বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ,  ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? অ্যাই বেয়াদবি করছিস কেন?’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নিহত হবার পূর্বে হামলাকারি সেনাসদস্যদের উদ্দেশে এ কথা বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গ-বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, বঙ্গবন্ধু’র বাসায় অবস্থান করা তার ব্যক্তিগত সহকারি আব্দুর রহমান শেখ রমা বাসসের সঙ্গে টেলিফোনে   সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এ কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ

 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ

 

তিনি বলেন, সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান শেখ কামালকে হত্যার মধ্যদিয়ে হত্যাযজ্ঞের শুরু, আর সর্বশেষে হত্যা করা হয় শিশু শেখ রাসেলকে। ওই দিন ঘাতকের দলকে বঙ্গ-বন্ধুর অভিভাবকসুলভ উচ্চারণ যেমন থামাতে পারেনি, তেমনি থামাতে পারেনি শিশু রাসেলের আকুতিও। ১৯৬৯ সাল থেকে ওই পরিবারে কাজ করতেন, ’৭১-এ ওই পরিবারের সঙ্গে ছিলেন এবং বঙ্গ-বন্ধু হত্যার দায়ে যে মামলা করা হয় তার দ্বিতীয় সাক্ষী এই রমা। ১৫ আগস্ট, ভোররাতে ধানমন্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার দিনে যে ঘরে বঙ্গ-বন্ধু ছিলেন তার বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন রমা।

তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। খুব কাছে থেকে তিনি দেখেছেন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পর অনেক দিন পালিয়ে বেড়িয়েছেন ভয়ে। এখনও থাকেন অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। বঙ্গ-বন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর মনে জমে থাকা ক্ষোভ আর কষ্টের ভার কিছুটা লাঘব হলেও সেদিনের বীভৎস দৃশ্যের স্মৃতি মনে হলে এখনও স্থির থাকতে পারেন না তিনি।

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

রমা ১৫ আগস্ট কালরাতের কথা বর্ণনা করে বলেন, সেদিন ভোররাতের আগেই বঙ্গ-বন্ধু তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে যান। তখন উপর থেকেই বঙ্গ-বন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী প্রয়াত এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা হামলা করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। কিন্তু, তখন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেও কোনো সাড়া শব্দ পাননি মহিতুল।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ

 

‘সেদিন ভোর রাতে বাড়িটির দিকে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গ-বন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। বেগম মুজিবের কথায় আমি নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে এসে দেখি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গ-বন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। তখন আমি বাড়ির ভেতরে ফিরে গিয়ে দেখি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গ-বন্ধু নিচ তলায় নামছেন,’ জানান রমা।

তিনি বলেন, পরে আমি দ্রুত দোতলায় গিয়ে দেখি, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। তখন আমি সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তিনতলায় চলে যাই এবং শেখ কামাল ভাই ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। তখন দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পড়ে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায়। পরে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে তারা দ্রুত জামা-কাপড় পরে বেগম মুজিবের কক্ষে যান।’

গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল ইসলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গ-বন্ধু নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’। বঙ্গ-বন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালার কাঁচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। বঙ্গ-বন্ধু তখন টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন।

এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গ-বন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গ-বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ ?’ -এ কথা বলেই বঙ্গ-বন্ধু উপরে চলে যান।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ

 

বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ান। তখন কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে।

সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। আব্দুর রহমান রমা বলেন, নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’

পরে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে।

হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ

 

মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গ-বন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস?  কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গ-বন্ধুকে গুলি করে।

রমা জানান, দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে রাসেল এবং তাকে যখন নীচে নিয়ে আসা হয়। তখন রাসেল বলছিলো ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো? এরকম শিশুকে নিশ্চয়ই খুনিরা মারবে না আশায় মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন: ‘না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না’। পরে রাসেল বলে, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো।’ পরে এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলির এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। এর পর ওই হাবিলদার নীচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে-‘স্যার, সব শেষ।’ এর আগে আজিজ পাশা এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment