ডাঃ ক্যাপ্টেন আবুল কাসেম । বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ

ডাঃ ক্যাপ্টেন আবুল কাসেম (২৮ জুন ১৯২০ – ১১ মার্চ ১৯৯১) একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজসেবক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্থপতি এবং তমদ্দুন মজলিস ও বাঙলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা।

ডাঃ ক্যাপ্টেন আবুল কাসেম । বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ

 

ডাঃ ক্যাপ্টেন আবুল কাসেম । বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ

 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

মোহাম্মদ আবুল কাসেম ১৯২০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে “বরমা ত্রাহি-মেনকা উচচ বিদ্যলয়” থেকে তিনটি বিষয়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৪১ সালে “চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ” থেকে আই এস সি-তে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

পরবর্তীকালে তিনি ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক ও ১৯৪৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বিখ্যাত গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অধীনে স্নাতকোত্তরের থিসিস করেন।

কর্মজীবন

ভাষা সৈনিক আবুল কাসেমকে প্রদানকৃত একুশে পদকের সনদ। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। প্রভাষক হিসাবে তিনিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ক্লাস নেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি প্রভাষক পদে ছিলেন। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম এদেশের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গণে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব ৷ ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের লক্ষে বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষা দানের জন্য তিনি বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন ৷

তিনি বাংলায় ৪০টি পাঠ্য পুস্তক রচনা করেন এবং বাংলা একাডেমী, আর্ট কলেজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সিটি কলেজসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সহিত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন ৷ তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য থাকাকালীন ১৯৫৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রথম সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ও সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহীত হয়৷ তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি এবং পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা সৃষ্টি হয়, তিনি সে আন্দোলনের পথিকৃৎ্ ছিলেন৷ ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম ছিলেন বাংলা ভাষার জাগ্রত বিবেকতুল্য ৷

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

সাহিত্যকর্ম

একজন প্রতিভাবান লেখক, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্য এবং শিক্ষা, ইসলাম, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিজ্ঞানের পাঠ্যবই সহ প্রায় ১০০টি বই রচনা করেন। এর মধ্যে ৪০টি পদার্থবিদ্যার পাঠ্যবই এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয় রয়েছে।

বাংলা ভাষা আন্দোলন

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে, এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়।

এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

 

ডাঃ ক্যাপ্টেন আবুল কাসেম । বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে।

গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।

২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment