This post is also available in:
বাংলাদেশ
নারী মাংসের প্রতি লোভ – নামের অধ্যায়ে “দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ” তার “প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া” খান বইটি তুলে ধরেছেন ইয়াহিয়ার চরিত্র। আমাদের এই মার্চে “পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ” এর অংশ হিসেবে তার অনুসন্ধানগুলো তুলে ধরা হবে। পাকিস্তান আমাদের দীর্ঘ ২৩ বছর শোষণ করেছে। তবে সেই শোষণ মূলত করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানি এলিট। তাই পাকিস্তানি শাসন-শোষণ এর চেহারা সম্পর্কে জানার জন্য এদের জীবনাচার সম্পর্কে জানা জরুরী। বইয়ে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সব রকম অন্যায়, অপরাধ। ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত জীবন দেখাতে গিয়ে উঠে এসেছে সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়। “নারী মাংসের প্রতি লোভ” অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন :
নারী মাংসের প্রতি লোভ:
১৯৭২ এর জানুয়ারির তারিখ করাচির বাম ঘরানার আল ফাতেহ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘কালো সুন্দরী’ শিরোনামে একটি স্টোরি করে একদম প্রথম পাতায়। আল ফাতেহ পত্রিকা তাকে বলেছে ইয়াহিয়া খানের চারপাশের ডাইনি প্রতিভা। এই পত্রিকার মাধ্যমেই পাকিস্তানের লোকজন সর্বপ্রথম কালো সুন্দরী নামের এই পতিতা চরিত্র নামের মেয়েটির বিষয়ে জানতে পারে।
ব্ল্যাক বিউটি বা কালো সুন্দরীর নাম এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতেও বেশ কয়েকবার এসেছে। এই কালো সুন্দরীর নাম ছিল মিসেস শামিম কে হুসাইন। পত্রিকায় তার নাম আসার আগেই মোটামুটি তার কানাঘুষা সব জায়গায় শোনা যাচ্ছিল। তবে আল ফাতেহ পত্রিকার উস্কানির মাধ্যমে এই কালো সুন্দরী দীর্ঘদিন পত্রিকাওয়ালাদের কৌতূহল আর রসালো আলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
পাকিস্তান পতনের শেষ দিন পর্যন্ত পররাষ্ট্র বিষয়ক অফিসগুলোতে তার অবাধ বিচরণ ছিল। ঊর্ধ্বতন পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তাদের বদলি, তাদের স্বার্থ রক্ষা, কূটনৈতিকদের আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করা নানাবিধ বিষয়ে সে সরাসরি জড়িত থাকত। যুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত যত রাত হোক না কেন ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলে তার প্রবেশাধিকার ছিল। সে অনায়াসে ঢুকে যেত ইয়াহিয়া খানের কাছে। নিজের স্বার্থ চিন্তা করে সে অনেক কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত পাল্টে দিত।
![নারী মাংসের প্রতি লোভ - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ] 3 পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Zulfiqar Ali Bhutto take over from Pakistani General Yahya Khan ]](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/03/Zulfiqar-Ali-Bhutto-take-over-from-Pakistani-General-Yahya-Khan-পাকিস্তান-জেনারেল-ইয়াহিয়া-খান-300x174.jpg)
‘এই রমণীটি যাকে কেবল মনে করা হতো একজন সাধারণ গৃহিণী, যে ঘরের কাজকর্ম রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারত না এবং বাচ্চাদের লালন পালনই শুধু করত সে শুধুমাত্র ইয়াহিয়া খানের প্রধান নারীই হয়ে উঠল না বরং পাকিস্তানের জটিল সময়ের অংশ হয়ে উঠল। শুধু তাই নয় তাকে মনে করা হতো পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক রানি। এই রকম একজন নারী যখন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রধান হর্তাকর্তা হয়ে উঠে তখন বুঝতে হবে যে আমরা পাকিস্তানিরা ইতোপূর্বে যা করেছি সব ভুল করেছি।’
নাবায়ে ওয়াক্ত নামের আরেকটি বিরোধী পত্রিকা কালো সুন্দরীর নামে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিল। পত্রিকাটি উল্লেখ করে যে ‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক পুরো বিষয়টাকে কালো সুন্দরী একটি অর্থনৈতিক বিষয়ে দাঁড় করেছিল। পররাষ্ট্র বিষয়ে যে কোনো ধরনের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি সে নিয়ন্ত্রণ করত। এই বিষয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে সে টাকা লেনদেন করত।’
কালো সুন্দরীর নামে এই সমস্ত তথ্য বাজারে চালু থাকলেও বিরোধী দল সেনাবাহিনীর মাফিয়া চক্র ও সেনাশাসনের ভয়ে চুপ থাকত।
ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সনে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখন ঢাকায় যান তখনো ব্ল্যাক বিউটি নামটি একবারেই অপরিচিত ছিল। বিষয়টা সত্যিকার অর্থেই কিছুটা অবাক করা যে পাঁচ সন্তানের মা যার দুজন কিশোরী আর একজন একুশ বছর বয়সের যুবক ছেলে- এমন একজন নারীর প্রতি ইয়াহিয়া খান কেন আগ্রহী হলেন।
ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান কালো সুন্দরীর স্বামী জনাব কে এম হুসাইনকে নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে মনোনীত করেন। সেনাবাহিনীর কিছু বিশ্বস্ত তথ্য মতে ইয়াহিয়া খান কালো সুন্দরীর প্রতি যত না আকৃষ্ট ছিলেন তার চেয়ে বেশি তার স্বামী কে এম হুসাইনকে বিশ্বাস করতেন। মিডিয়া যেভাবে কালো সুন্দরীকে ইয়াহিয়া খানের সাথে জড়িত করে বর্ণনা করেছে আসলে বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়।
ইয়াহিয়া খান কালো সুন্দরীর প্রতি শারীরিকভাবে তেমন দুর্বল ছিলেন না। যেমনটা বলা হয় কালো সুন্দরী দেখতে তত আকর্ষণীয় কিংবা সুন্দরী ছিল না। ইয়াহিয়া খানের চারপাশে তখন যত সুন্দরী মেয়েরা ছিল তাদেরকে ফেলে কালো সুন্দরীকে নিয়ে ইয়াহিয়া খান ব্যস্ত হয়ে পড়বেন তেমন আকর্ষণীয়া ছিল না কালো সুন্দরী ।
এটা সত্য ইয়াহিয়া খান যখন যেই নারীর সাথে পরিচিত হয়েছেন তাকেই বিছানায় নিয়ে গিয়েছেন। একই সাথে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পকলায় যারা বোদ্ধা তাদের প্রতিও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেছিলেন। কালো সুন্দরী মিসেস কে এম হুসাইন ছিল জ্ঞানী পণ্ডিত মহিলা। শুদ্ধ ইংরেজি বলতে পারত। শেক্সপিয়ার, বায়রনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল তার। এই দুইজন কবি আবার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রিয় কবি ছিলেন। ফলে কালো সুন্দরীর সাথে মদ পানের আবেশে তিনি এই সব আলোচনাকে খুব উপভোগ করতেন। কালো সুন্দরীর প্রতি তার দুর্বলতার এটাও একটা বিশাল কারণ হতে পারে।
আরেকটা কারণ হতে পারে কালো সুন্দরী ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে খুব বিশ্বাসযোগ্য কাউকে খোঁজ করছিলেন। কারণ ইয়াহিয়া সব সময় ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন যে বাঙালিরা তাকে হত্যা করবে। তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত এমন একজন বাঙালি দেশপ্রেমিককে খোঁজ করছিলেন যে সব সময় তাকে পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে সতর্ক রাখতে পারবে এবং আওয়ামী লীগের বিপজ্জনক কার্যক্রম থেকে তাকে আগাম বার্তা দিতে পারবে। তার এই দুর্বলতা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত আওয়ামী বিরোধী মানুষগুলোর প্রতিই ছিল।
ব্ল্যাক বিউটি সে রকম একজন মহিলা ছিল যাকে বিশ্বাস করা যায়। কালো সুন্দরী আর তার স্বামী কে এম হুসাইন ছিল সেই রকম অল্প কতক বিশ্বাসী পূর্ব পাকিস্তানি যাদের উপর ইয়াহিয়া খান পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিলেন। ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় কালো সুন্দরীর দুর্দান্ত প্রতাপের এটাও একটা বিশাল কারণ ছিল।
ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম আরো কিছু বিষয়ে অজ্ঞাত ছিল। ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত কিছু সহকর্মী যাদের সাথে আমার পরিচিতি ছিল তাদের কাছ থেকে আমি নতুন কিছু বিষয় জানতে পেরেছিলাম। ইয়াহিয়া খান তার বন্ধু মহল ও তার অধীনস্ত ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের সব সময় বলতেন যে একমাত্র কালো সুন্দরীর পরিবারের সাথেই তার পারিবারিকভাবে ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি ইয়াহিয়া খানের ছেলের সাথে কালো সুন্দরীর সন্তানদেরও সব সময় যোগাযোগ থাকত। কালো সুন্দরীর সন্তানদের ইয়াহিয়া খান বেশ স্নেহের চোখে দেখতেন।
‘পপ মিউজিকের প্রতি ভালোবাসা’ কালো সুন্দরীর সাথে ইয়াহিয়া খানের সুসম্পর্কের আরেকটা কারণ ছিল। তারা উভয়েই নিজ নিজ সন্তানদের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতেন। ইয়াহিয়া খান উভয় পরিবারের সন্তানদের আয়োজনে রাওয়ালপিন্ডির ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে মিউজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন। সেখানে নিজে তার ছেলেমেয়ে আর ব্ল্যাক বিউটির ছেলেমেয়ের সাথে নাচ গান করতেন।
প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি পশ্চিমা সংগীতের বিশাল পরিমাণ ডিস্ক নিজের লাইব্রেরিতে সংগ্রহ করেছিলেন।
কালো সুন্দরী নিজের তত্ত্বাবধানে ইয়াহিয়া খানের সংগীত ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিশাল সংগ্রহশালা দেখাশোনা করত।
জেনারেল রানি এদের নিয়ে একটা গল্প বলেছিল। তার দাবি ছিল কালো সুন্দরীকে পূর্ব পাকিস্তানের শত্রুপক্ষ অত্যন্ত সুকৌশলে ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে কালো সুন্দরী ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব দখল নিয়ে নেয়। এমনকি সে পাকিস্তান সরকারের অত্যন্ত গোপন নথির বিষয়ে অনেক কিছু জানত।
কালো সুন্দরী বাঙালি হওয়ার কারণে ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় বেশ ব্যতিক্রম একটা জায়গা দখলে নিতে পেরেছিল।
পাকিস্তানের বিখ্যাত পত্রিকা আল ফাতেহের মতে ইয়াহিয়া খানের হারেমের অন্য সুন্দরীরা যেভাবে শুধু মাত্র শরীরের জন্য ব্যবহৃত হতো কালো সুন্দরী তেমনটা ছিল না। কালো সুন্দরী বাঙালি ছিল একই সাথে অত্যন্ত শিক্ষিত ইংরেজি জানা ও শিল্প সাহিত্যের বিষয়ে পাণ্ডিত্য ছিল। ফলে তার অবস্থানটা ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় আর স্পর্শকাতর। তাকে নিয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। সে ছিল সবার মধ্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
পাকিস্তানের নাবায়ে ওয়াক্ত একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল যে ইয়াহিয়া খানের শেষ মুহূর্তগুলোতে পররাষ্ট্র বিষয়ে একমাত্র জেনারেল পিরজাদা যিনি তখন ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র দফতর দেখাশোনা করতেন তিনি ছাড়া আর কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র পত্রিকা তখন কালো সুন্দরীর এই ক্ষমতার বিষয়টাকে ছাপতে সাহস করেছিল।
যাই হোক ১৯৭১ এর এপ্রিল থেকে ইয়াহিয়া খানের সাথে কালো সুন্দরীর সম্পর্ক সুদৃঢ় হতে শুরু করে যা বজায় থাকে ইয়াহিয়া খানের পতন পর্যন্ত।
![নারী মাংসের প্রতি লোভ - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ] 6 পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/03/Pakistani-General-Yahya-Khan-পাকিস্তান-জেনারেল-ইয়াহিয়া-খান-45-266x300.jpg)
জেনারেল রানির মতে এই কালো সুন্দরীই ইয়াহিয়া খানের হাত দিয়ে পাকিস্তানের পতন ডেকে এনেছিল।
কালো সুন্দরী নিজের শারীরিক চমৎকারিত্ব আর বুদ্ধিবৃত্তি এবং জ্ঞান দিয়ে নিজের স্বামীকে প্রেসিডেন্ট হাউসের চিফ সিভিলিয়ান সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে মনোনয়ন দেয় এবং তার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাকে অস্ট্রেলিয়াতে পাঠায়। অবশ্য কারো কারো মতে ইয়াহিয়া খান নিজেই উদ্যোগী হয়ে কালো সুন্দরীর স্বামী জনাব কে এম হুসাইনকে অস্ট্রেলিয়াতে নিয়োগ দেন। যাতে করে ইয়াহিয়া খান পরিপূর্ণভাবে কালো সুন্দরীকে নিজের হাতের মুঠোয় সব সময়ের জন্য পেতে পারেন।
প্রত্যাশিতভাবে কালো সুন্দরী এটা চাইছিল। ইয়াহিয়া খান কালো সুন্দরীকে পররাষ্ট্র অফিসে বিশেষ দায়িত্ব দেন। কী ধরনের বিশেষ কাজ তিনি করতেন সেটা কেউ বলতে পারে না। পররাষ্ট্র বিষয়ে কালো সুন্দরীর নানা ধরনের কাজের কথা আমরা এর মধ্যে বলেছি। ইয়াহিয়া খানের সুন্দরী রমণীদের মধ্যে একমাত্র কালো সুন্দরীই খুব ভালো ইংরেজি বলতে পড়তে আর লিখতে পারত। সেজন্য জেনারেলদের কাছে পররাষ্ট্র বিষয়ে যত ফাইল আসত সবগুলো ফাইলে কালো সুন্দরী চোখ বুলাত।
ইয়াহিয়া খানের একটা অভ্যেস ছিল তিনি নিজের ঘরে বসে রাত দশটার পর এই সব ফাইলগুলোতে চোখ বুলাতেন। তখন কালো সুন্দরী তার সাথে পররাষ্ট্র বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করত।
যখন সব কিছু শেষ হয়ে আসছিল আর যুদ্ধের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল তখন ইয়াহিয়া খান কালো সুন্দরীকে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবশ্য তিনি অভ্যুত্থানের কারণে দায়িত্ব নিতে পারেনি। সুইস গভর্নমেন্টও এই ধরনের দায়িত্বে কালো সুন্দরীর মতো একজনকে মনোনয়নের বিষয়ে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল।
অসংখ্য পাকিস্তানি মনে করে যে ইয়াহিয়া খানকে শুধু শারীরিক সঙ্গ দিতেই কালো সুন্দরী ছিল না বরং একই সাথে বসের জন্য নানা চাহিদার সুন্দরীদের যোগান ও বসের শিল্প সংস্কৃতিগত আত্মার খোরাকের যোগান দেয়ার কাজটাও সে করত।
এটা অবশ্য দারুণ মজার বিষয় যে ইয়াহিয়া খানের সাথে যে সমস্ত নারী তার যৌন জীবনের সাথি হয়েছিল তারা আদর্শগত কারণেই ইয়াহিয়ার সাথে থাকত। এবং ইয়াহিয়া খানের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করত। ইয়াহিয়া খান নিজে অবশ্য কখনো কোনো সুন্দরীকে প্রতারণাপূর্ণভাবে কিংবা ছিনালি করে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেননি। কথাটা ইয়াহিয়ার পক্ষে চলে যায়।
![নারী মাংসের প্রতি লোভ - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ] 7 পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/03/Pakistani-General-Yahya-Khan-পাকিস্তান-জেনারেল-ইয়াহিয়া-খান-44-300x247.jpg)
তবে এটাই সত্য ছিল। এই রকম কোনো অভিযোগ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়নি যে সুন্দরী রমণীরা অতীতে ভালো ছিল কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সাথে মিশে তারা নষ্ট হয়ে গেছে। বরং ইয়াহিয়া খানের সাথে মেশার আগেই তাদের চরিত্র খারাপ ছিল।
কালো সুন্দরী মিসেস হোসাইনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমি (গ্রন্থের লেখক) নিজে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার খুব উচ্চ পদস্থ এক বন্ধুর কাছ থেকে। শুনেছিলাম যে কালো সুন্দরীর স্বামী জনাব হোসাইন ইসলামাবাদে বদলি BB হওয়ার আগেই মিসেস হোসাইনের ছিনালিপনার কানাঘুষা ঢাকায় শোনা যাচ্ছিল। আমেরিকান তেল কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে তার দহরম ছিল ঢাকার উচ্চবিত্ত সমাজের রসালো আলাপের অংশ।
ইয়াহিয়া খানের সাথে পরিচিত হওয়ার আগেই কালো সুন্দরী তার আমেরিকার বন্ধুর নিমন্ত্রণে আমেরিকা থেকে ঘুরে এসেছিল।
১৯৭২ এর মার্চ মাসে লাহোরের নাবায়ে ওয়াক্ত পত্রিকা কালো সুন্দরী আর ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে নতুন একটা সংবাদ প্রকাশ করে যা ইয়াহিয়া খান ও কালো সুন্দরীর লাম্পট্যময় সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছিল।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ইয়াহিয়া খানের বড় ছেলে পঁচিশ বছরের আলী ইয়াহিয়া কালো সুন্দরীর জন্য প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। সে প্রায়ই রাওয়ালপিন্ডির হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কালো সুন্দরীর অভিজাত ফ্লাটে ঘুরতে যেত। ততদিনে কালো সুন্দরী মিসেস হোসাইনকে তার ছেলেমেয়েরা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ছেলেমেয়েরা আলাদা বাংলো নিয়ে সেখানে বসবাস করত।
ডিসেম্বরের এক সকালে ইয়াহিয়া খান আর তার ছেলে আলী ইয়াহিয়া দুজনেই কালো সুন্দরীর জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। ইয়াহিয়া খান কালো সুন্দরীর জন্য অস্থির হয়ে তার বাংলোতে গিয়ে নিজের ছেলেকে দেখতে পান। তখন তিনি ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ছেলেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তার ছেলে চলে যেতে রাজি হয়নি। ইয়াহিয়া খান সে সময় ছেলের বেয়াদবি সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে বন্দুক দিয়ে তাড়া করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে যে এই সময় কালো সুন্দরীর হস্তক্ষেপে বিষয়টার মীমাংসা হয়। কালো সুন্দরী ছেলেকে চলে যেতে বলে।
![নারী মাংসের প্রতি লোভ - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ] 8 পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/03/Pakistani-General-Yahya-Khan-পাকিস্তান-জেনারেল-ইয়াহিয়া-খান-43-300x251.jpg)
একই সাথে আরো কিছু পত্রিকা এই সময় বলে যে ইয়াহিয়া খানের ছেলে আলী ইয়াহিয়া বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সাথে দেখা করে তার বাবার চরিত্রের বিষয়ে নানা রকম কথা বলে বেড়ানো শুরু করেছিল। ঘটনা শুনে ইয়াহিয়া খান ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেকে গভর্নমেন্ট হাউসে ঢোকা নিষেধ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় হাউসের আশপাশে তাকে দেখলে কারাগারে পাঠানো হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন।
পুরো পরিস্থিতিটা তখন বেগম ইয়াহিয়া নিজে সামাল দিয়েছিলেন। বেগম ইয়াহিয়া ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধার্মিক আর পরহেজগার ছিলেন। ছেলে আর পিতার সম্পর্ক এবং যেভাবে তাদের পদস্খলন হয়েছিল সেটা নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পিতা-পুত্রের অধপতনকে তিনি পুরো জাতির জন্য একটি দুর্যোগ বলে মনে করতেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের আমার খুব ভালো একজন বন্ধু যে কিনা পাকিস্তানে বেশ সুদৃঢ় অবস্থানে ছিলেন আমাকে কালো সুন্দরীকে নিয়ে পিতা-পুত্রের মাঝে যে বৈরী সম্পর্ক চলছিল সে বিষয়ে একটা ঘটনা বলেছেন। আমি দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়াতে এই বিষয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম।
আমার বন্ধুর তথ্য মতে ইয়াহিয়া খানের ছেলে আলী ইয়াহিয়া কালো সুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট ছিল না। বরং সে কালো সুন্দরীর উনিশ বছরের কন্যার জন্য উন্মাদ ছিল। তাদের দুজনকে বেশ কয়েকবার বিব্রতকর অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
কালো সুন্দরী তখন ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে বিষয়টা মিটমাট করতে চেয়েছে। তিনি আরো বলেন যে ইয়াহিয়া খান মাঝে মধ্যে ইন্টার কন্টিনেন্টালে কালো সুন্দরীর সাথে দেখা করতে আসতেন। তবে ইয়াহিয়া খান আর তার ছেলের মধ্যে কালো সুন্দরীকে নিয়ে যে নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা নাবায়ে ওয়াক্ত উল্লেখ করেছিল সেটার আসলে কোনো ভিত্তি নেই।
নয়া দিল্লির সাথে পাকিস্তানের একটি উচ্চতর বৈঠকের সময় আমি পাকিস্তানের সদস্যদের সাথে আসা একজন সাংবাদিক বন্ধুকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন নাবায়ে ওয়াক্ত ইয়াহিয়া খান আর তার ছেলের সাথে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার সত্যতা আছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের মনোনীত আরো অনেক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন যারা তাদের বসের ইমেজকে অটুট রাখতে সব সময় চেষ্টা করেছেন। এবং সব সময় বলেছেন কালো সুন্দরীর সাথে ইয়াহিয়া খানের কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিল না।
আমার সাংবাদিক বন্ধু বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন যে বাবা আর ছেলে দুজনেই নারী আর মদের বিষয়ে উন্মাদ ছিলেন। তাদের মধ্যে যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আলী ইয়াহিয়া যখন দেখল যে কালো সুন্দরী কেবল তার বাবার জন্যই কাজ করছে এবং কালো সুন্দরীকে কোনোভাবে নিজের জন্য বাগে আনা যাবে না তখন সে নিজের চাইতে দ্বিগুণ বয়সী নারীদের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করল। বাপ আর ছেলের মাঝ খানে কালো সুন্দরী যেন তাদের যৌন জীবনের একটা মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
![নারী মাংসের প্রতি লোভ - জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ] 9 পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান [ Pakistani General Yahya Khan ]](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/03/Pakistani-General-Yahya-Khan-পাকিস্তান-জেনারেল-ইয়াহিয়া-খান-40-268x300.jpg)
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কালো সুন্দরী ছিল একমাত্র বাঙালি নারী যে যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের নানা পরিবর্তনের পরেও নিজের ক্ষমতাকে ধরে পেরেছিল। এমনকি তার স্বামী নিজ কাজে ফিরে আসার পর এবং কালো সুন্দরী পররাষ্ট্র বিষয়ক সমস্ত কাজ থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও রাওয়ালপিন্ডিতে বেশ দাপটের সাথেই বসবাস করত। শুধু তাই নয় নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথেও বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল তার।
পাকিস্তানের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো কালো সুন্দরীর এই ধরনের জীবন যাপনের কারণে তাকে ডাকত ক্লিওপেট্টা অব পাকিস্তান নামে।
শোনা যায় যে, সে ১৯৭১ এর আগস্টের পর মধ্য ইয়োরোপে চলে যায়। সেখানেই তার স্বামী সন্তানসহ বসবাস করতে শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের সরকার নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে বললেও সে তাতে সাড়া দেয়নি। পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়েই সেখানে থেকে যায়।
আমার মতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে তার আসলে করার মতো কিছু ছিল না। বাংলাদেশের সংগ্রামেও তার করার মতো কিছু ছিল না। কারণ বাংলাদেশের দেশ প্রেমিক মানুষ কিছুতেই তাকে গ্রহণ করত না। বরং তার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা ছিল সকলের। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সংগ্রামের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তাকে হত্যা করার জন্য একবার আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল।
বাংলাদেশের আমার বন্ধুরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের দোসররা বাংলাদেশের উপর যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল তা থেকে কিছুটা হলেও ইয়াহিয়া খানকে রক্ষা করার জন্য কালো সুন্দরীকে সামনে নিয়ে এসেছিল।
তথ্যসূত্র:
বই : প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান
লেখক : দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ [ নির্মল পরিচ্ছন্ন অকপট ভাষায় এক দুঃসাহসিক কলমের অভিযান হলো ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ । ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার লেখনীর ভিতর দিয়ে একজন প্রাক্তন সামরিক স্বৈরশাসক, যৌনদানব, মাতাল, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলের অবিশ্বাস্য সব জানালা খুলে দিয়েছেন । সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে লেখালেখি করতেন । ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন সময় এবং এর পূর্বে ইয়াহিয়া খানের ভূমিকা, তার অন্ধকার জীবনের নানাদিক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে লেখক ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ বইটিতে লিখেছেন ।
অনুবাদ : রফিক হারিরি
আরও পড়ুন:
This post is also available in:
বাংলাদেশ
“নারী মাংসের প্রতি লোভ – জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ]”-এ 1-টি মন্তব্য