক্ষিণ ডিহিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের রায় চৌধুরী পরিবার বরাবর সমৃদ্ধশালী ছিল। চৌধুরী পরিবারের দক্ষিণা নাথের চারপুত্র ছিল। তার দুই পুত্র কামদের এবং জয়দেব খানজাহান আলীর প্রধান কর্মাধ্যক্ষ হন।
প্রভাবশালী আর এক ব্রাহ্মণ খানজাহান আলীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মহম্মদ তাহের নাম ধারণ করেন। অতঃপর খানজাহান আলী মহম্মদ তাহেরকে কসবার উজির পদে অধিষ্ঠিত করেন। কামদের এবং জয়দেব মহম্মদ তাহেরের অধীনস্থ হন।
একদা রোজার দিনে মহম্মদ তাহের এবং কামদেব জয়দেব এবং অন্যান্য কর্মচারী একত্রে বসে আছেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে সুগন্ধি একটা কমলা তাদেরকে উপহার দিলেন। রোজা অবস্থায় নব মুসলিম তাহের উহার ঘ্রাণ নিতে ছিলেন। এমন সময় কামদেব বললেন, ‘হুজুর, ঘ্রাণেন অর্দ্ধভোজনং’ (ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন)। রোজা যে ভেঙ্গে গেল।
কামদেবের এ ব্যবহারে তাহের মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেন এবং একদিন সকলকে একত্রে বসিয়ে উগ্র মসলা সংযোগে তাহের গো-মাংস রন্ধনের ব্যবস্থা করলেন। মাংসের ঘ্রাণে কামদেবসহ অনেকে নাকে কাপড় দিলেন। তখন তাহের বললেন, ‘ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন।’ অর্থাৎ তোমাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। এভাবে ঐ সময় কামদেব, জয়দেব এবং আরও অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
![খুলনা জেলার কিংবদন্তি, যত সব আশ্চর্য ঘটনা [ Legends of Khulna District ] 3 হযরত খানজাহান আলি রাহ এর মাজার ভবন, বাগেরহাট](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/01/হযরত-খানজাহান-আলি-রাহ-এর-মাজার-ভবন-বাগেরহাট-300x200.jpg)
পরবর্তীকালে আদর্শ এবং ঘটনাক্রমে সনাতন ধর্মের প্রচুর লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী হন। এবং এ অবস্থার ফলে অনেক হিন্দু ব্যক্তি সমাজচ্যুত হন। পির ধর্মের প্রতীক এবং আলী শক্তির প্রতীক। পির খান জাহান আলীর আদর্শে অনুপ্রাণিত বিধায় এই সকল নব্য মুসলিমদের পিরা আলী বা পিরালী মুসলিম বলা হয়।
খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে পিরালী মুসলিম সম্প্রদায় বাস করেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের পতনের পর ১৪০০ ব্রাহ্মণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলিমদের সাথে সংশ্রবের কারণে যে সমস্ত হিন্দু সমাজচ্যুত হন তারা পিরালী ব্রাহ্মণ, পিরালী কায়স্থ, পিরালী নাপিত ইত্যাদি খেতাবে অধিষ্ঠিত আছেন।
২. দীঘলিয়া উপজেলার লাল খাঁর দিঘি, সরকার ঝি দিঘি
খুলনা জেলার দীঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রামে বৃহৎ একটি জলাধারকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একটি কিংবদন্তি। যে কিংবদন্তির কারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে এই পুকুরটি লাল খাঁর দিঘি বা সরকার ঝি দিঘি নামে পরিচিত।
সপ্তদশ শতাব্দীর ‘বাঙ্গালাদেশ’-এর ‘যশোহর জেলার একটি সমৃদ্ধ জনপদ সেনহাটী। যশোহরে তখন নূর উল্লাহ খাঁ নামে একজন ফৌজদার ছিলেন। তার অবস্থান ছিল মির্জানগরে। নূর উল্লাহ খাঁর সৈন্যসামন্ত তদারক করার দায়িত্ব ছিল তার জামাতা লাল খাঁর উপর। অল্প বয়সে হাতে ক্ষমতা পেলে যা হয়- লাল খাঁর চরিত্রে নানারকম স্খলন শুরু হয়।
মনোরঞ্জনের জন্য তার নিত্য নতুন রূপসী নারীসঙ্গ চাই এবং তা জুটেও যেত তার আজ্ঞাবাহী অনুচরদের সহায়তায়। তখন লাল খাঁর হিসেবনবীশ হিসেবে কাজ করতেন রাজারাম সরকার। যিনি ছিলেন সেনহাটীর মানুষ। তার ছিল সুন্দরী নামে পরমাসুন্দরী এক বাল্যবিধবা কন্যা। লাল খাঁর অনুচরদের দৃষ্টি পড়ল তার উপর।
কথাটি লাল খাঁর কানে যেতেই তিনি অতি উৎসাহে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। অনুচরদের একজন রাজারামের কাছে প্রস্তাব পাঠালো। লাল বা তার সবরকম সুখসুবিধের ব্যবস্থা করবেন যদি রাজারাম লাল খাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়। বৃদ্ধ রাজারাম এ প্রস্তাব শুনে ক্ষোভে দুঃখে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হিসেবের খাতাপত্র ফেলে উঠে। দাঁড়ালেন। এখনই তিনি কর্মে ইস্তফা দেবেন। কিন্তু বাড়ি ফেরা হলো না রাজারামের। লাল খাঁর হুকুমে তাকে বন্দী করা হলো।
গুজবের পাখায় ভর করে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে খবরটি পৌঁছে গেলো রাজারামের কন্যা সুন্দরীর কাছে। অস্থির হয়ে উঠল সে। বৃদ্ধ পিতার অপরাধটিও কানে এলো তার। লাল খাঁর নির্দেশে রাজারামের ওপর চলতে থাকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে হুমকি দেওয়া হয়, রাজারাম যদি তার প্রস্তাবে সম্মত না হয় তাহলে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হবে, সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। তখন সুন্দরীও তার কব্জায় এসে যাবে।
তবে লাল খাঁ জোরপূর্বক সুন্দরীকে কেন তুলে নিয়ে যায়নি সে প্রশ্নের কোনো জবাব মেলে না। দিনের পর দিন রাজারামের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তেই থাকে। পিতার কষ্টের কথা মনে করে শিউরে ওঠে সুন্দরী, চোখে তার ঘুম আসে না। মেয়ে হিসেবে সে কি কিছুই করতে পারবে না?
অনেক ভেবে চিন্তে সুন্দরী লোক মারফত একটি প্রস্তাব পাঠালো লাল খাঁর কাছে। সুন্দরী দুটি শর্তে লাল খাঁর প্রস্তাব মেনে নেবে। একটি হলো সুন্দরী লাল খাঁর কাছে যাবার আগে রাজারামকে মুক্তি দিতে হবে এবং সেনহাটীবাসীর জলকষ্ট দূর করতে একটি দিঘি খনন করাতে হবে। এ দু’টি কাজ সম্পন্ন হলেই সুন্দরী লাল খাঁর কাছে যাবে।
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দের আবেগে অন্ধ হয়ে গেলো লাল খা এ প্রস্তাবের ভালমন্দ দিক নিয়ে ভাববার মতো মানসিক অবস্থা তখন তার ছিল না। লাল খাঁ খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেনহাটীতে একটি দিঘি খনন করে দিঘিটি উদ্বোধন করার জন্য লোকজন দিয়ে সুন্দরীকে সেনহাটী পাঠাবার ব্যবস্থা করল।
মির্জানগর থেকে সেনহাটী ফেরার পূর্বেই সুন্দরী যে কোনোভাবে পিতার কাছে গোপনে একটি চিঠি দিয়ে যায়। তাতে বৃদ্ধ পিতাকে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিয়ে বলা হয় যে, ফৌজদার নূর উল্লাহ খাঁ খুব শিগগিরই এসে পড়বেন। তার আগমনের অপেক্ষায় এই কালক্ষেপণের আয়োজন।
আশা করা যায় তিনি সব শুনে তাকে মুক্তি দেবেন। মুক্তি পেলেই তিনি সেনহাটী ফিরে যাবেন। আর যদি মুক্তি না পান তাহলে একটি কবুতর পাঠিয়ে যেন তাকে খবর দেওয়া হয়। তখন সে নিজেই তার কর্তব্য ঠিক করে নেবে।
সুন্দরী ফিরে এসে দেখে সেনহাটীতে পুকুর খননের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। যেদিন সেনহাটীবাসীর নামে পুকুরটি উৎসর্গ করা হবে সেদিন যেন উৎসব শুরু হয়ে গেলো। নানারকম বাদ্যবাজে, রকমারী খাবারের আয়োজন করা হয়। সকলের জলকষ্ট এবার দূর হবে। সকলের মনে খুব সুখ। সুখ নেই কেবল সুন্দরীর মনে। রাজারাম ফিরে আসছেন না কেন?
এদিক নূর উল্লাহ খাঁ ফিরে এসেছেন। রাজারামের সকল খবর শুনে তিনি তাকে মুক্তির আদেশসহ সেনহাটী প্রত্যাবর্তনের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। মুক্তির আনন্দে হতবিহ্বল রাজারামের অসাবধানতায় কবুতরটি তার নাগালচ্যুত হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করে। তখন চেতনা হলো রাজারামের। এবার বুঝি তার সমূহ সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তিনি কালবিলম্ব না করে দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছোটালেন সেনহাটীর উদ্দেশ্যে। এদিকে নতুন পুকুর উদ্বোধনের সকল আয়োজন সম্পন্ন। রাজারাম কেন ফিরছেন না? অমঙ্গল চিন্তায় বিষণ্ণ সুন্দরী হঠাৎ যেন দেবতার করুণা প্রার্থনা করতে আকাশ পানে তাকালেন।
ঐদিকে পুরোহিত মশাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সুন্দরীকে তাগিদ দিচ্ছেন পুকুরের একটি নাম ঠিক করার জন্যে। সে কথা যেন কানেই গেলো না সুন্দরীর। আকাশ পানে চোখ তুলেই সে দেখতে পেল একটি বিন্দু ক্রমশ স্পষ্ট হতে হতে একটি কবুতরের রূপ নিয়ে সেনহাটীর দিকেই উড়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর সেটি সদ্য খনন করা পুকুর পাড়ে এসে নামল।
সুন্দরীর চোখে অন্ধকার নেমে এলো তাহলে রাজারামের বোধ হয় মুক্তি মেলেনি। নিজের কর্তব্য স্থির করতে একটুও বিলম্ব হলো না সুন্দরীর। সে পুরোহিতকে বললো যে, তার অনুমতি নিয়ে সুন্দরীই প্রথম এই পুকুরের জলে স্নান করতে চায়। পুরোহিত সেই অনুমতি দিলেন। সুন্দরীকে আশীর্বাদও করলেন।
শান্ত ধীর পদক্ষেপে গলবস্ত্র হয়ে আকাশে তাকিয়ে দেবতা আর পিতা রাজারামের উদ্দেশ্যে মনে মনে প্রণাম জানিয়ে সুন্দরী নেমে গেলো পুকুরের মাঝখানে। গভীর কালো শীতল জলে। তারপর ডুব দিল সে। স্নান সেরে কোনোকালেই আর উঠে এলো না পুণ্যবতী নারী সুন্দরী।
ক্লান্ত শ্রান্ত ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে পৌঁছালেন রাজারাম। ততক্ষণে সব শেষ। ভাগ্যের পরিহাসকে মেনে নিয়ে রাজারাম সরকারও ডুব দিলেন সেই দিঘির গভীর কালো জলে। আর উঠে এলেন না কোনোদিন। গভীর জলের মাঝেই সাক্ষাৎ হলো পিতা আর কন্যার। লোকের মুখে মুখে এখন এই পুকুরটি সরকার-ঝি-দিঘি নামেই পরিচিত।
৩. সাগরের সাথে সংযুক্ত ঠাকুর পুকুর:
একটি বিস্ময়কর পুকুর, নাম তার ‘ঠাকুর পুকুর”। ঠাকুর পুকুর আর দশটি পুকুরের মতই, তবে একটু বড়। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দৈর্ঘ্যে এখনও প্রায় ১৪০/১৫০ হাত ও প্রস্থে প্রায় ৭৫/৮০ হাত। এই ঠাকুর পুকুরের মতোই এর খুব কাছাকাছি আরও দুটি পুকুর আছে। একটির নাম ‘ভগীর পুকুর’ এবং অন্যটির নাম ‘বশির পুকুর’।
বশির পুকুর ভরাট করে বসবাস শুরু করলেও বাকি পুকুর দুটি এখনও প্রায় অপরিবর্তিত আছে। পুকুর তিনটির বৈশিষ্ট্য হলো যে, উত্তর দক্ষিণ বরাবর লম্বা হলেও কোনোটিই চারকোণো বিশিষ্ট নয়। বর্ষীয়ানদের ধারণা পুকুর তিনটি এক রাতে খোড়া হয়েছে। ভগীর পুকুরটি হলো খুলনার দক্ষিণ টুটপাড়া জোড়াকল বাজারের পশ্চিম পাশে।
সঠিকভাবে বলতে গেলে ভগীর পুকুরের পূর্ব পাড়ে হলো জোড়াকল বাজার। বর্তমানে পশ্চিম টুটপাড়াস্থ জাপান বাংলাদেশ হাসপাতালের সামনের পুকুরটিই ‘বশির পুকুর’। আর এ দুটি পুকুর থেকে আনুমানিক ৫০০ গজ দক্ষিণে অবস্থিত ‘ঠাকুর পুকুর’। এই তিনটি পুকুরকে তিনটি বিন্দু ধরে যদি কাল্পনিক রেখা টানা হয় তবে দেখা যাবে যে, একটি সমবাহু ত্রিভুজের তিন কোণায় তিনটি বড় পুকুর।
শুরুতেই কৈফিয়ত দিচ্ছি। ঠাকুর পুকুর নিয়ে বহু কিংবদন্তি কোনো যায়। এর কোনোটি সত্য আর কোনোটি মিথ্যা তার প্রমাণ বা বিচার করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এখানে কেবল মানুষের লোকায়ত বিশ্বাসের কথাই বলা হলো। বিশ্বাস কোনো কিছুর সত্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার উপর নির্ভর করে না। ব্যক্তির বিশ্বাস করা বা না করা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির জ্ঞান বা প্রজ্ঞার উপর।
ঠাকুর পুকুর সম্পর্কে লেখাটিতে কেবল প্রবীণের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। পুকুর তিনটি কত শত বছর আগে খোড়া তা কেউ বলতে পারে না। আজ থেকে আনুমানিক প্রায় ২০০/২২৫ বছর আগে গঙ্গাধর চক্রবর্তী নামে একজন ব্রাহ্মণ কেয়াকাটার জঙ্গল সাফ করে ঠাকুর পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ে বসবাস শুরু করেন। পেশা পূজা পাঠ অর্থাৎ ঠাকুর। পুকুরটি ঠাকুরদের হওয়ায় ঠাকুর পুকুর নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে।
কালক্রমে গঙ্গাধর চক্রবর্তীর চার ছেলে যথাক্রমে মুরারী ঠাকুর, যোগেশ ঠাকুর, অধর ঠাকুর ও সতীষ ঠাকুর (অর্থাৎ পদবি চক্রবর্তীর স্থলে ঠাকুর) বেশি পরিচিতি লাভ করে ঠাকুর হিসেবে। ঠাকুর পুকুর সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি এখনও স্থানীয় প্রবীণরা গর্বভরেই বলে থাকেন। কেউ কেউ বলেন, ‘ঠাকুর পুকুরের সাথে সাগরের যোগাযোগ আছে। তবে এখন নেই এটা যেমন ঠিক, তেমনি একদা ছিল সেটাও তদ্রুপ সত্য। এটা কেমন করে সত্য হতে পারে?
এ প্রশ্নটি সংগত। আজ থেকে ৪০/৫০ বছর পূর্বে যারা ঠাকুর পুকুর দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন এ সত্যটি। ঠাকুর পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ পাড়ে সংযুক্ত ছোট্ট একটি সংযোগ খাল (বিষ্ণুর বা বিঞ্চির খাল) যেটা মতিয়াখালী খাল হয়ে রূপসা নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। সাগরের লোনা জল রূপসা নদী দিয়ে ঠাকুর পুকুরে কোনোদিন না ঢুকলেও জোয়ার ভাটার মাধ্যমে সাগরের সাথে পুকুরের সংযোগ ছিল। এটা সত্য।
স্থানীয় লোকজন এখনও বিশ্বাস করেন ঠাকুর পুকুরে একদা বহু ধনরত্ন ছিল। পুকুরে নিমর্জিত চড়ক পূজার ‘পাট’ ছিল জীবন্ত, যাকে পাহারা দিয়ে রাখত বিশালাকার দুই গজাল মাছ। একটির মাথায় লাল ফোটা, অপরটির মাথায় কালো ফোটা। ঐ পুকুরে দুটি বিশাল গজাল মাছ যে ছিল একথা সত্যি, কারণ সময়-অসময়ে ঠাকুর পুকুরে নেমে গজাল মাছের তাড়া খেয়ে উঠেছেন এমন দু-এক লোক এখনও জীবিত।
চড়ক পূজার পাট এখনও বহু পুকুরে রক্ষিত আছে যা চড়ক পূজার সময় ঢাক-ঢোল ইত্যদি বাজাতে বাজাতে পুকুরের চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে থাকলে পাট জেগে ওঠে। উল্লেখ্য, ফকিরহাটের ফলতিতা এলাকায় এরকম একটি পাট একটি পুকুরে ছিল। মাত্র বছর দশেক হচ্ছে নানান অনিয়ম ও অত্যাচারে তা আর উঠছে না।
ঐ এলাকায় পাট ওঠা দেখেনি বা পাট ওঠার সাথে সাথে বিনা মেঘে ঝড়ো বাতাস শুরু হতো এ বিষয়টি জানে না এমন লোক বোধ করি ঐ এলাকায় একটিও নেই। ঠাকুর পুকুরের ধনরত্নের সাথে ছিল অগনিত থালা, বাটি, গ্লাস, চামচ ইত্যাদি। এর কোনোটি সোনার, কোনোটি রূপার, আবার কোনো কোনোটি কাঁশা বা পিতলের।
১৫০/২০০ বছর পূর্বে যেখানে কলা পাতায় খাবার পরিবেশন করা হতো তখন টুটপাড়া এলাকায় ব্যবহৃত হতো সোনা/রূপা বা কাঁসা নির্মিত থালা, গ্লাস, ঘটি, বাটি ইত্যাদি। আর সবই পাওয়া যেত নাকি ঠাকুর পুকুরের কাছে অনুষ্ঠানের পূর্বের দিন গলবস্ত্র হয়ে প্রার্থনা করলে। তবে প্রার্থনার সময় বলে দিতে হতো যে, অনুষ্ঠানে কত সংখ্যক মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
আর সেই পরিমাণ মতো জিনিস পরদিন ভোরবেলা পুকুর পাড়ে উঠে বসে থাকতো। ওঠা বন্ধ হয়েছে ‘কর’দের সময়ে। করের বাজারের নাম অনেকেই জানেন। এই করদের বাড়ির এক কাজের মহিলা চুরি করলো একটি সোনার চামচ। কে জানতো তা ? দেখা গেলো কাজ শেষে থালা বাটি আর পুকুরে নামছে না।
স্বপ্ন দেখালো ঠাকুর পরিবারের এক গৃহবধূকে। কেউ একজন একটি সোনার চামচ তুষের ডুলির মধ্যে সেরে রেখেছে। সেটি খুঁজে এনে ফেরত দিয়ে মাফ চাওয়া হলো। কিন্তু ঐ শেষ। আর কোনো দিন পুকুর থেকে কিছুই ওঠেনি।
দেড় থেকে পৌনে দু’শ বছর আগের কথা। ঠাকুর পুকুর থেকে সাত মাইঠ (ঘড়া) ধনরত্ন বিঞ্চির (বিষ্ণুর) খাল বরাবর প্রায়ই লাইন দিয়ে চলাচল করে। অনেকেই চেষ্টা করে ধরার জন্য। কিন্তু চেষ্টা করলেইতো হবে না। কখনও ঝন্ ঝন্ করে চলে যাচ্ছে অথচ দেখা যাচ্ছে না। কথা হচ্ছিল অধর ঠাকুরের সেঝো ছেলের ছোট শ্যালিকার সাথে। বয়স হবে ৭০/৭৫ বছর। নাম সুধা রায় চৌধুরী।
দিদির বিবাহের সময় তিনি ছিলেন ছোট্ট খুকী। ৬০/৬৫ বছরের বড় বেয়াইকে তিনি দেখেছেন। হাত পা স্থির রেখে কোনো কাজই করতে পারেন না। অথচ যৌবনে এই মুরারী ঠাকুর নাকি লম্বা, চওড়া, ফর্সা বিশাল দেহী শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। এখনকার মতো সুন্দর টয়লেট তখন ছিল না। সূর্য ওঠার আগেই মানুষ ঝোঁপে জঙ্গলে বাম হাতের কাজ সেরে ফেলত। মুরারী ঠাকুর একদিন ভোর বেলায় প্রাতঃক্রিয়া সেরে বিষ্ণুির খালের কাছ থেকে বাড়ি ফিরছেন।
হঠাৎ তিনি দেখলেন ঠাকুর পুকুর থেকে একে একে সাত সাতটি মাইঠ বিষ্ণির খাল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দিক-বিদিক হারা হয়ে হাতে থাকা পেতলের গাড়ু (বদনা) ছুড়ে মারলেন। লাগলো গিয়ে একেবারে শেষটির গায়ে। সপ্তম মাইঠ-এর কানাটি গেলো ভেঙে। কানা ভাঙা মাইঠটি আর যেতে পারলো না। ফিরে নেমে এলো পুকুরে। বাকি ছয়টি ফিরেছে কি না তা কেউ কোনোদিন দেখেনি। ঐ ঘটনার পর থেকে মুরারী ঠাকুরের নাকি ঐ দশা।
হাত পা আর কোনোদিন কোনোভাবে স্থির রাখতে পারেনি। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এর বহু দিন পর, আজ থেকে মাত্র ৪৫/৫০ বছর আগের কথা। মানুষ এ সব যখন ভুলতে বসেছে তখন রূপচাঁদ তার স্ত্রীকে নিয়ে ঠাকুর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বসবাস শুরু করলেন। রূপচাদের স্ত্রীর নাম টুকু।
কিছু দিন পর পর টুকুকে স্বপ্নে বলে আমি অঙ্গহানি হয়ে পুকুরের মধ্যে খুব কষ্টে আছি। একজোড়া নারিকেল দিয়ে তুই আমাকে উঠিয়ে নে। টুকু রানি নারিকেল দিতে কোনোদিনই স্বীকার হয়নি। বিনিময়ে সে প্রকাশ্যে পুকুরে মানুষের মলমূত্র ফেলতো, ঝাটা আরও সব বিশ্রী বিশ্রী জিনিস ফেলতো। সেজন্য লোকে তাকে কিছু বলতো না।
আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, চৈত্র/বৈশাখ মাসে আশে-পাশে অধিকাংশ পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলেও ভরাট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বশির পুকুরসহ তিনটি পুকুর অপেক্ষাকৃত কম গভীর হলেও কোনোদিন পানি শুকায়নি। অথচ পুকুর তিনটি কোনো কালেই মানুষ গণভাবে ব্যবহার করেনি। এমনকি আজও মানুষ ভগীর পুকুর বা ঠাকুর পুকুরের মাঝে একা একা যেতে ভয় পায়।
৪. ফুলতলা নর-নারায়ণ মঠ:
বটিয়াঘাটা উপজেলার ফুলতলা গ্রামের কাজী বাছা নদীর তীরে একটি প্রাচীন ধর্ম স্থান/ মঠ আছে। এই মঠের প্রতিষ্ঠা নিয়ে এ কাহিনি প্রচলিত আছে। তাহলো অতি প্রাচীন কালে বর্তমানের এই মঠ যে জায়গায় অবস্থিত সেখানে জঙ্গল-ঝোপ ঝাড়ে পরিপূর্ণ ছিল। ভয়ে এখানে কেউ আসতো না। কয়েকদিন যাবৎ ঐ মঠের জঙ্গল থেকে ধোঁয়া বের হতো।
একদিন এলাকার কিছু লোক একত্রিত হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে ঐ ধোঁয়ার সন্ধান করতে গিয়ে দেখে এক সাধু ওখানে ধুলি জ্বালিয়ে বসে আছে। সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। সবাই যেয়ে ঐ সাধুকে নমস্কার করে তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। সাধু প্রসন্ন হয়ে সবাইকে আশীর্বাদ করলেন। লোকজন গ্রামে ফিরে এলো।
গ্রামের লোকের কোনো বিপদ আপদ হলে তার কাছে ছুটে যেতেন। এইভাবে লোকমুখে সাধুর নাম বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। এলাকার জনগণ সবাই মিলে ঐ সাধুর আখড়ায় পাকা স্থাপনা তৈরি করে দিলেন। সাধু ওখানে যেয়ে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেন। এই বিগ্রহের নাম নর-নারায়ণ। তখন ঐ সাধুর অবস্থানের এবং তার নামানুসারে মঠের এই নাম।
কাজী বাছা নদীর ভাঙনে সেই মন্দির এখন বিলীন। পরবর্তীকালে সেখানে নতুন করে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এই মন্দিরে দুর্গা পূজাসহ বিভিন্ন পূজা ধুমধামের সাথে পালন করা হয়। প্রচুর লোক সমাগম হয় এই সব অনুষ্ঠানে। বিশেষ করে চৈত্র মাসের শেষে ও পয়লা বৈশাখে বিশাল আকারে নামযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।
৫. কিংবদন্তির পুকুর:
সুপ্রাচীনকাল থেকে জানা যায় ডুমুরিয়ার রংপুর গ্রামের কিংবদন্তিযুক্ত পুকুরের ইতিহাস। এই অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে জানা যায় যে, এক রাত্রে দেবতারা এখানে সাত সাতটি পুকুর খনন করেন। এই সাতটি পুকুরের স্বতন্ত্রতা সাত রকম। সাতটি পুকুরের মধ্যে সাতটিই এখনও জীবিত। পুকুরগুলো আয়তনে বেশি বড় নয়। ঠাকুরানিতলার পুকুরে এখনও দেবতাদের যাতায়াত আছে বলে এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে।
এই পুকুরে যেহেতু দেবতাদের যাতায়াত আছে তাই পুকুরের চারপাশে বাধ দিয়ে রাখা যায় না। একপাশে তাই এখনও খোলা রাখা হয়। টেনের পুকুর সম্পর্কে জানা যায় যে এখনও গভীর রাতে এই পুকুরের পাশ দিয়ে কেউ গেলে অশরীরী কোনো কিছুর অস্তিত্ব সে টের পেতে বাধ্য। এই পুকুরকে সবাই বেলে পুকুর বলে জানে।
সাড়াতলার পুকুরের পাশে গড়ে উঠেছে বৈষ্ণব মন্দির। জানা যায় এই পুকুরের জলের ওপর দিয়ে দেবতাদের হাটাহাটি অনেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। গজেন্দ্রপুর পুকুরের পাড়ে গড়ে উঠেছে বলাই সাধুর সুউচ্চ মন্দির। এই পুকুরের অলৌকিকতা এখনও বিস্ময়কর।
পুকুরের উপর জন্ম নিয়েছে বড় বড় গাছ। পুকুরের জলের ওপর যে ধাপ তার ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করে। তবে এখনও পর্যন্ত কেউ এই পুকুরের গভীরতা পরিমাপ করতে পারেনি। লম্বা লম্বা বাঁশ দিয়ে পুকুরের গভীরতা পরিমাপ করার চেষ্টা করা হলেও বাঁশ ঠাই পায় না।
পুকুরে হরেক রকম মাছের অস্তিত্ব সবাই টের পেলেও কেউ মাছ ধরতে সাহস পায় না। এই পুকুর হতে কেউ কখনও কোনো মাছ ধরেছে বলে জানা যায় না। কিংবদন্তির এই পুকুরগুলোর পাড়ে দাঁড়িয়ে যদি কেউ কখনও কোনো প্রার্থনা করে তবে তা পূরণ হয়। এখনও প্রতিদিন অনেক মানুষ এই পুকুর প্রত্যক্ষ করতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে।
৬. শিববাড়ির শিব মন্দির :
খুলনা শহরের অধুনালুপ্ত শিব মন্দির একটি প্রাচীন শিব মন্দির। এর থেকেই কেডিএ ভবন সংলগ্ন এলাকার নাম হয়েছে ‘শিববাড়ি’। মোড়ের নাম হয়েছে ‘শিববাড়ির মোড়। অনেকের মতে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে জনৈক প্রসেস সার্ভেয়ার উমাচরণ দে এ মন্দির নির্মাণ করেন। এ সম্পর্কে ভিন্নমতও পোষণ করা হয়ে থাকে। শ্যামল ঘোষ এ প্রসঙ্গে একটা কিংবদন্তির উল্লেখ করেছেন। তা হলো শিব মন্দিরের স্থানের।
পাশে আগে একটা পুকুর ছিল। এক মহিলা ঐ পুকুরে পানি আনতে গেলে ঐ পুকুর পাড়ে একটা অদ্ভুতাকৃতির গোলাকার লম্বা শিলাখণ্ড দেখতে পান। তিনি লাথি দিয়ে ঐ শিলাখণ্ড ওঠানোর চেষ্টা করলে তা আপনা আপনি পানির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ ঘটনা শুনে সকলে অনুমান করেন যে তা সাধারণ কোনো শিলাখণ্ড নয়- তা শিবলিঙ্গ।
তখন যশোর জেলার জনৈক চাঁচড়ারাজ সেখানে একটা শিব মন্দির তৈরি করে দেওয়ার মনস্ত করেন। এছাড়াও কথিত আছে, দবিরউদ্দিন আহমদ নামক আরেকজন তার নিজের গোমস্তা রাম বসু মহাশয়কে হুকুম দিলেন তিনি যেন ঐখানে থেকে যতশীঘ্র সম্ভব শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করবার ব্যবস্থা করেন। যত অর্থ ব্যয় হবে তা তার স্টেট বহন করবে।
সেই তখন থেকে গ্রামের নাম হলো শিববাড়ি। প্রতি বছর বহু হিন্দু নর-নারী শিব চতুর্দশীতে শিব মন্দিরে পূজা দিয়া পুণ্য অর্জন করে বাড়ি ফিরতেন। এই উপলক্ষে সেখানে বিরাট মেলা বসত। মেলায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে বহু লোকের সমাগম হতো। কিন্তু অর্থাভাবে বহুকাল অযত্নে থাকবার ফলে এবং মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কোনো কোনো স্থান ফেটে গিয়েছিল এবং মন্দিরের চারদিকে উই পোকার মাটির ঢিবিতে এর উচ্চতার অনেকটা অংশ মাটিতে ঢেকে গিয়েছিল।
এরপর যশোর থেকে খুলনা পর্যন্ত রেল লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। ১৮৮০ সালে স্টেশন রেল কর্মচারীদের বাসস্থান ও রেল লাইন বসানোর জন্য চার্লিগঞ্জের হাট বাদ দিয়ে চার্লি সাহেবের বাড়িসহ সমস্ত চার্লিগঞ্জ, হেলাতলার পশ্চিমাংশ, মিয়াবাগ ও শেখপাড়া গ্রামের উত্তরাংশ হুকুম দখল করে রেলওয়ে কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
এ শিববাড়ি মন্দিরও তখন হুকুমদখল করা এলাকার মধ্যে পড়ে। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত মন্দিরটি এই ভগ্নাবস্থায় পড়েছিল এবং ঐ সালেই ধনকুবের রথ চাইল্ড কলকাতার শিয়ালদহ হতে খুলনা পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে। শিবমন্দিরও ঐ আওতায় পড়ে রেল কোম্পানির দখলে আসে।
একসময় মন্দিরটি খুব পরিচিত হয়ে উঠেছিল। কোনোাা যায় এর জন্য ঐ সময় প্রতিমা পাঠান ভোলানন্দ গিরি মহারাজ। নৈমিত্তিক পূজার্চনা ছাড়াও মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রে তথা শিবরাত্রিতে এখানে সাড়ম্বরে শিব পূজা অনুষ্ঠিত হতো। এ উপলক্ষে এখানে মেলা বসতো যা চলতো প্রায় বেশ কয়েকদিন ধরে। তবে রেল লাইনের আওতাভুক্ত হয়ে পড়ায় জনগণের সঙ্গে এর যোগাযোগের মধ্যে নেমে আসে একটা বিরাট বাধা।
ঐ সময় খুলনার কিছু সমাজহিতৈষী ব্যক্তি শিব মন্দিরসহ এ এলাকাকে রেল এলাকা হিসেবে হুকুমদখল করার বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে এক মামলা করেন। উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ ও যথাযথ দলিল দস্তাবেজের অভাবে হাইকোর্টে এ দাবি অগ্রাহ্য হয়ে যায়। এ মন্দির সংলগ্ন জমি রেল এলাকার মধ্যে থাকবে বলে রায় দেওয়া হয়।
তবে রায়ে এও বলা হয় যে মন্দির অক্ষত থাকবে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তা ব্যবহার করতে পারবে। এরপর থেকে সেখানে যথানিয়মে পূজা-অৰ্চনা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। বর্তমানে মূর্তি প্রতিষ্ঠাপূর্বক নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে।
৭. শীতলা বাড়ি মন্দির :
মোহন ব্যানার্জি জন্ম থেকেই এই মন্দিরে আছেন। মা শীতলার কল্যাণে সকল ধর্মের মানুষকে বসন্ত ও আরও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দেন। তার পিতার কাছ থেকে জানা তথ্য তিনি বলেন, ১১৬ বছর আগে তৎকালীন জমিদার হীরালাল রায়ের চাষি তার চাষ জমিতে মা শীতলার বিগ্রহ /পুতুল পান। এবং এই বিগ্রহকে তিনি জমিদারের হাতে দেন।
জমিদার ঘরের দুয়ারে বট গাছের গোড়ায় রেখে দেন। রাতে জমিদার স্বপ্ন দেখেন যে তিনি যদি শীতলা মায়ের যত্ন করেন তবে সকল মানুষের রোগ মুক্তি যেমন মড়ক, কলেরা, বসন্ত আরও অনেক অসুখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। নতুবা এই দেশের মানুষের অকল্যাণ ঘটবে। পরদিন জমিদার দোলখোলা বাজারে এসে গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব অঘোরলাল, কাশীলাল (এরা জাতে ছিল মারওয়ারী)-এর কাছে বললে তারা একটি ছোট ঘরে রাখার পরামর্শ দেন।
এরপরে আবার স্বপ্ন দেখলে হীরালাল রায় তার দোলখোলা মোড়ের জমির ৯৭ শতক ও পরে ৪৫ শতক মা শীতলার নামে দান করেন। প্রথম তালপতার ঘর করে রাখা হয় এবং একতলা বিল্ডিং করা হয়। চারিদিকে বারান্দা করা হয় টালি দিয়ে। এর দেখাশুনা করেন বিজিত রায়। আবার কথিত আছে এইসব এলাকায় ৫০০/৬০০ বছর আগে পানি ছিল। কেউ হয়ত নৌকা করে যাবার সময় নৌকা ডুবি হয় এবং পরবর্তীকালে পানি শুকিয়ে জমি হলে ঐ চাষি পায়।
এই শীতলা মূর্তিটি কষ্টি পাথরের। ৫ বছর আগে বার্মিংহামের খ্রিস্টান নিগানা নামের একজন গবেষক গবেষণা করে বলেন এটি ৫০০/৬০০ বছর আগের কষ্টি পাথর। ছোট কালো মূর্তিটিই শীতলা নামে পরিচিতি পায় যার উচ্চতা দেড় ফুট (ছবি সংযুক্ত)। কালের পরিক্রমায় বিজিত রায় পরে কোনো একদিন মোহন ব্যানার্জির বাবা নীহার রঞ্জন ব্যানার্জি এই শীতলা মায়ের সেবার ভার পান। এবং তার সন্তান মোহনের বসন্ত হয়।
মারাত্মক বসন্তে বাঁচার মতো ছিল না। শীতলা মা তাকে স্বপ্নে দেখিয়ে ঔষধ দেন। এবং তিনি সন্তানের ও অন্যান্য মানুষের ঐ একই চিকিৎসা করেন। এবং তারা সকলেই আরোগ্য লাভ করেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে এই বিদ্যা বরস্বরূপ মোহন ব্যানার্জিকে দিয়ে যান। অদ্যাবধি মোহন ব্যানার্জি এই কাজ করছেন। মোহন ব্যানার্জির কাছ থেকে সংগ্রহকারীও আরোগ্য লাভ করেছে পক্স অসুখ থেকে। শীতলা বাড়ি মন্দিরে প্রতি পার্বণে পূজা পালন হয়। শীতলা পূজা হয় চৈত্র মাসে।
৮. ভূতের বাড়ি
খুলনা শহরে যেমন মানুষের বাড়ি আছে তেমনি ভূতেরও বাড়ি রয়েছে। খানজাহান আলী রোডের পাশে টুটপাড়া কবরখানার ধারে এ ভূতের বাড়ি অবস্থিত। এ শতকের প্রথমার্ধে এ বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। বাড়িটি নির্মাণ করেন দীননাথ সিং নামক জনৈক ব্যক্তি। এই দীননাথ ছিলেন খুলনার কুখ্যাত নীলকর রেনীর সহযোগী।
পরে বাড়িটি নানা কারণে ‘ভূতের বাড়ি’ বলে পরিচিত হয়ে ওঠে। জনশ্রুতি রয়েছে, বাবু দীননাথ সিং শখ করে নিভৃত এ স্থানটিতে বাসা বাঁধেন। তখন স্থানটির চতুর্দিক ছিল বসতিহীন, কর্দমাক্ত। একবার এক রমণী কি কারণে যেন ঐ বাড়িতে উদ্বন্ধনে মৃত্যুবরণ করেন। বস্তুত বাড়ির খড়খড়িতে ধাক্কা মারা, যত্রতত্র যখন তখন ঢিল ছোড়া বাড়ি তৈরির প্রথম থেকেই ছিল।
ঐ মৃত্যুর পর সিং মহাশয়েরা আর সে বাড়িতে থাকতেন না। তাঁদের একজন মুসলিম গোমস্তা তারপর থেকে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখাশুনা করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে জনৈক মুসলমান এসে ঐ বাড়িতে ওঠেন। তথায় তাঁর প্রথম স্ত্রীর ঘরের এক ছেলে হঠাৎ একদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। অতঃপর মোক্তার সাহেবও এখান থেকে পাত গুটান।
তারপর ঐ খালি বাড়িতে ডা. গোলাম জব্বার সাহেবের এক চাকরকে কে বা কারা গুলি করে সিঁড়ির গোড়ায় ফেলে রাখে। এভাবে রাতারাতি বাড়িটি ভূতের বাড়ি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। নির্জন এলাকা, পাশে কবরখানা-ভূতের একেবারে আদর্শ পরিবেশ। কোনো যায়। পরেও যারা এ বাড়িতে এসেছেন তাদেরও কোনো না কোনো অঘটন ঘটেছে।
আরও পাড়ুন:
This post is also available in:
বাংলাদেশ
“খুলনা জেলার কিংবদন্তি, যত সব আশ্চর্য ঘটনা [ Legends of Khulna District ]”-এ 5-টি মন্তব্য