This post is also available in:
বাংলাদেশ
সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] – আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif ] : অন্য সব চিন্তা ও কর্মের মতো সাহিত্যও জীবন থেকে উৎসারিত। সাহিত্য জীবনেরই গান। জীবন হচ্ছে অনুভূতির প্রবাহ। তাতে রয়েছে সুখ-দুঃখ, ভয়-ভরসা, বিস্ময় কল্পনা ও আনন্দ-যন্ত্রণা। আদিকাল থেকেই অনুভব-তাড়িত মানুষ তার আবেগ ব্যক্ত করেছে, সে-প্রকাশ সুষ্ঠু ও সুন্দর হলে তা সর্বজনীন ও চিরন্তনতার দাবিদার হয়ে ওঠে। অবশ্য ভাব-ভাবনা সর্বজনীন ও চিরন্তন হলেও তার অবলম্বন বা আবেগবাহন স্থানে কালে ও পাত্রে বিভিন্ন ও বিচিত্র হয়, জ্ঞান-বুদ্ধি-রুচির স্বাতন্ত্র্যে মানুষের মন-মনন কিংবা মত-মর্জির পার্থক্য ঘটে। তাই সাহিত্যের রূপ ও রস, অঙ্গ ও অঙ্গী বিবর্তিত হয়েছে, অভিব্যক্তির আধার বা অবলম্বনও পেয়েছে রূপান্তর।
![সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] - আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif 2 সাহিত্যের বিবর্তন - আহমেদ শরীফ](http://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/আহমদ-শরীফ-236x300.jpg)
আদিকালে অজ্ঞ মানুষ ছিল প্রকৃতি-নির্ভর, তাই তাদের রচনায় পাই প্রকৃতি-প্রতীক দেও-দেবতার কথা। ভয়-ভরসা-বিস্ময়ের প্রেরণায় অসহায় মানুষ সেদিন কেবল তোয়াজ-স্তুতিই করেছে আত্মরক্ষার তাগিদে। তারপর মানবিক বোধ-বুদ্ধি ও শক্তির বিকাশ ধারায় মানুষের বক্তব্য বদলেছে বারবার। এইভাবে দেবকথা, রূপকথা, উপকথা হয়ে সাহিত্য আজ রূঢ় জীবন-কথায় এসে পৌঁছেছে।
অন্য সব রচনা থেকে সাহিত্য পৃথক। সে-পার্থক্য রূপগত ও রসগত। সূচিত শব্দের সুবিন্যাসে যে-ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি হয়, তা-ই তার লাবণ্য এবং পরিমিত ধ্বনির পৌনঃপুনিকতা থেকে জন্মে ছন্দ। এই পরিমিতি, মধ্যমিল, অন্ত্যমিল প্রভৃতি ধ্বনিবিন্যাসের নানা নৈপুণ্যে বৈচিত্র্য এসেছে ছন্দে।
এই কাব্য-অবয়বে নানা আভরণ যুক্ত হয়েছে কালে কালে। স্বল্পবুদ্ধি শিশু যেমন কেবল রাঙা বস্তুতে আকৃষ্ট হয়, তেমনি সংস্কৃতির শৈশবে মানুষের কাব্য-ছন্দ ও বক্তব্য ছিল অমার্জিত ও স্থুল। মোটা রুচির মানুষ একসময় অলঙ্কারবাহুল্যের মধ্যেই নারী সৌন্দর্য আবিষ্কার করত। আজ সংস্কৃতিবান মানুষ নিরাভরণার লাবণ্যে মুগ্ধ। এই মানুষই আজ কাব্যদেহও নিরাব ছন্দে বাঁধা গতের অলঙ্কারে তার রুচি নেই। জীবন তথ্যের ও অনুভব-তত্ত্বের আর নিরাভরণ দেখতে চায়। তাই পূর্বের মিলান্ত আবেগগত অভিব্যক্তির আধার বলে কাব্যের রসও তাই রসিকবেদ্য। কাব্য জ্ঞান বাড়ায়। না, অনুভবের দিগন্ত প্রসারিত করে, চিত্তাকাশের বিস্তার ঘটায়।
![সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] - আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif 3 সাহিত্যের বিবর্তন - আহমেদ শরীফ](http://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/Ahmed-Sharif.jpg)
লোকে বলে, আদিকালে নিরক্ষর মানুষ শ্রুতি-স্মৃতির প্রয়োজনে বক্তব্য ছন্দোবদ্ধ করত এবং বঞ্চিত-বিড়ম্বিত জীবনে কাম্য সাধ মিটাবার জন্য প্রবৃত্তিসঞ্জাত কল্পনা-মুখ্য রসচর্চা করত। এতে কোনো তথ্য নেই। সত্য এই যে, মানুষের চিন্তা ও কর্ম মাত্রই ছন্দ-সংলগ্ন। রুচিবৈচিত্র্যে স্থুল কিংবা সূক্ষ্ম রূপান্তর ঘটেছে মাত্র। মোটাবুদ্ধির ও স্থূলদৃষ্টির উদাসীন মানুষ কেবল কাব্যের ক্ষেত্রে নয় জীবনের অন্য এলাকাতেও ছন্দ আবিষ্কারে চিরকাল অসমর্থ।
সাহিত্যের গদ্যে-পদ্যে ছন্দ চিরকাল ছিল, এবং চিরকাল থাকবে, তার বাহারূপ যেমনই হোক না কেন। আগে সব কথা পদ্যে লেখা হত, তাই পাঁচালি-মহাকাব্য গড়ে উঠেছে। আজকাল একটি আবেগই কবিতায় ব্যক্ত হয়, তাই কবিতা আকারে ছোট। আগে সবটাই সুর করে গাওয়া হত, তাই বিশেষ ছন্দ ও সুর তালের প্রয়োজন হত। আজকাল গাওয়ার জন্য আলাদা গান বাঁধা হয়, মন ও মর্জিভেদে সে-গানের ছন্দ, সুর ও তাল হয় বিচিত্র ও নতুন।
![সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] - আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif 4 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
সাহিত্য বা কাব্যরসও কখনো জীবন-বিচ্ছিন্ন ছিল না, জীবনপরিবেশ-অনুগই ছিল । প্রকৃতিনির্ভর অসহায় মানুষ দৈবানুগ্রহজীবী ছিল বলেই তার জীবনে দেবতা ও নিয়তি ছিল নিত্যসহচর, তাই তার জীবনকথা হয়েছে নিয়ন্তা ও নিয়তি নিয়মিত। তার জীবনের আনন্দ-যন্ত্রণার আকস্মিকতা সে ঐভাবেই ব্যাখ্যা করেছে।
অজ্ঞ-অক্ষম মানুষ ভয়ে বিস্ময়ে তাকিয়েছে বিরাট বিচিত্র আকাশ ও পৃথিবীর পানে। তার অসংখ্য জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার প্রয়াসপ্রসূত ভূতপ্রেত, দেও-দানু, হুরপরী, রাক্ষসখোক্ষস স্থিতি পেয়েছে তার বিশ্বাসে সংস্কারে। তাই তার সাহিত্যও হয়েছে ঐ বিশ্বাস-সংস্কারের আকর। অদৃশ্য অরি ও মিত্রশক্তি হয়েছে তার জীবনে সংলগ্ন।
![সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] - আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif 5 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-5-242x300.jpg)
কালের চাকা ঘুরেছে। মানুষের আত্মশক্তি জেগেছে। প্রকৃতির প্রভু হয়েছে সে। কলে-কৌশলে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রত্যয়ে প্রজ্ঞায় হয়েছে সে পাকা, তাই তার মন-মনন থেকে ফলে তার সাহিত্য থেকে দেও দেবতা, রাক্ষস-খোক্ষস গেছে উবে। বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সরকারি, সামাজিক ও আর্থিক তথা জীবিকাগত প্রতিবেশে তার সাহিত্যের অঙ্গগত, রসগত, বিষয়গত, বক্তব্যগত রূপান্তর ঘটেছে। এমনি করে চিরকাল ঘটবে। যেমন সুখী সমাজের সুখী মানুষ ফুল-পাখি-প্রেম-প্রকৃতি ও বিশ্বতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, মনস্তত্ত্বের মধ্যে ভাব-ভাবনা নিয়োজিত রাখবে; দুঃখী মানুষ ভাত-কাপড়ের অভাবজাত যন্ত্রণার কথা লিখবে; নিপীড়িত দরিদ্র মানুষ শোষণ-পেষণের বিরুদ্ধে এবং বণ্টনে বাঁচার কথা বলবে, বিপ্লবের সময় বিদ্রোহের বাণী শুনাবে এবং যুক্তকলে উত্তেজনাকর গান গাথা হবে রচিত।
যেহেতু কোনো দেশে কালে সব মানুষ সমভাবে বিকশিত থাকে না, জ্ঞান বুদ্ধি-রুচি কখনো অভিন্ন হয় না, সেজন্য যে-কোনো দেশে ও কালে সামগ্রিক জবীন প্রবাহে নানা বিরুদ্ধ মত ও মনের দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান অবশ্যম্ভাবী, কেউ শাস্ত্রীয় জীবনে, কেউ সরকার-তোষণে, কেউ সমাজানুগত্যে যেমন ইষ্ট কামনা করবে; তেমনি বিচলনে, দ্রোহে, নয়া মত-পথের সন্ধানে, জীবন ও সমাজের তাৎপর্য সন্ধিৎসায়ও থাকবে নিরত। উল্লেখ্য যে, নতুন সূর্য নতুন মন, নতুন মানুষ তৈরি করে। আবর্তন নয় বিবর্তন ও পরিবর্তনই জগতের ও জীবনের নিয়ম। আবর্তনে স্থানকাল বদলায় কিন্তু বিকাশ বা উন্নতি হয় না, বরং জীর্ণতা ও জড়তা আসে ঐ পথেই।
![সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] - আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif 6 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](http://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-4-232x300.jpg)
আমাদের কাব্যের বিকাশধারায়ও ঐসব লক্ষণ বিদ্যমান, দস্তুর ভঙ্গে কেবল নির্বোধই খেপে ওঠে, মনে করে অনাচার। কাজেই বিগত দিনের কাব্য যেমন আজ অচল, আজকের কাব্যও তেমনি আগামীকালের কোনো প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে না। শুধু কাব্যের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই কোনো পুরোনো নতুনের চাহিদা মিটাতে পারে না, কোনো অতীত পারে না বর্তমান হতে। নতুন দিনে, নতুন পরিবেশে নতুন মানুষের কণ্ঠে স্বকালের মানুষের মনের কথা, প্রয়োজনের কথা, কামনা-বাসনার কথা ধ্বনিত হবে। সে-উচ্চারিত বাণীর রূপ, রস ও সুর হবে ভিন্ন। এভাবেই তো মানুষের সমাজ-সভ্যতা এগিয়েছে। এরই নাম চলমানতা ও প্রগতি।
[ সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] – আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif ]
আরও পড়ুন:
This post is also available in:
বাংলাদেশ
“সাহিত্যের বিবর্তন [ Evolution of literature ] – আহমদ শরীফ [Ahmed Sharif”-এ 4-টি মন্তব্য