জিগির তত্ত্ব [ Jigir Totto ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : জীবনের সর্বপ্রকার চেতনা জীবন-চাহিদা থেকেই-যে উদ্ভূত, তা গোড়াতেই স্বীকার না করলে জীবন ও জগৎ-ভাবনা সম্পর্কে সর্বপ্রকার ধারণা ও সিদ্ধান্ত ভুল হতে বাধ্য।
মানুষ আত্মকল্যাণেই প্রতিবেশ-উদ্ভূত সর্বপ্রকার সমস্যার ও অভাবের আপাত সমাধান ও পূরণ প্রত্যাশা করে এবং সেভাবেই জীবন-যন্ত্রণার আশু উপশম কামনা করে। গণপতি ও দলপতিরা তাই লোক-মনোরঞ্জক বুলি ও জিগির তুলে জনমত ও গণশক্তিকে সংহত ও সুনিয়ন্ত্রিত করে উদ্ভূত সমস্যার আপাত সমাধান দিয়ে নিশ্চিন্ত হন এবং আত্মম্ভর নেতা তাঁর মানস-প্রসূনকে চিরন্তন তত্ত্ব ও জীবন-সত্যের মর্যাদাদানে থাকেন উৎসুক। তাই কালান্তরেও বিভ্রান্ত জনতা মানসদ্বন্দ্বে ও বিমূঢ়তায় ভোগে।
ভারতের ইতিহাস থেকেই দু-চারটি দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। মারাঠা অভ্যুত্থানে শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত মুসলিম রাজন্য স্ব-স্বার্থেই একদিন আহমদ শাহ্ আবদালীর সহযোগিতা করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে একে মুসলিম সংহতির নিদর্শন বলে ভুল করা সম্ভব। কিন্তু পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পরিণামে সুবিধে হল কেবল ব্রিটিশেরই।
আত্মবিনাশী ঐ যুদ্ধের পরে হীনবল রাজন্য আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে স্বদেশ, স্বধর্মী ও স্ব-জাতির স্বার্থ উপেক্ষা করে আত্মকল্যাণে ইংরেজ-ফরাসির আশ্রয় ও প্রশ্রয় কামনা করে ত্বরান্বিত করেন নিজেদেরই বিনাশ। স্ব স্ব অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে কেউ তখন পারস্পরিক সমঝোতা কিংবা আপসের কথা চিন্তা করেননি। স্বদেশ-স্বধর্মী প্রীতিও গেল উবে।
আবার উনিশ শতকে ব্রিটিশ-প্রজা হিন্দু ও মুসলমান প্রথমে স্ব স্ব শাস্ত্রানুগত জীবনে চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মকল্যাণ কামনা করেছে। ফকির-সন্ন্যাসী-আর্যসমাজী-ব্রাহ্ম-ওহাবী বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্ববাদ প্রভৃতি আন্দোলন তার সাক্ষ্য।
তারপর ব্রিটিশ-রাজত্বে অভিন্ন শাসকের বিরুদ্ধে যখন সমস্বার্থে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজন হল, তখন কিন্তু খাইবার পাস থেকে সিঙ্গাপুর অবধি বিস্তৃত ভুবনে জাত, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, ভাষা প্রভৃতি কিছুই যেন সংহতির পথে বাধা হয়ে নেই। তখন কেবল একটি জিগির “বিদেশী তাড়াও।” আরও পরে যখন শিক্ষালব্ধ চেতনা একটু গাঢ় হল, তখন আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থচেতনা প্রবল হয়ে ওঠে। এই সময়কার জিগির হল— “বিদেশীর সাথে বিধর্মীও তাড়াও।” হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ এ ভূমিকাই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে।।
তারপর পাকিস্তানে আবার একই আঞ্চলিক স্বার্থে জিগির উঠল “বিভাষী তাড়াও।” ভারতের দাক্ষিণাত্যে ধ্বনিত হল নূতন জিগির—“হিন্দি হঠাও, গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্যে গুরুত্ব দাও।” আসামে, বিহারে জিগির উঠল “বাঙলা খেদাও।” আর অন্য অঞ্চলে দাবি উঠল জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যে স্বীকৃতির।
অন্যান্য অঞ্চলেও আঞ্চলিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ফলে, এককালের অখণ্ড ভারত ও অভিন্ন জাতি-চেতনা গেল মিলিয়ে। আর ঠাঁই নিল গোত্র-চেতনা, আঞ্চলিকতাবোধ, ভাষা-বিদ্বেষ ও স্বাতন্ত্র্য-প্রীতি। পাকিস্তানেও পাকতুন, বালুচ ও সিন্ধির ঐ একই দাবি। সবটাই জাগছে স্বার্থবুদ্ধি থেকে। সব বোধেরই উৎস হচ্ছে শাসন ও শোষণ-শঙ্কা।
সব প্রেরণার উৎস হচ্ছে লাভের লোভ। তাই পাক-ভারতে একই জিগির—“ভাষাভিত্তিক গোত্রগত রাজ্য চাই।” ভারতে তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কেরালা, হিমাচল, অরুণাচল, মেঘালয়, মিজোল্যান্ড, মণিপুর প্রভৃতি এভাবেই গড়ে উঠেছে। তেলঙ্গনা, বিদর্ভ প্রভৃতিও গড়ে উঠবে। পাকিস্তানেও একই সমস্যা।
কাজেই যে-পরিবেশে অভিন্ন জাতীয়তার অঙ্গীকারে অখণ্ড ভারত-চেতনা জেগেছিল, সেই পরিস্থিতির অনুপস্থিতি খণ্ডভারতে অসংখ্য জাতি চেতনা জাগিয়েছে। সমস্বার্থে সহযোগিতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে আপস না হলে বিচ্ছিন্নতা হবে অপ্রতিরোধ্য ও অবশ্যম্ভাবী।
ধর্মীয় অভিন্নতা ছিল বলে পাকিস্তানে শোষিত বাঙালীর জিগির ছিল—“বিভাষী হঠাও।” তার আনুষঙ্গিক ধ্বনি বা যুক্তি এল – ধর্মবিশ্বাস ব্যতীত বাঙালীর জাতি-বর্ণ, ভাষা-সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, আচার-আচরণ প্রভৃতি আর সবকিছুই স্বতন্ত্র। ব্রিটিশ ভারতে এই বাঙালী মুসলিমই এইসব যুক্তিতে কখনো কান দেয়নি। কিন্তু ভিন্ন পরিবেশে ভাষিক ও গৌত্রিক চেতনার বাঙালী হল উদ্বুদ্ধ।
এ তাৎপর্যে ভারতীয় বাঙালীরা বাঙালী জাতিভুক্ত। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে আবার রাষ্ট্রিক প্রয়োজনেই, রাষ্ট্রিক জাতীয়তার অঙ্গীকারে জাতীয়তাবোধ সীমিত করা জরুরি হয়ে উঠল। যাঁরা দ্বি জাতিভিত্তিক পাকিস্তান-তত্ত্বটি ভুল বলেই ইদানীং উপলব্ধি করেছেন, তাঁরাও কিন্তু অখণ্ড ভারত আর কামনা করেন না। ধার্মিক দ্বি-জাতিতত্ত্বে আস্থা হারিয়েও তাঁরা ভাষিক জাতিতত্ত্বে আস্থা রাখেননি। অর্থাৎ স্ব-স্বার্থেই তাঁরা পাল্টে স্বাতন্ত্র্যই কামনা করেন।
আগে যা-কিছু করেছেন ধর্মের নামে, পরে যা করেছেন ভাষার নামে, তাই এখন রাষ্ট্রের নামে করছেন অর্থাৎ রাষ্ট্রিক জাতিতত্ত্বের যুক্তিতে স্বতন্ত্র জাতীয়তার অনুগত করছেন জীবনকে। কালান্তরে আজকের পরিবেশে এটি অবশ্যই শুভবুদ্ধিপ্রসূত। কিন্তু স্বার্থপরবশ মানুষের বিবেককে এ অসংগতি পীড়িত করে না।
এ ঘন ঘন জিগির বদলানোর বিড়ম্বনা বিচলিত করে না বুদ্ধিকে। অখণ্ড ভারতওয়ালারা যেমন এখন খণ্ড রাষ্ট্রের কামনায় উৎসুক, তেমনি সদ্যস্বাধীন বাঙলাদেশীরাও বিদেশী, বিধর্মী, বিভাষীর অভাবে আঞ্চলিক স্বার্থ ও সুবিধা-সচেতনতার প্রবণতা দেখাচ্ছে।
তার কারণ আসলে আর্থিক লাভ-লোভের ক্ষেত্রে মানুষ চিরকাল এমনি করে সজ্ঞানে কিংবা অবচেতন প্রেরণায় নতুন নতুন আবেগে তাড়িত হয়েছে এবং তার অনুকূলে যুক্তিজাল রচনা করেছে–উদ্দেশ্য সাধনে ও সাফল্য-বাঞ্ছায়। সম্পদ-নির্ভর জীবনে পাথেয়কামী পথিক কিংবা জীবিকা-সন্ধানী জৈব প্রবৃত্তিবশেই, প্রাকৃতিক নিয়মেই জীবনের দাবি স্বীকার করে। এবং উপযোগ-বুদ্ধির প্রয়োগে দ্বান্দ্বিক চেতনার টানাপড়েনে বিক্ষত হয়েও আপাতপ্রয়োজনে সাড়া দেয়।
তাই চিরকাল মনুষ্যচিন্তা ও মনুষ্য-আচরণ দ্বন্দ্ব-সংলগ্ন, স্ববিরোধী ও বৈপরীত্যাভিসারী। এ কারণেই যে-কোনো মনুষ্যচিন্তা কালিক ও স্থানিক এবং যুগান্তরে হৃত-উপযোগ আর স্থানান্তরে ও কালান্তরে সমস্যা ও যন্ত্রণার আকর। কেবল এই প্রত্যয়েই মানুষের ইতিহাসের বিবর্তন ধারার এবং সামগ্রিক জীবনপ্রবাহের ব্যাখ্যাদান সম্ভব।
অতএব প্রায় জৈবিক প্রয়োজনেই স্থান-কাল-প্রতিবেশের প্রভাবে মানুষ কখনো প্রেমিক, কখনো সুক, কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন, কখনো ত্যাগী, কখনো ভোগী, কখনো উদার, কখনো অসহিষ্ণু, কখনো গ্রহণোন্মুখ, কখনো বর্জনশীল, কখনো পোষক, কখনো শোষক। মনুষ্য-মনের ও আচরণের বিকাশ ও বিকৃতি―—দু-ই অভিন্ন মূল। দ্বন্দ্ব মিলন একই স্বার্থের প্রসূন।
আজ অবধি জাত, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, শ্রেণী বা স্থানগত যত দ্বন্দ্ব-মিলন ঘটেছে, তার সবটাই জীবিকাগত এ-যুগের পরিভাষায় আর্থিক শোষণ বা পোষণগত। কোনো না কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অজুহাতে অথবা কোনো না কোনো সচেতন বা অবচেতন জৈবিক প্ররোচনায় সন্ধি-বিগ্রহ জরুরি হয়েছে। যেমন একসময় ‘বন্দে মাতরম’ মুসলিম-কণ্ঠেও ধ্বনিত হত। তারপরে রাজনৈতিক অভিসন্ধিবশে তা ঈমানবিরুদ্ধ বলে পরিত্যক্ত হয়। এখন আবার রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে দেশ ও দেশমাতৃকার বন্দনাগানে বাঙালী মুসলিম মুখর।
অতএব, যে-কোনো জিগির বা যে-কোনো দ্বন্দ্ব-মিলনের মূলে রয়েছে স্থানিক, কালিক, সামাজিক ও ব্যক্তিক প্রয়োজন ও সাময়িক যৌক্তিকতা। গণমনে আবেগ ও উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়োজনেই তাতে আত্মিক ও আদর্শিক মাহাত্ম্য, মহত্ত্ব ও গুরুত্ব দেয়া হয় মাত্র। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীর চোখে তাই এগুলো ঐতিহাসিক বিবর্তন বা আবর্তনতত্ত্বরূপে গুরুত্বপূর্ণ হলেও মানব-মহিমার বা মানবিক মূল্য-চেতনার পরিচায়ক নয় । কাজেই স্থায়ী মানবকল্যাণ ও স্থায়ী মূল্যবোধ এতে অনুপস্থিত।
ইতিহাসে তাই আমরা বহু পুরোনো জাতি ও রাজ্যের জন্ম-মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি। প্যাগান রোমক জাতি কিংবা হলি রোমান এম্পায়ার কাল-পরনে মিশে গেছে। আসিরীয়-কলডীয়-কণ্ট কিংবা শক-হুন-কুশান গোত্রের পরিচয় আজ নিশ্চিহ্ন। চোখের সামনে জার্মানি, কোরিয়া, ইন্দোচীন, মালয়, আরবভূখণ্ড খণ্ডিত বা দ্বিখণ্ডিত। আবার নাইজেরিয়া, ফরমোজা, আয়ারল্যান্ড, ইথিওপিয়া ও কাশ্মিরের বেলায় অন্য তত্ত্ব, নীতি ও বিচিত্র যুক্তি স্বীকৃত। বাৰিল ভিন্ন
কাজেই স্বার্থে স্বজাতিও শত্রু হয়, স্বদেশীয়ও হয় পর, স্বভাষী কিংবা স্বদেশীও হয়। পরিহার্য। ব্যক্তিক, জাতিক কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাই গরজ ও বিবেকের দ্বন্দ্বে, স্বার্থ ও যুক্তির সংঘাতে, লাভ ও ন্যায়ের মোকাবেলায় সাধারণত সাময়িক গরজ, স্বার্থ ও লাভ-লোভেরই জয় হয়।
স্বদেশ থেকেই এবার গরজের দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। পাকিস্তানে বাঙলা ভাষাকে শব্দে, বানানে ও বর্ণে বিকৃত করে এবং রবীন্দ্রনাথকে বিতাড়িত করে বাঙালীর জাতি-চেতনা ভোঁতা করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রয়োজনে। এ নীতি নতুন ছিল না। গ্রিক সাম্রাজ্যবাদ কিংবা তারও আগে থেকেই সাম্রাজ্যবাদীরা এ নীতি নিয়ম চালু করেছিল এবং শাসিতরাও দুর্বলতাবশে চিরকাল তা প্রায়ই মেনে চলেছে।
শাসকের ভাষা চিরকালই শাসিতের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এতে কোনো কোনো শাসিতের দুর্বল ভাষা চিরকালের মতো লোপ পেয়েছে—যেমন লোপ পেয়েছে বাঙালীর গোত্রীয় অস্ট্রিক ভাষা, যেমন নিশ্চিহ্ন হয়েছে কপ্ট ভাষা, যেমন দেশচ্যুত হয়েছিল হিব্রু ভাষা।
পাকিস্তান আমলে তাই আমাদের জাতিসত্তা অক্ষত রাখার গরজে আমরা রবীন্দ্রাশ্রয় কামনা করেছি। বিদেশী বিভাষীর হামলা এড়ানোর জন্যে রবীন্দ্রদুর্গ ছিল সেদিন প্রায় অভয়শরণ। সেজন্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠিত রাখার সংগ্রামে নেমেছিলাম। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিবেশে আমরা সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকারে জীবন শুরু করেছি।
এ সময় আমাদের সামাজিক বৈষয়িক জীবন-চেতনার ও প্রেরণার প্রতিকূল, অকল্যাণকর এবং প্রগতির পথে বাধাস্বরূপ। তাই রবীন্দ্রনাথকে জানতে ও মানতে হবে ঐতিহ্যরূপে সম্পদ হিসেবে নয়। আমাদের চেতনায় রবীন্দ্রনাথ আকাশচুম্বী গৌরব-মিনার হয়ে, আত্মার সমুদ্রসম আধার হয়ে, হিমালয়সম দিগন্তবিসারী ঐতিহ্য হয়ে থাকবেন, কিন্তু সমাজবাদীর নিশ্চিত আশ্রয় কিংবা কেজো সম্পদ হয়ে নয়। আগেরও এরকম নজির রয়েছে।
বাঙলাদেশে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ আবির্ভূত নন। ১৮৬১ সনে তাঁর জন্ম। ১৯৪১ সনে তাঁর মৃত্যু। পাকিস্তান তৈরির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল ১৯৪০ সনে রবীন্দ্রনাথের সামনেই। ১৯৪৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হল পাকিস্তান, তখন রবীন্দ্রসাহিত্য সামনে রেখেই রাম-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গ পরিহার করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলাম আমরা।
আবার ১৯০৫-১১ সনে বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে লিখিত রবীন্দ্রনাথের যে কবিতা-প্রবন্ধ-গান মুসলমানদের প্রভাবিত করেনি, ষাট-সত্তর বছর পরে তা প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়াল কেন—সে রহস্য বিশ্লেষণ করলেও রবীন্দ্র-প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য হবে। আসলে বিভাষী শোষণে বিক্ষুব্ধ আমরা ভাষিক বা আঞ্চলিক জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়েই মনের ও বাঞ্ছার প্রতিচ্ছবি আবিষ্কার করেছি রবীন্দ্র-বাণীতে।
যেমন এ সময় নিজেদের মনের কথা খুঁজে পেয়েছি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। তাছাড়া সমাজবাদ অঙ্গীকার করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু, তাতে রবীন্দ্রপ্রভাবই প্রবল ছিল বললে স্ববিরোধিতা প্রকট হয়ে ওঠে। কারণ রবীন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, রবীন্দ্রপ্রভাব স্বীকার করে মানুষ শাস্ত্রীয় সমাজের অনুগত হয়, আর্থনীতিক সমাজ কামনা করে না।
আজকের দিনে আমাদের সামনে এমনি বাধা আরও রয়েছে, তার মধ্যে ব্রিটিশ আমলের ‘উপমহাদেশীয়’ ধারণা অন্যতম। দেশী মুসলমানরা যেমন প্যান-ইসলামের মোহবশে আরব-ইরানের সীমা অতিক্রম করে স্বদেশের মাটিতে মানসপ্রতিষ্ঠা পায়নি, স্বঘরে চিরকাল ছিন্নমূল প্রবাসীর বিড়ম্বিত জীবনযাপন করেছে; তেমনি বাঙালীরাও দুহাজার বছর ধরে উত্তর-ভারতকেই তার শ্রেয়সের আকর বলে জেনেছে।
ফলে সে কখনো স্বভূমে স্বস্থ হতে পায়নি। তার ঐ মিথ্যা জ্ঞাতিত্ব-চেতনা তার পক্ষে কখনো কল্যাণকর হয়নি, মরীচিকা-প্রবঞ্চিতের বিড়ম্বনাই কেবল সে পেয়েছে। বাঙলাদেশ যে ভৌগোলিক অবস্থানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত, তা আজ আত্মকল্যাণেই স্বীকৃত হওয়া জরুরি।
আমাদের সামাজিক বৈষয়িক-আর্থিক-রাজনৈতিক কারণেও তা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। সুদূর অতীতেও বাঙালীরা ঐ দক্ষিণ-পূর্ব দিকেই আত্মকল্যাণ খুঁজেছে। আত্মবিকাশ ও বিস্তার কামনা করেছে ব্রহ্মদেশে-শ্যামে-মালয়ে শ্রীবিজয়ে বা ইন্দোনেশিয়ায়। অস্ট্রিকরা বাঙলায় একদিন এসেওছিল ঐ পথ ধরেই।
উত্তর-পশ্চিম ভারত বা এশিয়ার সঙ্গে আমাদের ধর্মীয়, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক যোগ চিরকালের বটে, সে ঐতিহ্য-চেতনা ও সংযোগসূত্র বৈষয়িক-রাজনৈতিক জীবনে আমাদের পক্ষে কখনো কল্যাণকর হয়নি। আমাদের জাতিসত্তা সেই মোহবশে স্বতন্ত্র বিকাশের সুযোগ পায়নি। উত্তর-পশ্চিম এশিয়া আজ আমাদের আর কিছুই দিতে পারে না।
বর্ধিষ্ণু জনতার এই দেশের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার গরজে, এই দেশের মানুষের বেঁচে-বর্তে থাকার প্রয়োজনেই আমাদের মুসলিম আরব-ইরান মোহের মতো উপমহাদেশীয় জ্ঞাতিত্ব ও অভিন্ন সত্তামোহ ত্যাগ করতেই হবে। সে-সুবুদ্ধি যত দ্রুত জাগে ততই মঙ্গল।
প্রশ্ন উঠতে পারে নামে কী আসে যায়! দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা চলে নাম বদলের পরিণামও মারাত্মক কিংবা শুভঙ্কর হতে পারে। যেমন, ব্রিটিশ শাসনকে কেউ কখনো খ্রিস্টান শাসন বলেনি, কিন্তু ইংরেজ আমলে তুর্কি-মুঘল শাসনকে মুসলিম শাসন বলে চিহ্নিত করার ফলেই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক বিষময় হয়ে অনেক দুর্ভোগ ও রক্তস্নানের কারণ হয়েছে। তুর্কি-মুঘল নাম ব্যবহৃত হলে ওদের নিন্দা-কলঙ্ক দেশী মুসলিমের গায়ে লাগত না, হিন্দুরাও প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হত না, ব্রিটিশ আমলের পরে যেমন হইনি দেশী খ্রিস্টানের প্রতি।
[ জিগির তত্ত্ব – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: