বিড়ম্বিত প্রত্যাশা [ Embarrassing expectations ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : বর্ষণের পূর্বে যেমন মেঘাড়ম্বর আবশ্যিক, গাওয়ার আগে যেমন রাগ ও সুর নিরূপণ করতে হয়, তেমনি সর্বপ্রকার কর্ম ও আচরণের পিছনে থাকে ভাব, চিন্তা, চেতনা ও পরিকল্পনা। আগে পরিকল্পনা, পরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। আগে স্বপ্ন ও সাধ, জীবনে তার রূপায়ণ-প্রয়াস। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির যেমন প্রস্তুতি প্রয়োজন, তেমনি তা ভোগের জন্যেও যোগ্যতা দরকার।
আমরা যখন শোষণমুক্তি লক্ষ্যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে যেয়ে নানা কারণ-ক্রিয়ার যোগসাজসে স্বাধীনতাই পেয়ে গেলাম, তখন আমরা প্রায়ই দিশেহারা। একপ্রকারের বিমূঢ়তা বা অভিভূতি আমাদের পেয়ে বসল। এ অভিভূতি আনন্দের নয়, বেদনার নয়, বিক্ষোভেরও নয়। এ হচ্ছে আকস্মিকতার অনুভূতি, অপ্রত্যাশিতের বিমূঢ়তা।
গোড়ায় আমরা শোষণমুক্তি চেয়েছি, ন্যায্য ভাগ ও অধিকার দাবি করেছি, স্বাধিকারের সংগ্রামে মেতেছি অসূয়াতপ্ত চিত্ত নিয়ে। তাতে উত্তেজনা ছিল, উদ্দীপনাও ছিল; ছিল না কেবল সৃষ্টি-সম্ভব কল্পনা। যে প্রলয়ে নূতন সৃজন-সম্ভব, তা ‘জীবনহারা অসুন্দরে’ লয় করেই নবজীবনের উন্মেষ ঘটায় এবং সে জীবন দূর্বার মতো প্রাণের ঐশ্বর্যে দ্রুত আত্মপ্রকাশ করে ও আত্মবিকাশে চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আমাদের যে-স্বপ্ন ও যে-সাধ ছিল না, যা কৃত্রিমভাবে চিত্তলোকে জাগিয়ে তোলার মুহূর্তেই সিদ্ধি অভাবিতরূপে হাতের মুঠোয় এসে গেল, তখন সে স্বপ্ন ও বাস্তব এবং সাধ-সাধ্য ও সাধিত একাকার। মানস-প্রস্তুতি ছিল না বলেই আমরা এমন অচিন্ত্য সৌভাগ্যের মুহূর্তেও আকস্মিকতার শিকার হয়ে স্বাধীনতার মতো দুর্লভ ঐশ্বর্যের চেতনা, বিরল সম্পদের প্রসাদ অনুভবগত করতে পারলাম না।
চিত্তলোকে যখন আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং যখন তা জীবনস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়, তখন তার বাস্তবায়নের সাধ জাগে, সে-সাধ ঐকান্তিক ও নিষ্ঠা হয়ে চরিত্রে সাংকল্পিক দৃঢ়তা আনয়ন করে। এমনিভাবে চরিত্র থেকে সংকল্প, সংকল্প থেকে শক্তি এবং শক্তি থেকে সিদ্ধি আসে। এটি আমাদের ছিল না। তারই ফলে আমাদের উল্লাসের মুহূর্তগুলো দ্রুত উবে গেলেও বিমূঢ়তা বা অভিভূতির
ঘোর দুবছরেও কাটেনি। যারা নিতান্ত অবুঝ সেই অকপট নিরক্ষর গণমানুষ কারো আহবানে কখনো। ফেরুপালের মতো সমবেতকণ্ঠে উল্লাসধ্বনি তুলেই তুষ্ট ও তৃপ্তন্মন্য। কখনোবা কাকের মতো প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ। দুটোই ক্ষণিক ও সাময়িক এবং নির্লক্ষ্য ও পরিণামশূন্য।
সাক্ষর-সরল সাধারণ লোকেরা ঘরে-ঘাটে কখনো বিস্মিত, কখনো বিক্ষুব্ধ, কখনো আশ্বস্ত, কখনোবা ভীত-শঙ্কিত হয়ে চারদিককার চালাকির লীলা প্রত্যক্ষ করেও প্রাত্যহিকতার চাকায় নীরবে ঝুলছে।
সাক্ষর চালাকেরা ঐকতানিক তত্ত্বে নিষ্ঠ। ওরা কুশলী বহুরূপী। সময় ও সুযোগ জ্ঞানে ওরা জ্যোতিষীর চেয়েও পাকা। ক্ষণ-তিথি-লগ্নমাফিক ওরা ঝোপ বুঝে কোপ মারতে ওস্তাদ। লাভের লোভের বশে ওরা প্রয়োজনমতো বোল ও ভোল পাল্টাতে পটু এবং ভেলকিবাজিতে অনন্য। সমাজে এদের সংখ্যাই বেশি এবং এদেরই দুর্নীতির শিকার ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র।
এদের অনুচর-অনুষঙ্গী রয়েছে অনেক এবং প্রতিদিন এদের দল যারা ভারী করছে, তারা স্বভাবে তোতাপাখি-অনুকারী। এদের দেশ-কাল শাস্ত্র-সমাজ-রাষ্ট্র কোনোটার প্রতিই কোনো বিশেষ আগ্রহ নেই-আত্মরতি ও আত্মসুখের খাঁচার পোষমানা প্রাণ নিয়ে লাভ-লোভের উবৃত্তিতেই এরা তৃপ্ত। এরা ভয় দেখালে পিছু হটে, প্রশ্রয় দিলে আগ বাড়ায়।
মহৎ আদর্শ ও সুন্দর স্পৃহাহীন মানুষ এমনটিই হয়। সুষ্ঠু কল্যাণচেতনাবিরহী মানুষে অন্যকিছু প্রত্যাশা করাই বাতুলতা। কল্যাণমাত্রই যে সামগ্রিক, খণ্ড-কল্যাণ বলে যে কিছু হতেই পারে না তা এ মানুষের বোধাতীত। তাই সব সাধারণ মানুষই আত্মকল্যাণে, আত্মসুখসন্ধিৎসায় ছুটছে, ঘুরছে, ছটফট করছে চিরকালই। কোনো মানুষই অলস উদাসীন হয়ে বসে নেই।
বৈরাগ্যও নেই কারো মধ্যে। কেবল রুচিভেদে পথ-পাথেয় ভিন্নমাত্র। ফলে ব্যক্তিকল্যাণ-প্রেরণাপ্রসূত কাড়াকাড়িতে কেবল কল্যাণকর সম্পদ ছিড়ছে আর ভাঙছে, আর অকেজো হয়ে অপচিত হচ্ছে। ত্যাগের প্রেরণা আসে ভালোবাসা থেকে। ভালো না বাসলে সেবা ও ত্যাগের যোগ্যতা জন্মায় না।
যারা আত্মরতিবশে ত্যাগের ভান করে ভাবী-ভোগের পুঁজি বিনিয়োগ করে, তারাই সুযোগ বুঝে আত্মপক্ষ সমর্থনেও আত্মস্বার্থ আদায় লক্ষ্যে বলে ‘ত্যাগ করেছি বিস্তর, ভুগেছি অনেক —–এখন জয়-অন্তে ভোগ করবার অধিকার আমারই। সিদ্ধি যখন এসেছে আমারই সংগ্রামে, তখন সাধ মিটিয়ে ভোগ করার দাবি আমারই। এমন মানুষ জয়ের শেষে লুট না করে পারে না।
অথচ ত্যাগ যার চরিত্রের অঙ্গ, চিত্তের সম্পদ, ভোগ তার বিষবৎ। ভোগীর ত্যাগী হওয়া সম্ভব, কিন্তু যথার্থ ত্যাগীর ভোগী হওয়া অসম্ভব। সাগরে বিচরণ যার, পুকুরে তার আকর্ষণ জন্মানো দুঃসাধ্য।
অতএব স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মুহুর্ত থেকে আজ অবধি আমরা সবাই আকস্মিকতার শিকার। অপ্রস্তুতিপ্রসূত বিমূঢ়তা বা অভিভূতি আমাদের কাকেও করেছে লুটেরা, কাকেও করেছে ফেরু, কাকেও করেছে মর্কট, কেউ হয়েছে বায়স আর অন্যরা রইল নিরীহ। তাই কেউ সুখ পাচ্ছেও না, কাকেও দিচ্ছেও না। দেশজুড়ে লোফালুফি, কাড়াকাড়ি, ডাকাচুরি, হানাহানি চলেইছে।
মার খাচ্ছে নিরীহরা। মানুষের প্রতি ভালোবাসা নেই, তাই সেবার ও ত্যাগের প্রেরণা নেই; দেশের মানুষের সামগ্রিক স্বার্থে কল্যাণকর কর্মের উদ্যোগ-আয়োজন নেই। খণ্ড ও ক্ষুদ্র স্বার্থে ততোধিক ক্ষুদ্র বুদ্ধি প্রযুক্ত হয়ে ব্যতিক্রম ঘটাচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মেও।
মানুষের মধ্যে যারা অর্জিত বিদ্যার জোরে বুদ্ধিজীবী আখ্যার দাবিদার তাঁরাও চরিত্রানুসারে বিভিন্ন মতলবের। এঁদের কেউ সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী। বোল ও ভোল পাল্টাতে, শক্তের ভক্ত হতে, জনপ্রিয় বুলি কপচাতে, প্রভুর সুরে সুর মেলাতে ও চাটুকারিতার সুনিপুণ অনুশীলনে তাঁদের জুড়ি নেই।
চালের ভুলে কখনো লাথি বা লাঠি খাওয়ার অবস্থায় পড়লে ও হাসিমুখে অদৃষ্টকে সহ্য করে ও সারমেয়সুলভ উদারতায় আনুগত্য স্বীকারে তাঁরা আরো উৎসুক হয়ে ওঠেন। তাঁদের জীবনদর্শনে এটিই আত্মশুদ্ধির প্রকৃষ্ট পথ। তাঁদের আমরা ভদ্র ভাষায় বলি ‘সরকার-ঘেঁষা।’ আর একদল আছেন তাঁরা হচ্ছেন সরকার-ভীরু —–তাঁরা গা-পা বাঁচিয়ে চলতেই ব্যস্ত।
কোনো ঝুঁকি নিতে নারাজ বলেই তাঁদের লাভের লোভও সামান্য। অনুগ্রহ পেলে বর্তে যান, না পেলেও যা আছে তার নিরাপত্তার আশ্বাসেই তুষ্ট। তাঁরা নিরীহ সংজ্ঞায় পরিচিত। ক্ষতি করার সাহস তো নেই-ই, উপকার করার সামর্থ্যও তাঁরা রাখেন না। সে হিসেবে ওরা সমাজের দায়—অবাঞ্ছিত বোঝা।
কেননা ওঁদের বহুল উপস্থিতি অন্যদের সাহস সঞ্চয়ে বাধাস্বরূপ। আর একদল আছেন, এঁরা সংখ্যায় চিরকালই নগণ্য। তাই বিরলতায় বিশিষ্ট। মনীষায় অনন্য না হয়েও এঁরা রেওয়াজ-বিরুদ্ধ বেসুরো বেমক্কা কথা বলেন বলেই সহজেই সমাজ-সরকারের নজরে পড়েন, এবং তাতেই এঁদের প্রভাব প্রতাপ প্রবল হয়ে ওঠে।
কিন্তু তবু এঁদের ভিন্ন চিন্তা ও অনন্য সাহসের দৃষ্টান্ত লোকমানসে যে আপাত দুর্লক্ষ্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, পরিণামে তা-ই সমাজে-রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনে। এঁরা স্বকালে সমাজ, শাস্ত্র ও সরকার শত্রুরূপে পরিচিত ও লাঞ্ছিত। কিন্তু কালান্তরে লোকবন্দ্য হয়েই লোকস্মৃতিতে অমর হয়ে থাকেন। এঁরা সাধারণত ন্যায়-নিষ্ঠ ও জনকল্যাণকামী। কিন্তু বিদ্যাপুষ্ট এসব বুদ্ধিজীবী কখনো সমাজে, শাস্ত্রে ও রাষ্ট্রে বিপ্লব বিবর্তন আনতে পারেন না।
উত্তেজিত গণসমর্থন ভাঙতে সমর্থ হলেও গড়ার সাধ্য এঁদের থাকে না। কারণ এঁরা স্বদেশে ও স্বকালে স্বপ্রতিবেশ থেকেই চিন্তা-চেতনা লাভ করেন। অতীত এঁদের বিস্মৃত ঐতিহ্য, ভবিষ্যৎ এঁদের অজ্ঞাত কামনা। যথার্থ মনীষাসম্পন্ন, বুদ্ধিজীবী বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও চেতনাকে বোধিতে ও প্রজ্ঞায় উন্নীত ও সমন্বিত করতে সমর্থ। অবশ্য তেমন মানুষ কোটিকে গুটিকও মেলে না।
হাজার বছরেও কোনো দেশে বা সম্প্রদায়ে তেমন মানুষ না জন্মিতে পারে। কেবল তেমন মানুষই নিকট-অতীতের প্রভাবের নিরিখে অদূর ভবিষ্যতের প্রয়োজনের আপেক্ষিকতায় বর্তমান সমস্যার কারণ-ক্রিয়া বিশ্লেষণ ও সমাধান নিরূপণ করতে পারেন।
এই সীমিত অথচ প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার তথা প্রজ্ঞার প্রসূন হচ্ছে আজ অবধি অর্জিত তাবৎ মানব প্রগতি। আবার প্রজ্ঞার এই দৈশিক ও কালিক সাফল্য ও সার্থকতাকে আত্মরতিবশে চিরকালীন ও সর্বজনীন মানবিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান বলে চালিয়ে দেয়া ও গ্রহণ করার মধ্যেই রয়েছে মানব-দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগের বীজ। বিশ্বাস-সংস্কার ও রক্ষণশীলতার মূলে থাকে ঐ চিরন্তনতায় আস্থার অনপনেয় প্রভাব।
আমাদের এই মুহুর্তের বুদ্ধিজীবীরা নিতান্ত সামান্য চিন্তা-চেতনায় নিবদ্ধ তো বটেই, তাছাড়া সরকার-ঘেঁষা এবং সরকার-ভীরুও। আর সরকার-শত্রু তো বিরল বটেই। কিন্তু এতেও নিয়মের ব্যতিক্রম উৎকট ও নৈরাশ্যজনকভাবে দৃশ্যমান। সবাই আকস্মিকতা ও অপ্রস্তুতির কবলগ্রস্ত।
তাই বিলাপে, স্মৃতির রোমন্থনে, কৃতিত্বের আস্ফালনে, ভুলভাষণে, সত্য গোপনে, বিকৃত তথ্য পরিবেশনে কিংবা চাটুকারিতায় অথবা শঙ্কা-ত্রাসে তাঁরা দুবছর কাটিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা নিজেদের স্বস্থ ও সুবিজ্ঞ দ্রষ্টা বলে জানেন, তাঁরা গতানুগতিক স্বরে ও সুরে পুরোনো চিন্তা-চেতনা নতুন করে পরিবেশনে ব্যস্ত। কেউ কেউ বিষয়বুদ্ধি বশে মামার জয়গানে মুখর।
কেউ কেউ পর প্রবঞ্চনার লোভে আত্মহননে লিপ্ত। আবার কেউ কেউ রুচিবিকারের শিকার। অনেকেই বক্তব্য নেই জেনেও বলতে উৎসুক। কৃচিৎ কেউ বিক্ষুব্ধচিত্তে গালি পাড়তে আগ্রহী। কিন্তু কোথাও নতুন দিনের সংবাদ, নতুন মনের পরিচয়, নতুন প্রতিবেশের প্রসাদ লভ্য নয়। এ নিশ্চিতই দুর্দিন। এ যেন রুগ্ননদেহে জীর্ণবস্ত্রে স্বাস্থ্য ও সজ্জার গৌরব অনুভব করার মিথ্যা প্রয়াস।
প্রবুদ্ধ জাতির নবজাগ্রত আত্মসম্মানবোধই জাতীয় জীবনের নির্দ্বন্দ্ব-নির্বিঘ্ন বিকাশ লক্ষ্যে স্বাধীনতা অর্জনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। কাজেই নবতর চিন্তা-চেতনা, উদ্যোগ-আয়োজন স্বাধীনতার নিত্যসঙ্গী। উচ্ছল প্রাণময়তা, তীব্র বিকাশ-বাঞ্ছা, উজ্জ্বল দৃষ্টি, সামগ্রিক কল্যাণ-চেতনা, মনন-বৈচিত্র্য ও চিত্ত-চাঞ্চল্যই সদ্যস্বাধীন জাতির বৈশিষ্ট্য। এসব গুণ আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত।
অর্জিত সম্পদের গৌরব-গর্ব থেকে আমরা বঞ্চিত, প্রাপ্ত ঐশ্বর্যের দাপটদস্তু আমাদের অবলম্বন। তাই আমরা মনে-মেজাজে একটুও বদলাইনি। নিকট অতীতে যেমন আমরা আগে মুসলমান, আগে পাকিস্তানি ছিলাম, এখন হয়েছি আগে বাঙালী। কখনো একাধারে ও একই সময়ে বাঙালী মুসলমান ও মানুষ হবার ইচ্ছা আমাদের জাগেনি। মানুষ হবার ব্রত কিংবা সাধনা আমাদের নয়।
আমরা লাটিমের মতো আবর্তিত হচ্ছি–এগুচ্ছি না মোটেই। তবু মনে করছি বাঁকা রাস্তায় হলেও আমাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকছে। আমাদের বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিজীবীরা একসময় মুসলমান হবার তীব্র উৎসাহে ভাষায় সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে চিন্তায়-চেতনায় সাহারার চমক ও গোবির মায়াঞ্জন প্রলিপ্ত করে ইসলামি লাবণ্য সৃষ্টির প্রয়াসী ছিলেন। তারপর তাকেই পাকিস্তানি সুরমার প্রলেপে বর্ণাঢ্য করার অপপ্রয়াস। চলে।
এখন আবার সেই একই স্থূল বিষয়-বুদ্ধিবশে তারা একান্ত বাঙালী হবার উগ্র উত্তেজনায় চঞ্চল। এবং সেই সিদ্ধি লক্ষ্যে আরবি-ফারসি নাম-শব্দ-চিহ্ন বা তৎসম্পৃক্ত জ্ঞান-বিদ্যা-সংস্কৃতি বিমোচনে তারা তৎপর। এর মধ্যে কোনো কল্যাণবুদ্ধি কিংবা নবচেতনা নেই। সুবিধাবাদীর চাটুকার চরিত্র-লক্ষণই মাত্র সুপ্রকট। ফেরু-স্বভাব এমনিভাবেই অভিব্যক্তি পায়। তাদের সারমেয়-স্বভাব আরো প্রবল।
নতুন প্রভুর মেজাজ- মর্জির অনুগত করে নিজেদের তৈরি করার সেই পুরোনো ফন্দি-ফিকির কৃত্রিম আনুগত্যের অঙ্গীকারে অনুগ্রহলাভের প্রয়াসে অবসিত হয়। আত্মপ্রত্যয়ী বিশ্বের দিকে দিকে আত্মপ্রসারে হয় উন্মুখ, স্বাতন্ত্রের নামে আত্মসংকোচনের মাধ্যমে আত্মরক্ষার নির্বোধ গৌরবে অভিভূত হয় না। স্বাতন্ত্র্য ভিন্নতায় নয়, উৎকর্ষে ও বৈচিত্র্যে—এ তত্ত্ব তাঁহাদের বোধগত নয়। রুগ্ন দেহের স্ফীতি যে মৃত্যুলক্ষণ, শয্যাশায়ী রোগীর অস্থিরতা।
যে প্রাণবন্ত সুস্থ শিশুর চাঞ্চল্য থেকে প্রকৃতিতে পৃথক; সে বোধ আমাদের নেই। আমরা যে এখনো মানস জরা-জীর্ণতার শিকার, তা আমাদের সার্বক্ষণিক মননে আচরণেও সুপ্রকট। নইলে আমাদের নিষ্ঠ রাজনীতিকরা এখনো দিল্লি-মস্কো ওয়াশিংটনে মানস-ভ্রমণ করেই আনন্দিত ও নিশ্চিত্ত কেন ? স্বদেশের ও স্ব-সমাজের প্রতিবেশে মানবিক সমস্যার সমাধান সন্ধানে নিরত নন কেন?
আমাদের স্বাধীন বাঙলার নাগরিকরা বিজয়-সংগ্রামে নিহত আত্মীয়-বন্ধুর জন্যে দুবছর ধরে বিলাপ-বিলাসে নিষ্ঠ কেন? লড়তে গেলে মরতেও হয়; রক্ত-সাগরেই স্বাধীনতা-সূর্য উদিত হয় জেনেও স্বাধীনতার গৌরবানন্দ ভুলে হৃতসর্বস্ব কাঙালের মতো কিংবা অনাথা বিধবার মতো বিলাপানন্দে আমরা কৃতার্থান্য কেন?
আমাদের সৃজনশীল আঁকিয়ে-লিখিয়েরা এখনো বালসুলভ স্বদেশপ্রেমের গানে, মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বকথনে, ধর্ষিতা নারীর চণ্ডরূপ অঙ্কনে কিংবা বেদনা-করুণ কাহিনী নির্মাণে, রাষ্ট্রনীতির স্তাবকতায়, ব্যক্তিপূজায় অথবা স্বাধীনতা-স্বাপ্নিকের নৈরাশ্যের ও হতবাঞ্ছার চিত্রদানে নিরত। মন যার বিমূঢ়, মননে তার দ্বিধা-বাধা থাকবেই।
জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুচ্ছগ্রাহিতায়, পৌনঃপুনি কতায়,যান্ত্রিকতায় ও পল্লবগ্রাহিতায় আমাদের প্রয়াস সীমিত। আঁকা-লেখার ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন বিশেষ প্রকট—তা হচ্ছে অশ্লীলতাকে পরম উদারতায় আর্টের উদার অঙ্গনে নিঃসংকোচে প্রতিষ্ঠা দান। এ-ও মুক্তি বটে, তবে এ বন্ধনমুক্তি মনের না রসলিপ্সার সেটাই প্রশ্ন। এ প্রশ্ন করার সঙ্গত কারণও রয়েছে; যেমন ছাড়া-বউ ও বিধবা বিয়ে করতে মুসলমানদের অনীহা দেখা যায় না।
এমনকি পর স্ত্রীকেও বশে এনে ঘরে তোলে। এতে বোঝা যায় পুরুষকে স্বেচ্ছায় দেহদানের পরেও কোনো নারীতে মুসলমানের অবজ্ঞা নেই। অথচ সেই মুসলমানই ধর্ষিতা নারীকে ঘরে তুলতে, সমাজে ঠাঁই দিতে, স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে এগিয়ে এল না। কিমাশ্চর্য অতঃপরম! এর পরেও কি বলা চলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে, কিংবা স্বাধীনতা আমাদের যোগ্যতালব্ধ সম্পদ!
এসব কিছুর মূলে রয়েছে একটা তত্ত্বকথা। আমাদের অজ্ঞাতেই শ্রেণীস্বাৰ্থচেতনা আমাদের মর্মমূলে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই আমরা যখন সচেতনভাবেই গণপ্রীতি বশে ও সদুদ্দেশ্যে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কিছু ভাবতে-বলতে-করতে চাই, তখনো কিন্তু এক অতিসূক্ষ্ম অবচেতন প্রেরণায় ও প্রভাবে নিজেদের অজ্ঞাতেই শ্রেণী-স্বার্থানুগ তত্ত্বই ভাবি ও বলি এবং কাজও করি সেভাবে।
আমরা গণমানবের দোহাই দিয়ে সব কথা বলি ও সব কাজ করি বটে, কিন্তু আসলে আমরা যা ভাবি, বলি ও করি তা কেবল শিক্ষিত উঠতি বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্তের তথা ভদ্রলোকের স্বার্থেই। কার্যত আমরা দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র বলতে ঐ ভদ্রলোকদেরই বুঝি। তাই গাড়ি-বাড়ি, ফ্রিজ-ফ্যান-ফোন, বিমান-সিট্রাক, কেবিন, রেডিও, টিভি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, চাকরি, কমিশন পরিকল্পনা প্রভৃতির বেলায় কেবল ভদ্রলোকের স্বার্থ ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতিই মনকে প্রভাবিত করে।
শিল্প-সাহিত্য, দর্শন-বিজ্ঞান, নাচ-গান, নাটক-সংস্কৃতি, সংবাদপত্র, নাগরিক অধিকার, বাক্ স্বাধীনতা, রাজনৈতিক মুক্তি, রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা প্রভৃতি সবকিছুই ভদ্রলোকদের জন্যেই প্রয়োজন। আমাদের চিন্তা-চেতনায় কেবল আমরা রয়েছি বলেই আমরা অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান, প্রদর্শনী, সম্মেলন-জলসা, আলোচনা-চক্র করি। সবকিছুর স্রষ্টা এবং ভোক্তা শিক্ষিত মধ্যবিত্তই। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরোক্ষে উপকৃত হয় গণমানবও। কিন্তু কোনো সরকারি বা সামাজিক চিন্তায় ও কর্মে তারা প্রায় কখনোই উদ্দিষ্ট নয়।
যেমন নিরক্ষর গণমানব বিনা দাবিতে ভোটাধিকার পায় ভদ্রলোকের সর্দারীর তৃষ্ণা মেটাবার এবং শাসনক্ষমতা লাভের উপায় বলেই। দেশের গণমানবের প্রায় সবাই নিরক্ষর চাষী-মজুর। আঞ্চলিক বুলি ছাড়া দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই তাদের অধিকার নেই। তাই লিখিত বাঙলাভাষাতেও নেই। তাদের পক্ষে রাষ্ট্রভাষা বাঙলা হওয়াও যা; উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি হওয়াও তা। কাজেই ভাষা-সংগ্রাম ও ভদ্রলোকের স্বার্থ ও সম্মানবোধের প্রসূন।
দেশের সাতকোটি মানুষ যে ভাষা প্রসাদ থেকে বঞ্চিত সে-ভাষার জন্যে প্রাণ দেযিাির গৌরব এবং সে-ভাষায় মর্যাদা দেয়ার গর্ব তাই গণমানবের পক্ষ থেকে করা চলে না। আজ যে মোহররমের মতো সপ্তাহ-পক্ষ-মাস-ব্যাপী সর্বজনীন পার্বণ চলছে ও ইমামবাড়ার মতো বারোয়ারি শহীদ মিনারে ফুল-চন্দন-আলিম্পন পড়ছে তা কাদের উৎসব ? এর সঙ্গে সাতকোটি নিরক্ষর মানুষের সম্পর্ক কী?
শিক্ষিতদের মধ্যে ইংরেজির বদলে বাঙলা চালু হলে গণমানবের কী লাভ? তাদের ভাত-কাপড়-আশ্রয়ের কিংবা নিরক্ষতার সমস্যা কী এতে মিটবে? কিংবা দেশের আর্থিক, নৈতিক,চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক, শৈক্ষিক, কৃষি-শৈল্পিক বা বাণিজ্যিক কী উন্নতি হবে? এমনি করে নিরক্ষরতা বিমোচনের কিংবা গণশিক্ষাদানের জন্যে ভদ্রলোকেরা প্রাণপণ সংগ্রামে নামে না কেন? শিক্ষিত বেকারের জীবিকা সংস্থানের জন্যে সমাজ সরকার মাথা ঘামায়, গণমানবের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা-দানের চেষ্টা হয় না কেন?
এই-যে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন, বহু অর্থব্যয়ে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হল, তা কাদের বিলাসবাঞ্ছা পূরণের জন্যে, কাদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে? অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। অন্য সব বিদ্যা হচ্ছে, তথ্য তত্ত্ব ও জ্ঞানগর্ভ আর সাহিত্য হচ্ছে অনুভবের প্রসূন। জীবনের জন্যই জীবন নিয়ে সাহিত্য—যে জীবনে রয়েছে শাস্ত্র সমাজ-সরকার-সংস্কৃতি, নিয়ম-নীতি, অর্থবাণিজ্য, কৃষি-শিল্প এবং তজ্জাত শাসন ও শোষণ, পীড়ন ও পোষণ, আনন্দ ও যন্ত্রণা, সম্পদ ও সমস্যা।
কাজেই সাহিত্য সম্মেলন কখনো জীববিদ্ উদ্ভিদবিদ কিংবা পদার্থবিদদের সম্মেলনের মতো জ্ঞান বিদ্যা-আবিষ্কার-উদ্ভাবনের প্রদর্শনী হতে পারে না। সেখানে থাকে কেবল জ্ঞানচর্চা,—–জীবন-জীবিকা সম্পৃক্ত কোনো অনুভব বা নীতি আদর্শ নয় ।
কিন্তু সাহিত্য জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত সর্বপ্রকার চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। কেননা সাহিত্যের কোনো নির্দিষ্ট অবলম্বন নেই। শাস্ত্র, সমাজ, সরকার এবং আর্থিক, নৈতিক, শৈক্ষিক, জৈবিক, প্রাবৃত্তিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বৈষয়িক, বাণিজ্যিক প্রভৃতি সর্বপ্রকার সমস্যা ও সম্পদ তার অনুভব ও বক্তব্যের অবলম্বন।
তাই জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দিষ্ট হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রিক চারনীতির সাহিত্যে রূপায়ণ-সম্ভাব্যতা, তার সুফল-কুফল, ঔচিত্য-অনৌচিত্য প্রভৃতি বিবেচনা করা ও লোকহিতে দিশা ও সিদ্ধান্তদান করা। জীবনাশ্রয়ী সাহিত্যের তো তাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তার বদলে অধ্যাপক-সাংবাদিকদের একত্র করে সাহিত্যের উরস কিংবা সর্বজনীন বারোয়ারি বাণী অর্চনার নামে বিভিন্ন ও বিচিত্র কণ্ঠের যে হট্টগোল সপ্তাহব্যাপী চালু রাখা হল, তার থেকে কী দিশা বা ধারণা পেল লিখিয়ে-পড়িয়েরা?
শিক্ষিতমনকে প্রভাবিত করার জন্যই আমরা গণসাহিত্য সৃষ্টি করি দুস্থ নিরক্ষর চাষী-মজুররূপী গণমানবের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিখি এবং বলেও বেড়াই। অথচ আমাদেরও মনে মেজাজে ও আচরণে পরিবর্তন দুর্লক্ষ্য। অঙ্গীকৃত সমাজতন্ত্র বিড়ম্বিত হচ্ছে তো এ কারণেই! সাত কোটি নিরক্ষর বাঙালীর লোকজীবনে লোকসাহিত্য সংস্কৃতি-ঐতিহ্য তো রয়েইছে।
তা, ভদ্রলোকের বিদ্যা-জ্ঞান অর্জনের জন্যে নিশ্চয়ই চর্চারও প্রয়োজন। কিন্তু ভৌতিক বিশ্বাস-সংস্কারের দুর্গে আবদ্ধ অজ্ঞ-অশিক্ষিত অপটু মানুষের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব ও গর্ব করার কী আছে? বরং দুঃখ লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয় এই যে, শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দেয়া যায়নি বলেই ওদের মধ্যে আমরা কত সক্রেটিস, প্লেটো, গেলিলিও-কপার্নিকাস, হোমার-কালিদাস, ফেরদৌসী-খৈয়ামকে হারিয়েছি, এখনো হারাচ্ছি; কত সম্ভাব্য রবীন্দ্রনাথ-লালন ফকিরই থেকে যাচ্ছেন।
শিল্প-সাহিত্যে-দর্শনে-বিজ্ঞান-প্রকৌশলে সভ্যতা-সংস্কৃতির এ স্তরে উঠে, আবার সেই অজ্ঞতার ও অসামর্থ্যের অপটুতা ও স্থূলতাকেই আমাদের রুচি সংস্কৃতির উৎস ও অবলম্বন বলে জানতে এবং মানতে হবে? লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি গৌরবের ও গর্বের হলে দুনিয়ার মানুষ কেন জ্ঞান ও নৈপুণ্যসুন্দর পরিশীলিত জীবন কামনা করছে?
আগেই বলেছি দেশমাত্রেই ভদ্রলোকের। সেই ভদ্রলোকদের নেতৃত্ব দেন। বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা আঁকিয়ে-লিখিয়ে বলিয়ে করিয়ে লোক হিসেবে পরিচিত ও সম্মানিত। তাঁদের নেতৃত্ব যখন বন্ধ্যা হয় অর্থাৎ তাঁরা যখন সময়োপযোগী নতুন ভাব, নতুন চিন্তা, নতুন উদ্যোগ কিংবা নতুন কর্মের দিশা দিতে ব্যর্থ হন, তখনই তাঁরা পুরোনো গৌরব-গর্বের, পুরোনো সাফল্যের, বিজয়ের, সুকৃতির রোমন্থন-সুখে অভিভূত থাকতে চান এবং লোকজীবনেও তার আবর্তন কামনা করেন।
তাই গত দু-বছরের অনুষ্ঠানে, পার্বণে, স্মৃতিসভায়, সম্মেলনে, আলোচনা-চক্রে এবং গল্পে-উপন্যাসে-গানে-কবিতায়-নাটকে-প্রবন্ধে স্মৃতিকথায় শোকের, কৃতির, বীরত্বের, বিজয়ের রোমন্থন-সুখ আস্বাদনের প্রয়াস দেখতে পাই। এক্ষেত্রে হিন্দু ও ভারতবিদ্বেষী কট্টর তমদ্দুনওয়ালা ও ঘোর পাকিস্তানওয়ালা বুদ্ধিজীবীদের ভাষা ও জাতি-প্রীতি এবং বিলাপনৈপুণ্য সঙ্গতকারণেই মাত্রা ছাড়িয়েছে।
এসব কারণে ভাবী বিপদ-সম্পদ-সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি রেখে বর্তমানের চলতি সম্পদ-সমস্যা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার লোক দেশে সত্যই বিরল। তাই আমরা আজ অদূর অতীতাশ্রয়ী। কাজেই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিন্তাও লাটিমের মতো কেবলই আবর্তিত হচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত বিবর্তন পাচ্ছে না, এবং আমাদের আনুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক কথায়-কাজে যেমন; তেমনি আমাদের সাহিত্যেও চলতি সমস্যার কিংবা অন্যায় পীড়নের প্রতিকার- প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংকেত সুস্পষ্ট নয়।
অতএব আকস্মিকতার অভিভূতি সযত্নে ও সচেতনভাবে পরিহার করে এই স্বাধীনতা-উত্তরকালেই আমাদের স্বাধীন নাগরিকের যোগ্য মন-মেজাজ তৈরি করতে হবে। এর প্রধান শর্ত ও ভিত্তি হচ্ছে চরিত্র। লক্ষ্যে উত্তরণের সংকল্প আসে চরিত্র থেকেই এবং সংকল্প থেকে আসে শক্তি, শক্তিপ্রয়োগে আসে সাফল্য। আমাদের আজকের সবচেয়ে বড় অভাব চরিত্রের। আজ চরিত্র-সঙ্কটই বড় সঙ্কট। চরিত্রবান মাত্রই সদাচারী ও কল্যাণকামী সে-কল্যাণ সর্বজনীন।
এ মানুষের সংখ্যা সমাজে বাড়লে ‘দাও দাও, পাই পাই, খাই খাই’ জাতের মানুষ কমবে এবং স্বাধীন দেশের বাঞ্ছিত সুনাগরিকের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের সীমা-সচেতন মানুষ দেশের সর্বাঙ্গীণ ও সর্বজনীন কল্যাণে তথা বহুজনহিতে ভাব, চিন্তা ও কর্ম নিয়োজিত করবে।
আমাদের দৈশিক ধারণায় আষাঢ়ের বৃষ্টিপাতে ধরণী সৃষ্টিসম্ভব হয়। প্রকৃতির জগতে আসে জীবনের জাগরণ। প্রাণের ঐশ্বর্যে ও স্বাস্থ্যের লাবণ্যে প্রকৃতি তখন ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে যৌবনবতী, নিরুপমা ও ফলসম্ভবা। তখন সবুজের সমারোহে পৃথিবী ভরে উঠতে থাকে। তেমনি স্বাধীনতা-প্রাপ্তির পর আমরাও সকারণেই প্রত্যাশা করেছিলাম সৃষ্টিসম্ভব নতুন চেতনা, নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টি, নতুন জিগির, নতুন তত্ত্ব, নতুন ভাব, নতুন উদ্যোগ, নতুন আয়োজন ও নতুন যুগ। আমাদের সেই প্রত্যাশা আজ আহত। তাই আমাদের মতো শত-সহস্র প্রত্যাশী আজ বিড়ম্বিত।
তবু দেশের মানুষের উপর বিশ্বাস রাখব, তবু প্রত্যাশায় থাকব। কারণ, নিশ্চয়ই জানি—এদিন যাবে, রবে না। কেননা কোনদিন যাহা পোহাবের না, হায় তেমনি রাত্রি নাই।’ খণ্ড ও ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যক্তিক প্রচেষ্টায় কেবল দ্বন্দ্ব-কোন্দল বাড়ে। কেননা তাতে ঈর্ষা-অসূয়া-প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানো অসম্ভব। সেঁচা জলের শরিক অনেক। আকাশের বৃষ্টি থেকে যেমন কেউ বঞ্চিত হয় না, তেমনি সমস্বার্থে সামগ্রিক কল্যাণ-লক্ষ্যে সমবেত প্রয়াসের প্রসাদ থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না। অতএব, আত্মপ্রত্যয় ও সবুদ্ধি সম্বল করে বহুজনহিতে বহুজনসেবায় ভাব-চিন্তা-কর্ম-নিয়োজিত করলে পর-কল্যাণের সঙ্গে আত্মকল্যাণ আপনিতেই হবে।
[ বিড়ম্বিত প্রত্যাশা – আহমদ শরীফ ]
আরও পড়ুন: