ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা [ Bengal before British rule ]

ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা [ Bengal before British rule ] – সম্পর্কে সুনীতি কুমার ঘোষ তার “বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি” গ্রন্থের “ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা?” প্রবন্ধে বলেন:

প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন জনপদে কোম বা উপজাতি (tribe)-দের বাস ছিল। তাদেরই নামে এই জনপদগুলির নাম হয়েছিল রাঢ় (পশ্চিমবঙ্গ), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ), বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ), সমতট (দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গ), হরিকেল প্রভৃতি। অন্যান্য নামেও এইসব জনপদের বা তাদের অন্তর্গত অঞ্চলের পরিচয় ছিল। যেমন তাম্রলিপ্তি (দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ), বরেন্দ্র (উত্তরবঙ্গ), গৌঢ় (রাঢ় ও পুণ্ড্রের অংশ) ইত্যাদি। পশুপালক বা আধা-পশুপালক কোমগুলি যখন কৃষির আবিষ্কার করলো এবং কৃষিই তাদের প্রধান অবলম্বন হলো তখন ক্রমশ রাজতন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছিল।

খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের আগেই বাংলাদেশে কৌমতন্ত্র রাজতন্ত্রে বিবর্তিত হয়েছিল। গ্রীক ও রোমান ঐতিহাসিকদের লেখায় আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময়ে বাংলায় গঙ্গা রাষ্ট্র (Gangaridi) নামে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১ আরও পরে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়। পাল রাজাদের যুগে (আনুমানিক অষ্টম শতকের মাঝামাঝি থেকে দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি) সামন্ততন্ত্রের সবচেয়ে বেশি বিকাশ হয়েছিল।

‘সামন্ত’, ‘মহাসামন্ত, ‘রাজন’ ইত্যাদি বিভিন্ন পদবী সামন্তেরা গ্রহণ করেছিল। ২ ডি. ডি. কোসাম্বি বলেছেন, বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়, প্রসার ও অবক্ষয় এই দেড় হাজার বছরের মধ্যে আধা-পশুপালক কৌম জীবন থেকে প্রথমে রাজতন্ত্র এবং তারপর সামন্ততন্ত্রে বিবর্তন হয়েছিল। এই যুগে যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠে তা অপরিবর্তিত থাকে ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলা মোগলদের দ্বারা বিজিত হবার আগে পর্যন্ত। মোগল শাসনে কিছু পরিবর্তন হয়েছিল; কিন্তু মূল কাঠামো আগের মতই ছিল।

ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা - সুনীতি কুমার ঘোষ [ Suniti Kumar Ghosh ]
সুনীতি কুমার ঘোষ [ Suniti Kumar Ghosh ]

[ ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা ]

ব্রিটিশ কামানের সাহায্যে ভারতীয় ঐক্য গড়ে দেবার হাজার বছর আগে বাংলার ঐক্য গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন জনপদ—হয়তো শুধু দক্ষিণ-পূর্বতম প্রান্ত ছাড়া–পালযুগে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়ে বঙ্গদেশের আবির্ভাব হয়। এই যুগেই বাংলা ভাষা ও লিপির জন্ম হয়।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন: … ৭৪০ খৃষ্টাব্দের দিকে বরেন্দ্রভূমিতে পাল-রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হইল, নবসৃষ্ট বাঙ্গালী জাতি নবীন এক গৌরবময় জীবনে প্রবেশ লাভ করিল। প্রথমটায় বঙ্গদেশের পণ্ডিতেরা সাহিত্যের ভাষা সংস্কৃতেরই চর্চায় তৎপর হইলেন। তাহার পরে তাঁহারা দেশ-ভাষার দিকে দৃষ্টি দিলেন।

পাল-রাজগণের রাজ্যের প্রতিষ্ঠার দুই শতকের মধ্যেই মাগধী প্রাকৃত এবং বঙ্গদেশে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ হইতে একটু বিশিষ্ট মূর্তি ধারণ করিয়া, বাঙ্গালা ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হইয়া দাঁড়াইল; এবং খ্রীষ্টীয় দশম শতকের মধ্য-ভাগ হইতে বৌদ্ধ শুরুদের হাতে এই স্বতন্ত্র ভাষায়, অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গালায়, সাহিত্য-সৃষ্টি—গান রচনা হইতে লাগিল।”১ পাল যুগেই গড়ে ওঠে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিশিষ্ট এক বাঙালী জাতি।

নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন: “…বাঙলায় এই যুগেই, অর্থাৎ এই প্রায় চারিশত বৎসর ধরিয়া একটা সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়িয়া ওঠে। ইহাই বাঙালীর স্বদেশ ও স্বাজাত্যবোধের মূলে এবং ইহাই বাঙালীর এক জাতীয়ত্বের ভিত্তি।”২ সুনীতি বাবুর মতে মুসলমান বিজয়ের পরে শ্রীহট্ট (সিলেট), চট্টগ্রাম ও পশ্চিম কামরূপসহ রাঢ়, বরেন্দ্রভূমি, ব-দ্বীপ অঞ্চল এবং বঙ্গ—এই সমগ্র দেশের নাম হয় ‘বাঙলা’ ৩ আবদুল করিমও লিখেছেন, দক্ষিণ-পূর্বতম জনপদসহ সমগ্র বঙ্গদেশ বাংলা নামে পরিচিত হয়।

সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াসের রাজত্বকালে (১৩৪২-৫৭) (৪ এই দেশের ভৌগোলিক সীমানা চিহ্নিত করেছে উত্তরে হিমালয়; দক্ষিণে সমুদ্র; পূর্বে খাসিয়া-জয়ন্তিয়া-গারো আরাকান প্রভৃতি পাহাড়ের একটি বলয় উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত; পশ্চিমে রাজমহল পাহাড়, ছোটনাগপুরের মালভূমি, কেওনঝড় ও ময়ূরভঞ্জের পাহাড় ও অরণ্যানী। শুধু রাজমহল পাহাড়ের উত্তরে বাংলার সমতল ভূমি বিহারের সমতলভূমির সঙ্গে মিশেছে। গাঙ্গেয় উপত্যকার অংশ—কিন্তু পশ্চিমের গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে বিচ্ছিন্ন এই দেশ। এর জলবায়ু আবহাওয়াও আলাদা। এই নদীমাতৃক দেশের আবহাওয়া আর্দ্র, পশ্চিমের মত শুষ্ক নয়। ভৌগোলিক দিক থেকে প্রকৃতি একে স্বতন্ত্র করে গড়েছে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

এই দেশের মানুষও একটি স্বতন্ত্র জাতি। বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণে বাঙালী জাতির উদ্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে তিনটি নরগোষ্ঠী—প্রথম, সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা ইত্যাদির পূর্বপুরুষ অস্ট্রিক ভাষাভাষী বাংলার আদিম অধিবাসী; দ্বিতীয়, দ্রাবিড়-ভাষাভাষী ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠী—যারা ভারতে প্রবেশ করে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল; এবং তৃতীয়, আর্য-ভাষাভাষী আলপীয় নরগোষ্ঠী।

মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর রক্তের কিছু সংমিশ্রণ হয়েছে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে। উত্তর ভারতে বৈদিক সভ্যতা যে আর্য ভাষাভাষী নর্ডিক নরগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল তাদের রক্ত বাঙালীর দেহে নেই বললেই চলে। পরে আরব, আফগান, তুর্কি, মুঘল, ইরাণী ইত্যাদি যারা ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিল তারা মূল জনস্রোতে মিশে গিয়েছে।

এদের সকলের সংস্কৃতি থেকে উপাদান নিয়ে বাঙালীর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়েছে। পরে য়ুরোপ থেকে যারা এসেছিল, বিশেষ করে ইংরেজরা, তাদেরও প্রভাব পড়েছে আমাদের সংস্কৃতির উপর। বাঙালীর জীবনচর্যার বনিয়াদ প্রাক-আর্য জীবনচর্যা। ৫ তাঁর এক দীর্ঘ অভিভাষণে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন: “বাংলার সংস্কৃতি মুখ্যতঃ গ্রাম্য জীবনকেই অবলম্বন করিয়া পুষ্টিলাভ করিয়াছিল। এদিকে বাঙ্গালাদেশ বোধহয় আদিম অস্ট্রিক জাতি হইতে প্রাপ্ত রিকথকেই রক্ষা করিয়া আসিয়াছিল। ৬

আবদুল মজিদ লিখেছেন: “একথা স্বীকৃত যে, বাংলার মাটি এবং বাঙালীর রঙ এদের উৎস অসংখ্য। কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্ট পরিচয় আছে। বিকাশের কার বাঙালী সংস্কৃতি ও বাঙালী জাতি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে গড়ে উঠেছে।”১ ভাষা, জাতিবিন্যাস (caste-system) ইত্যাদির দিক থেকে উত্তর ভারতের সঙ্গে বাংলার মিল থাকলেও দক্ষিণ ভারত এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক, বিশেষ করে জীবনযাত্রার পদ্ধতির দিক থেকে, অনেক মিল দেখা যায়।

উড়িষ্যার মত বাংলায় বহু শতাব্দী ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের সংমিশ্রণ হয়েছে। গুপ্তযুগে (আনুমানিক ৩০০-৫৫০ খৃষ্টাব্দ) ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা লাভের আগে বিহারের মত বাংলাতেও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের, বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ছিল। আজীবিক ধর্মেরও প্রভাব ছিল। জৈন ধর্মের সঙ্গে আজীবিক ধর্মের সাদৃশ্য আছে।

রাঢ় অঞ্চলের মানচিত্র [ Map of Rarh ]
রাঢ় অঞ্চলের মানচিত্র [ Map of Rarh ]

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বেদকে অস্বীকার করেছিল, বৈদিক ক্রিয়াকলাপ বর্জন করেছিল, প্রাধান্য দিয়েছিল মানবতার উপর। বাংলার সংস্কৃতিতে নানা সংস্কৃতির ধারার মিলন থাকলেও এর প্রধান বৈশিষ্ট্য মানবিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব প্রদান। এই দিক থেকে উত্তর ভারতের সংস্কৃতি থেকে বাংলার সংস্কৃতির পার্থক্য আছে। ৩

পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ফা-হিয়েন চীন থেকে এসে তাম্রলিপ্তিতে দুবছর ছিলেন, তিনি সেখানে ২৬টি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের সূত্রগুলির নকল করে এবং বুদ্ধের প্রতিমাগুলির চিত্র তৈরি করে তিনি তাম্রলিপ্তি থেকে একটি জাহাজে সিংহলে গিয়েছিলেন।

পঞ্চম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে আরও কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষু চীন থেকে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন হিউয়েন সাঙ বা য়ুয়ান চোয়াঙ। তিনি সপ্তম শতাব্দীতে ক-জঙ্গল (বীরভূম ও সাঁওতাল পরগণা এলাকা), পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, কর্ণসুবর্ণ (একদা মুর্শিদাবাদে শশাঙ্কের রাজধানী ছিল) ও তাম্রলিপ্তি পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিনি এই সমস্ত অঞ্চলে বহু বৌদ্ধবিহার ও ভিক্ষু দেখেছিলেন, জৈন ও হিন্দু মন্দিরও দেখেছিলেন।

বিভিন্ন ধর্মের অনুগামীদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতার তিনি উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলে যে নিয়মিত চাষ হয় এবং নানা ফল ফুল ও প্রচুর মূল্যবান ফসল হয় সেকথা উল্লেখ করেছেন। আর উল্লেখ করেছেন যে, লোকেরা সৎ, ভদ্র, পরিশ্রমী, বিদ্যানুরাগী। ৬

পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থানগড় [ Mahasthangarh ]
পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থানগড় [ Mahasthangarh ]
য়ুয়ান-চোয়াঙের গুরু বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শীলভদ্র বাঙালী ছিলেন। অন্যান্য বাঙালী বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে ছিলেন বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ দীপংকর। তিব্বতের রাজার বিশেষ অনুরোধে তিনি কয়েক বছর তিব্বতে গিয়া বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন এবং সেখানেই একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মারা গিয়েছিলেন।

পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু তাঁরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে আর্যেতর দেবদেবী, আচার, সংস্কার ইত্যাদি প্রবেশ করেছিল। পাল যুগ ছিল একটি সমন্বয়ের যুগ। সেন রাজারা (আনুমানিক ১০৯৬-১২০৬) ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গোঁড়া অনুরাগী এবং বৌদ্ধধর্মের বিরোধী ছিলেন। পালযুগে ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে যে সহিষ্ণুতার মনোভাব ছিল তা অন্তর্হিত হয়।

সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ কোনো এক সময়ে কর্ণাট থেকে বাংলায় এসেছিলেন। সেনরা বাঙালী সমাজকে ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করেন। বল্লাল সেন সমাজকে নানা জাতে (caste) ভাগ করেন। জাতিগত (caste) বৈষম্য চরম রূপ লাভ করে।

এই সময়ে কিছুকাল আর একটি রাজবংশ বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করে পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেছিলেন। এই বর্মন রাজারাও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গোঁড়া অনুরাগী ছিলেন। এঁদের পূর্বপুরুষও বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন। এই যুগটি ছিল সামাজিক অবক্ষয়ের যুগ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলায় তুর্কি আক্রমণ শুরু হয়। সমগ্র বাংলাকে জয় করতে তুর্কিদের একশো বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। গৌড়ের সিংহাসনের জন্য শাসকদের নিজেদের মধ্যে হানাহানি চলে এবং দেশে অশান্তি বিরাজ করে। ধর্মীয় কারণে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয়, বলপূর্বক অনেককে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। তবে তুর্কি আক্রমণের আগেই সুফী সাধুরা বাংলায় এসেছিলেন এবং অনেক হিন্দু তাদের প্রভাবে স্বেচ্ছায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন। পরেও অনেক হিন্দু, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে, জাত পাতের কঠোর শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আশায় স্বেচ্ছায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শান্তি ফিরে আসে।

১৩৩৮-এ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ্ সোনারগাঁও অধিকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ পর্যন্ত বাংলা দিল্লীর সুলতানদের অধীনতা-পাশ থেকে মুক্ত ছিল। ১৩৫৩ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ সোনারগাঁও জয় করেন এবং সমগ্র বাংলা ঐক্যবদ্ধ হয়। দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একাধিকবার অভিযান করেন বাংলা জয় করার জন্য কিন্তু হিন্দু মুসলমানের মিলিত প্রতিরোধে অভিযানগুলি ব্যর্থ হয়। এই সময় থেকেই বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা বাংলাকে স্বদেশ বলে এবং নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ করেন; এবং মুসলমানদের মত হিন্দুরা রাজসভাসদ, মন্ত্রী, উচ্চ রাজকর্মচারী, সেনাপতি ইত্যাদি হতে শুরু করেন। ২

গোকুল মেধ, পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থানগড় [ Gokul Medh ]
গোকুল মেধ, পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থানগড় [ Gokul Medh ]
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন: “মুষ্টিমেয় তুর্কি-বিজেতা ও তাহাদের পারসিক, পাঠান ও পাঞ্জাবী-মুসলমান অনুচর যাহারা বাঙলায় রহিয়া গেল, তাহারা বাঙ্গলার হিন্দুর সাহায্যেই বাঙলায় দিল্লী হইতে স্বাধীন এক মুসলমান-শাসিত রাজ্য স্থাপন করিল। তুর্কি ও অন্য বিদেশী বিজেতৃগণ দুই-চারি পুরুষের মধ্যেই বাঙ্গালী বনিয়া গেল। তখনও উর্দু ভাষার উদ্ভব হয় নাই। উত্তর ভারতের সঙ্গে তুর্কি-বিজয়ের পূর্বে বাঙ্গালার যে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, সে যোগ তুর্কি-বিজয়ের পরে যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হইয়া গিয়াছিল। বাঙ্গালায় উপনিবিষ্ট বিদেশী মুসলমানদের বাঙ্গালী স্ত্রী গ্রহণ করিতে হইত; তাহাদের সন্তানেরা ভাষায় বাঙ্গালীই হইত।

“প্রথম সংঘাতের পরে বাঙ্গালায় উপনিবিষ্ট বিদেশী ও বিদেশী-মিশ্র মুসলমান এবং দেশের হিন্দু বাঙ্গালী জনসাধারণের মধ্যে একটি সংস্কৃতি-বিষয়ক সহযোগিতা আরম্ভ হইল; মুসলমান সুফী, দরবেশ, ফকির ও গাজী ধর্ম প্রচারের জন্য উত্তর-ভারত হইতে এবং কচিৎ ভারতের বাহির হইতেও বাঙ্গালায় আসিতে লাগিলেন। ইহাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির লোক ছিলেন।

ধর্মোন্মত্ততার ফলে হিন্দুদের অনেকে বলপূর্বক মুসলমান করিয়া দেওয়া যে হয় নাই। তাহা নহে; তবে পীর, ফকীর, দরবেশ, আউলিয়া প্রভৃতিদের প্রচার এবং কেরামতির ফলে, মুখ্যত ব্রাহ্মণ্যের প্রতি বিদ্বেষ-পরায়ণ বৌদ্ধ ও অন্যান্য মতের বাঙ্গালী মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে। বাঙ্গলা দেশে যে মতের মুহম্মদীয় ধর্ম প্রচারিত হইয়াছিল তাহা খাঁটি শরিয়তি অর্থাৎ কোরান অনুসারী ইসলাম নহে।

…বাঙ্গালা দেশে ইসলামের সুফীমত-ই বেশি প্রসার লাভ করে। সুফীমতের ইসলামের সহিত বাঙ্গালার সংস্কৃতির মূল সুরটুকুর কোনও বিরোধ হয়। নাই।… মধ্যযুগে তুর্কি-বিজয়ের পর হইতে, যে ইসলাম বাঙ্গালায় আসিয়াছিল, তাহা নিজেকে বাঙ্গালীর পক্ষে সহজগ্রাহ্য করিয়া লইয়াছিল। বাঙ্গালা দেশে প্রচলিত ইসলাম ধর্ম বাস্তবিকই ‘মজম উ-ল-বহরৈন্’ অর্থাৎ দুইটি সাগরের সম্মিলন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ১

এই দেশের সাধারণ মুসলমান ও হিন্দুর দেহে একই রক্ত প্রবাহিত হয়েছে; যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বাস করেছেন; একই ভাষায় কথা বলেন; একই পেশা—কৃষি অথবা কারিগরি বৃত্তি—অনুসরণ করেছেন; জীবনযাত্রার পদ্ধতি মূলত একই ছিল; ধর্মে পৃথক হলেও কিছু কিছু ধর্মীয় আচরণ ছিল একই। হিন্দু পীরের দরগায় গেছেন; মুসলমান বিপদে আপদে লৌকিক দেবদেবীকে স্মরণ করেছেন। কিছু কিছু দেবদেবী উভয়ে মিলে সৃষ্টি করেছেন, যেমন সত্যপীর, ওলাবিবি, কালু রায়, দক্ষিণা রায়, বনবিবি ইত্যাদি।

জনগণের হিন্দুধর্ম ও জনগণের ইসলাম এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছিল মধ্যযুগে। কেন না দুয়েরই উত্তরাধিকার ছিল এক। কাজী আবদুল ওদুদের কথায়: “উভয় সমাজের শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনার ধারা সে কালে (মধ্যযুগে প্রায় একমুখী হয়ে পড়ে, বাউল সাহিত্য ও মুসলমান-বৈষ্ণব কবিদের রচনা তার প্রমাণ।”২

ওদুদ বলেছিলেন “বাংলার মুসলমানেরা সেকালে ও একালে যতটুকু সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন তারও অন্তরাত্মা আশ্চর্যভাবে উদার।”৩ “সে কালের মুসলমান যে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করেছিলেন একথা স্বীকৃত হয়েছে। লোকসাহিত্যে মুসলমানের দান হিন্দুর মতোই শ্রদ্ধেয়। ভারতীয় দার্শনিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণে কতিপয় মুসলিম বাউলের গান শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন।

৩০০ খ্রিস্টাব্দে সমতট
৩০০ খ্রিস্টাব্দে সমতট

“৪ মধ্যযুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি দৌলত কাজী ও আলাওল এই সমন্বয়ের কবি। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের এটি একটি বৈশিষ্ট্য। জগদীশ নারায়ণ সরকার বলেছেন: “দীর্ঘকাল ধরিয়া একত্রে বাসের ফলে বাস্তব জীবনে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক সম্মিলিত কৃষ্টির উদ্ভব ও আদান-প্রদান সহজ হইয়া আসিতেছিল। ৫

ইসলামের বাঙালীকরণ হয়েছিল, যেমন হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে যেমন অনেক প্রাক-আর্য দেবদেবী, বিশ্বাস, ধর্মীয় রীতিনীতি প্রবেশ করেছিল তেমনি জনগণের ইসলামের মধ্যেও অনেক স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি স্থান পেয়েছিল যার সঙ্গে কোরানের ইসলামের কোন মিল ছিসুনীতিবাবুর বক্তব্য উল্লেখ করে আমরা বলেছি, বাংলায় যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল তা ছিল সুফী মতবাদ।

সুফী মতবাদ বিরোধ চায় নি, চেয়েছিল সমন্বয় এবং স্থানীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতিকে আপন করে নিতে কুণ্ঠিত হয় নি। নীচে মুশিরুল হাসান ও আশগর আলি এনজিনিয়ারের কয়েকটি কথা যা উপরোক্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে তা আমরা অনুবাদ না করে তুলে দিচ্ছি। মুশিরুল হাসান বলেছেন: “Islam in Bengal took many forms and assimilated values and symbols not always in conformity with Koranic ideals and precepts. Cultural idioms of Islam underwent a rapid transformation, giving birth to a set of popular beliefs and practices which, in essence, represented the popular culture of rural Bengal rooted in the pre-Islamic past. “S

আশগর আলি এনজিনিয়ার লিখেছেন: “The Sufis who became models of Islamic virtues, adopted not only the local idioms but also local customs and rituals. …There may have been confrontations between Islam and Hinduism as far as the scriptural view of religion was concerned but there was no confrontation (but assimilation) as far as the folk view of Islam and Hinduism was concerned.”2

সুনীতিবাবুর কথার আর একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি: “বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে মানসিক প্রবৃত্তিগত প্রকৃতিগত মিল পাওয়া যাবে বাঙালী হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খৃষ্টানের সঙ্গে, পাঠান বা তুর্কী বা আরব মুসলমানের সঙ্গে নয়। ধর্মজগতেও সেই এক ভাব বিদ্যমান, তার বাইরের পোশাকটাকে যতই বদলাবার চেষ্টা হোক না কেন।

বাঙালীর পূর্বপুরুষ যখন বৌদ্ধ হিন্দু বা মুসলমান–এর একটাও ছিল না, দ্রাবিড় নিষাদ আর কিরাতের আদিম ধর্ম যখন সে পালন করত, তখন সে অলৌকিক শক্তিশালী ধর্মগুরুতে বিশ্বাস করত। এই প্রকার গুরুর মৃত্যুর পরে তার দেহ মাটিতে পুঁতে তার উপরে মাটি বা পাথরের ঢিবি সাজিয়ে দিত, সমাজের মঙ্গলের জন্য সপ্তাহে এক দিন ঢিবি পরিস্কার করত, তাতে ফুল দিত, সুগন্ধি দিত, প্রদীপ জ্বালত। এই ঢিবিকে বলত ‘এডুক’। পরে এই ‘এডুক’ হল বৌদ্ধের হাতে ‘স্তূপ’ বা চৈত্য’, হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হাতে সাধুসন্তের ‘সমাধী’ আর ধর্মান্তরিত বাঙালী মুসলমানের হাতে তার রূপ হল বা নামকরণ হল ‘পীরের কবর’ বা ‘দরগা’ বা ‘আস্তানা’।“৩

স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় ব্যাপারে উদার মনোভাবের অভাব ছিল না। তপন রায়চৌধুরী লিখেছেন: “মধ্যযুগের বাংলা পাঁচালীর কবিরা প্রত্যেক ধর্মমতের পবিত্র জায়গাকে—মুসলমান সাধুসন্ত ব্যক্তিদের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত স্থানকেও—প্রণাম জানাতেন। এই রীতির মধ্যে জনগণের ধর্মীয় মনোভাবের প্রতিফলন ছিল।”৪ (পাঁচালী ছিল নৃত্য ও বাদ্য সহযোগে গেয় কাব্য)।

মধ্যযুগে কোন কোন মুসলমান শাসক, বিশেষ করে প্রথম দিকে, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামির বশে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের উপর অত্যাচার করেছে, বৌদ্ধবিহার ও হিন্দু মন্দির চূর্ণ করেছে। যেমন, এক সময়ে হিন্দু শাসকেরাও বৌদ্ধবিহার ও চৈত্য ধ্বংস করেছে। আবার শাসকদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতাও ছিল।

পর্তুগীজ ধর্মযাজক সেবাস্টীন মানরিক (Sebastien Manrique) সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিনবার বাংলায় এসেছিলেন ও কতকগুলি অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন একবার তিনি এক হিন্দু গ্রামে রাত্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর এক মুসলমান ভৃত্য দুটো ময়ূরকে হত্যা করেছিল। পরের দিন হিন্দুরা স্থানীয় মুসলমান শিকদারের কাছে নালিশ করতে মানরিক ও অপরাধী-সহ তাঁর ভৃত্যদের হাত শক্ত করে পিছমোড়া করে বেঁধে মাটির তলায় অন্ধকার কুঠরিতে তাদের আটক করে রাখা হয়েছিল।

তারপর যে অপরাধ করেছিল তাকে শিকদার প্রশ্ন করেছিলেন; “তুই কি বাঙালী আর মুসলমান নস? তাহলে কেন তুই হিন্দু পরগণায় প্রাণী হত্যা করলি?” প্রচলিত আইন অনুসারে হিন্দু গ্রামে প্রাণীহত্যার শাস্তি ছিল চাবুক মারা ও ডান হাত কেটে ফেলা। ১

মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা অতি সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলবো। বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পরে কিছু ফারসী শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। তুর্কিরা উত্তর-পূর্ব পারস্যে (ইরানে) ও আফগানিস্তানে বসতি স্থাপন করেছিল; পারস্যের সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তুর্কি ও আফগান শাসনের সময়ে ফারসী ভাষার প্রভাব বাংলা ভাষার উপর তত পড়েনি যত পড়েছিল মোগলদের দ্বারা বাংলা বিজিত হবার পরে।

মোগলদের আগে সুলতানদের অধীনে হিন্দু সামন্তরাই বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতো। মোগলরা বাংলা জয় করে সমগ্র দেশের শাসনব্যবস্থা নিজেদের হাতে গ্রহণ করে। অভিজাত অনেক হিন্দু ও মুসলমান মুন্সীদের কাছ থেকে ফারসী শিখতেন ও মক্তব মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন। শাসন, আইন, যুদ্ধ, ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কিত বহু ফারসী শব্দে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হয়। হয় সরাসরি এগুলি এসেছে, নয়তো হিন্দুস্থানীর মাধ্যমে। দৈনন্দিন ব্যবহারের বহু শব্দের জন্য বাংলাভাষা ফারসী ভাষার কাছে ঋণী। অনেক আরবী ও কিছু তুর্কি শব্দও বাংলাভাষা নিয়েছে, তবে ফারসীর মাধ্যমে। ২

অন্যত্র যেমন, বাংলাতেও কাব্যের সৃষ্টিই প্রথমে হয়েছিল গদ্যের অনেক আগে। মধ্যযুগের বাংলাকাব্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুলতানরা ও স্থানীয় রাজা ও সামন্তরা। এই সময়েই কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ রচিত হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ অনুবাদ নয়, সংস্কৃত মহাকাব্যকে অবলম্বন করে বাঙালী কবির রচনা। শুরু হয় প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের ভাণ্ডার থেকে ঐশ্বর্য নিয়ে বাঙালী কবিরা বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেন।

সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খান ও তাঁর পুত্র ছুটি খাঁর উৎসাহে মহাভারত-এর কতক অংশ বাংলায় অনুবাদ করেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী। পরে ষোড়শ শতাব্দীতে কাশীরাম দাসের মহাভারত লেখা হয়েছিল। বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের কাছেই মহাভারত অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে কবি সৈয়দ সুলতান লিখেছিলেন:

“লঙ্কর পরাগল খান আজ্ঞা শিরে ধরি।

কবীন্দ্র ভারত কথা কহিল বিচারি।

হিন্দু মোছলমান তাহা ঘরে ঘরে পরে।

খোদা রসুলের কথা কেহ না সোঙরে।”

হোসেন শাহের পৌত্র আলাউ-দ্-দীন ফীরজ শাহ শ্রীধর ব্রাহ্মণকে দিয়ে বিদ্যাসুন্দর কাব্য লিখিয়েছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মালাধর বসু শ্রীমদভাগবত অবলম্বন করে ভাগবত রচনা করেন। এর মধ্যে তিনি রাধার কাহিনী নিয়ে এসেছেন যা সংস্কৃত ভাগবত-এ নেই। মালাধর বসু ছিলেন সুলতান বারবক শাহের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও সুলতান তাঁকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।

সুলতান হোসেন শাহের সভাকবি ছিলেন দামোদর যিনি সুলতানের কাছ থেকে ‘যশোরাজ খান’ উপাধি লাভ করেছিলেন। ‘যশোরাজ খান’ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং কৃষ্ণ-মঙ্গল কাব্য রচনা করেন ধর্মের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ের একটি নিদর্শন। অন্যান্য যে সব হিন্দু কবি পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই ইত্যাদি।

Ancient Political Divisions
Ancient Political Divisions

ষোড়শ শতাব্দীতে একজন মুসলমান কবিও বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল শাবিরিদ খান। মুসলমান অভিজাতরা ছাড়া কুচবিহারের ও বিষ্ণুপুরের রাজারা কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

সংস্কৃত কাব্য অবলম্বন করে বাংলা কবিতা ছাড়া মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের দুটি প্রধান ধারা ছিল—একটি মঙ্গল কাব্য ও অপরটি বৈষ্ণব কবিতা। চণ্ডী, মনসা, ধর্ম ইত্যাদি বাংলার লৌকিক দেবদেবী নিয়ে বহু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল। এইসব ধর্মমতগুলি ছিল বাংলার নিজস্ব। মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর চণ্ডী থেকে চণ্ডীমঙ্গল-এর চণ্ডী পৃথক—দেবী মনসার মত ইনিও ছিলেন বাঙালিনী।

ধর্মঠাকুর সম্বন্ধে ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ইনি ছিলেন ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিগৃহীত বৌদ্ধ ও মুসলমানদের প্রতিবাদের প্রতীক। ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধধর্ম, প্রচলিত হিন্দু ধ্যান ধারণা, প্রাচীন বাঙালীর বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান এবং ইসলামের প্রভাব—এ সবার সমন্বিত রূপ লাভ করেছে নাথ ধর্মমতে। ২

বহু কবি মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যই এ জাতীয় কাব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এইসব কাব্যের উপজীব্য ছিল মানুষ, যদিও এগুলিতে বিশেষ বিশেষ দেবতা বা দেবীর প্রশস্তি আছে। এগুলি সমসাময়িক জীবনের আলেখ্য। মঙ্গল কাব্যগুলি ছিল বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে গেয় কাব্য।

বৈষ্ণব কবিতার উল্লেখ করতে গেলে যে কবির নাম প্রথমেই আসে তিনি বিদ্যাপতি। তিনি ছিলেন মৈথিলী। রাধা-কৃষ্ণের ও মানব-মানবীর প্রেম ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের উপরেও তিনি লিখেছিলেন—–—–মৈথিলী ও ব্রজবুলি ভাষায়। মৈথিলী ছিল বাংলার সগোত্র এবং ব্রজবুলি ছিল মৈথিলী ও বাংলার সংমিশ্রণ। এই প্রতিভাবান কবির নামে কিছু বাঙালী কবির বাংলায় লেখা কবিতাও চলে এসেছে।

চণ্ডীদাস একজন ছিলেন না—অন্তত তিনজন, বড় চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস, আবিষ্কৃত হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে উপলক্ষ করে বড় চণ্ডীদাস লিখেছিলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, যার অনেক পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। এই প্রেম আধ্যাত্মিকতার আবরণে তরুণ-তরুণীর প্রেমের কবিতা। চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত কবিতার মধ্যে অনেকগুলি অপূর্ব, আবার কতকগুলি নিচুমানের। তারপর চৈতন্যের প্রভাবে অজস্র ছোট ছোট বৈষ্ণব গীতিকবিতা রচিত হয় যাকে ‘পদ’ এবং সমগ্রকে ‘পদাবলী সাহিত্য’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা রচনা করেছিলেন মুরারী গুপ্ত, কবিশেখর, কবিরঞ্জন, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, কবিরাজ নরোত্তম দাস বলরাম দাস। মাহমুদ, সৈয়দ মুরজা, সৈয়দ সুলতান, আলি রাজা আলাওল মুসলিম কবিদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। মহিলা কবিরাও ‘পদাবলী’ সাহিত্যে তাঁদের অবদান রেখে গেছেন।

শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কবিতা রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে উপলক্ষ মানব-মানবীর প্রেমের আবেগ ব্যাকুলতা, তীব্র বেদনা আনন্দ, মাধুর্য গভীরতার অভিব্যক্তি। পৃথিবীর কবিতার সঙ্গে এইসব কবিতা তুলনীয়।

ডক্টর এ. এম হবিবুল্লাহ বলেছিলেন: The period when Husain Shahi dynasty ruled Bengal (1493-1538) “was period which vernacular found its due recognition as literary medium through which suppressed intellect Bengal was find release. It was period unparalleled architectural activity, peace prosperity and of military conquests…

The Bengali mind burst bonds found voice the sweet lyricism of cult Radha and Krishna, in emotional of resurgent Vaishnavism, and poetry social toleration and religious fervour; the exuberance of continued unabated for next hundred and fifty years (আমরা অনুবাদ করলাম না)।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে ধর্ম জাত (caste) নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার, পুরুষ নারীর সমান অধিকারের আদর্শ বৈষ্ণব ধর্ম ধরেছিল।

Lalon Shai

মুসলমান কবিরা রোমান্টিক আখ্যায়িকা কাব্যের প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে। চট্টগ্রাম ও আরাকানে যেসব আরব বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁরা এনেছিলেন মজনু, হাতেমতাই, য়ুসুফ-জুলেখা ইত্যাদি কাহিনী। এইসব কাহিনী অবলম্বন মুসলমান কবিরা বাংলায় কবিতা রচনা করেছিলেন।

সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝে আরাকান রাজসভায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন দুজন প্রসিদ্ধ বাঙালী কবি–দৌলত কাজী সৈয়দ আলাওল। দৌলত ‘লোর-চন্দ্রানী’ ‘সতী ময়নামতী রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। আলাওল, যাঁকে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, বৈষ্ণব কবিতা ছাড়া পারসিক কয়েকটি আখ্যায়িকা কাব্য করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা পদ্মাবতী। একদিকে তিনি ছিলেন সংস্কৃতে সুপণ্ডিত এবং বিশ্বাস অনুষ্ঠান সম্বন্ধে সুগভীর জ্ঞান।

আর হিন্দু-মুসলমান বাউল কবিরা বাংলা কাব্যকে অমূল্য সম্পদে সমৃদ্ধ করে গেছেন। এঁদের উপর ছিল বেদান্ত প্রভাব। এঁরা শাস্ত্রীয় ধর্ম শাস্ত্রীয় ইসলামকে স্বীকার করেন নি। হিন্দু-মুসলমানের নি। এই লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) গেয়েছিলেন:

“কেউ মালা কেউ তসবি গলায়
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার কে “

তাঁদের গানে প্রকাশ লাভ করেছে উদার মানবতার সুর। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন চারণ কবি। কেউ কেউ গৃহস্থও ছিলেন। এঁদের শিকড় ছিল জনগণের মধ্যে; তাঁদের কাছ থেকে প্রাণরস আহরণ করে এই কবিদের গান অপূর্বতা লাভ করেছিল।

রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় দার্শনিক সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন: “বাউল সম্প্রদায় আমাদের বাঙলার সেই শ্রেণী হইতে আসিয়াছে যাহারা প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত নয়।” তিনি লিখেছিলেন: “আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে আমি যখন ছিলাম, বাউল-দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত।

আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল-সুরের মিলন ঘটেছে।…বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই [হিন্দু-মুসলমানের সাধনা দেখি,—এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করে নি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা। বাঙলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা স্কুল কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কি রকম কাজ করে এসেছে, এই বাউলগানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।”১

তাঁর আরও কয়েকটি কথা কিছু অপ্রাসঙ্গিক হলেও উদ্ধৃত করছি: “কিন্তু বাংলার অসাধু ভাষাটা খুব জোরালো ভাষা, এবং তাহার চেহারা বলিয়া একটা পদার্থ আছে। আমাদের সাধুভাষার কাব্যে এই অসাধু ভাষাকে একেবারেই আমল দেওয়া হয় নাই; কিন্তু তাই বলিয়া অসাধু ভাষা যে বাসায় গিয়া মরিয়া আছে তাহা নহে। সে আউলের মুখে, বাউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে, মেয়েদের ছড়ায় বাংলা দেশের চিত্তটাকে একেবারে শ্যামল করিয়া ছাইয়া রহিয়াছে।…

সংস্কৃত ভাষার জরি জহরতের ঝালরওয়ালা দেড় হাত দুই হাত ঘোমটার আড়ালে আমাদের ভাষাবধূটির চোখের জল মুখের হাসি সমস্ত ঢাকা পড়িয়া গেছে, তাহার কালো চোখের কটাক্ষে যে কত তীক্ষ্ণতা তাহা আমরা ভুলিয়া গেছি। আমি তাহার সেই সংস্কৃত ঘোমটা খুলিয়া দিবার কিছু সাধনা করিয়াছি, তাহাতে সাধুলোকেরা ছি ছি করিয়াছে। সাধু লোকেরা জরির আঁচলটা দেখিয়া তাহার দর যাচাই করুক; আমার কাছে চোখের চাহনিটুকুর দর তাহার চেয়ে অনেক বেশি; সে যে বিনামূল্যের ধন, সে ভট্টাচার্যপাড়ার হাটেবাজারে মেলে না।”২

১৯৫১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি চট্টগ্রামে চারদিন ব্যাপী পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের মূল সভাপতি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর অভিভাষণে বলেন:

“মধ্যযুগীয় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল। তিনি কোনদিন ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেন নাই। তাই বিশিষ্ট কবিরূপে নয়, বিশিষ্ট ধারার প্রবর্তকরূপে বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর ও চিরস্মরণীয় হইয়া রহিবেন। বলাবাহুল্য, দেবতা নয় মানুষই তাঁর কাব্যের উপজীব্য হয় প্রথম। সাহিত্যের স্বর্গ হইতে এই মর্ত্যে অবতরণ মধ্যযুগে এক বিরাট অগ্রগতি। তাঁর কাব্যে বৈষ্ণব প্রভাব আছে। ইহা লজ্জার বিষয় নয়। দেশের ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করিতে গেলে ঐতিহ্যের নিয়ম পালন করিতে হয়। এইভাবেই নূতন ধারার বিকাশ লাভ ঘটে।”

Rabindranath Tagore ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা [ Bengal before British rule ]

সাহিত্যবিশারদ ছিলেন প্রসিদ্ধ পুঁথিবিশারদ। তাঁর অভিভাষণে তিনি বলেন: “আমি কঙ্কালের ব্যবসায়ী। পুরাতন পুঁথি কঙ্কালেরই মত। কিন্তু আমি তার ভেতর যুগযুগান্তের রক্তধমনী ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনিয়াছি।… প্রাচীন মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য কাব্যরীতির সাধকদের মূল প্রেরণা ছিল সমাজ। দৈনন্দিন জীবনই ছিল রসের উৎসবক্ষেত্র। তাই কোথাও দেখা যায়, কবি দেবতার ছবি আঁকিতেছেন কিন্তু অজ্ঞাতসারে তা তদানীন্তন বাংলার সমাজচিত্র হইয়া গিয়াছে।… সমাজের দিকে দৃষ্টি ছিল বলিয়া মধ্যযুগের সার্থক কবিগণ লোকসংস্কৃতি অগ্রাহ্য করেন নাই। মঙ্গলকাব্যগুলি সাধারণত দরবারী, রাজসভা ঘেঁষা। কিন্তু ইহার ভেতরও পল্লীজীবনের ঝঙ্কার স্পষ্ট। ‘বারমাস্যা’র সুর কেহই বাদ দেন নাই।”১

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মঙ্গলকাব্যগুলির দুটি প্রধান শাখা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ও ‘মনসামঙ্গল’-এর নায়ক ও নায়িকারা রাজা-রানী, সুলতান-বেগম বা অন্য কোনো অভিজাত ছিলেন না। ‘চণ্ডীমঙ্গলে’র একটি উপাখ্যানের নায়ক বণিক ধনপতি, আর একটি উপাখ্যানের নায়ক-নায়িকা কালকেতু ব্যাধ ও তাঁর সহধর্মিনী ফুল্লরা; ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের নায়ক-নায়িকা বণিক চাঁদ সদাগর ও তাঁর পুত্রবধু বেহুলা। কালকেতু ব্যাধ যে নগর প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে হিন্দু-মুসলমান সকলেই বসতি স্থাপন করেছিলেন।

এইসব কাব্যে দেবদেবী আছেন কিন্তু তাঁদের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন মানুষ, যেমন চাঁদ সদাগর বা কালকেতু। মধ্যযুগের বাংলার এক শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে দেবতার কথা আছে কিন্তু দেবতার কথা ছাপিয়ে যে সুর ধ্বনিত হচ্ছে সমগ্র কাব্যে সে সুর মানবতার সুর। মধ্যযুগে বর্ণাশ্রম ও ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে নানা বিদ্রোহ হয়েছে। বাউলদের মধ্যে,

বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে, নাথ প্রভৃতি নানা লৌকিক ধর্মের মধ্যে এই বিদ্রোহ ফুটে উঠেছে। আমরা দেখেছি, উপরতলাতেও সাম্প্রদায়িক বিরোধ দূর হয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীন সুলতানদের মন্ত্রী, পরামর্শদাতা ও সেনাপতি হিন্দু-মুসলমান উভয়েই হতেন। দিল্লীর সুলতানের আক্রমণকে প্রতিরোধ ও পরাজিত করার জন্য হিন্দু-মুসলমান উভয়ে মিলেই লড়াই করেছেন। মোগলদের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলমান ভুঁইয়ারা অনেক সময় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করেছেন।

মধ্যযুগে বাঙালী সংস্কৃতির মূল সুর ছিল মানবতা। প্রাচীন শাস্ত্রের শৃঙ্খলকে এবং শাস্ত্র ব্যবসায়ীদের বিধানকে মধ্যযুগের সংস্কৃতি স্বীকার করে নি। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এক অজ্ঞাতনামা বাউলের গান থেকে এক উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন:

‘আমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজেদে
ওরে ও পরমগুরু সাঁই তোর পথ দেখতে না পাই
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশেদে।

তারপর তিনি বলেছিলেন: “মানুষে মানুষে বিভেদ আছে সত্য। এই বিভেদকে জয় করাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি ঐক্যের বাহন, বিভেদের চামুণ্ডা নয়। ২

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: “মানবপন্থী বাংলাদেশ প্রাচীনকালেও শাস্ত্রপন্থী সমাজনেতাদের কাছে নিন্দনীয় ছিল।…তার মানে বাংলা দেশ চিরদিনই শাস্ত্রগত-সংস্কারমুক্ত। বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতি মত এই দেশে বা তার আশেপাশে চিরদিন প্রবল ছিল। বাংলার বৈষ্ণব ও বাউলদের মধ্যেও দেখা যায় সেই স্বাধীনতা। তাই সে [বাঙালী| ভালো ‘বেনে’ না হতেও পারে কিন্তু তার দেশ বিস্তৃত বলে তার দৃষ্টি উদার হবারই কথা। বাংলা দেশ যে দেবভূমি নয়, এদেশ মানবের দেশ। বাঙালী মানুষকেই জানে। দেবতাকেও সে ঘরের মানুষ করে নিয়েছে।… মানবতাই যে আমাদের ধর্ম এ কথা আমি দেশে বিদেশে উচ্চকণ্ঠেই ঘোষণা করেছি। ১Rabindranath Tagore Full Length Portrait Seated Facing Front ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলা [ Bengal before British rule ]

(রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে শ্রদ্ধা করে উল্লেখ করা যায় যে, আজ আমরা যে যুগে বাস করছি সে যুগ ‘বেনে’-দের যুগ। তাই বাঙালী যে ভালো বেনে’ হতে পারে নি সেটা তার মস্ত দুর্বলতারূপেই দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মার্কিনী ‘বেনে’ আজ পৃথিবীকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। মানবতা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, মানুষের সমস্ত মূল্যবোধকে উপহাস করে ইচ্ছামত যে কোনো দেশে হানা দিয়ে ধ্বংস করতে, মানুষ হত্যা করতে, তারা কুণ্ঠিত নয়। আমরা দেখবো, ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ‘বেনে’রাই তাদের স্বার্থে ভারতবর্ষকে এবং বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করেছিল। তারা মানবতা পদদলিত করতে, লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাধি রচনা করতে ইতস্তত করে নি)।

মধ্যযুগের বাংলার কবি চণ্ডীদাসের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল:

“শুনহ মানুষ ভাই..
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই।”

১৯৪৮-এর শেষে এবং ১৯৪৯-এর প্রথমে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির অভিভাষণে ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন: “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙি দাড়িতে ঢাকার জোটি নেই।”২

মুসলমান ও হিন্দুরা যে এক জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, যে মানবধর্মী সংস্কৃতি তাঁরা উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলেন এবং যাকে তাঁরা নতুন অবদানে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন, সেই জাতীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় হতো, সেই সংস্কৃতি সময়ের সাথে সাথে সমাজ-বিপ্লব এবং জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসারের ফলে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত হতো, সন্দেহ নেই।

কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে মোগল আক্রমণের সাথে সাথে বাংলার বুকে বিপর্যয় নামে। তবে মোগল সম্রাটদের শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদেরও সমগ্র বাংলাকে জয় করতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল।

মোগল আমলে বাংলা থেকে বিপুল সম্পদ বাইরে চলে যেত। ১৭০০ থেকে ১৭২৭ পর্যন্ত যখন মুর্শিদকুলি খাঁ প্রথমে বাংলার দেওয়ান এবং পরে সুবাদার ছিলেন তখন বাংলা থেকে দিল্লীতে ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা পাঠানো হতো রাজস্ব হিসাবে। আজকের হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ কত তা ধারণা করতে হলে রাজধানী মুর্শিদাবাদে সে চালের কি দাম ছিল তা জানলে সুবিধা হবে। ১৭২৯ সালে ১ টাকায় ৭ মন ২০ সের (আনুমানিক ২৮১ কেজি) মোটা চাল বিক্রি হত। ১ তপন রায়চৌধুরী বলেছেন, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সময়ে তার ক্ষুধার্ত সেনাবাহিনী ও সমগ্র উপমহাদেশের শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলা কামধেনুর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ২

এই লুণ্ঠনই সব ছিল না। উত্তর ভারত থেকে যেসব সুবাদার ও অন্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী আসতেন তাঁরাও নানা উপায়ে যত শীঘ্র এবং যত বেশি সম্ভব বাংলাকে লুণ্ঠন করতেন এবং যাবার সময়ে লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে যেতেন। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শায়েস্তা খাঁ দু’বারে ২২ বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। যাবার সময় ৩৮ কোটি টাকা তিনি বাংলা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিমুস্সান ৯ বছরে ৮ কোটি টাকা এখান থেকে নিয়ে যান। ৩

মুর্শিদকুলি খানের আগে থেকে মোগল যুগে জমিদারি প্রথার সঙ্গে জায়গিরদারি প্রথাও ছিল। জায়গিরদাররা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারী। তাদের বেতন এবং তাদের অধীনে সৈন্যসামন্তদের জন্য ব্যয়ভারের বিনিময়ে জায়গির দেওয়া হতো। জায়গিরদার তার নিজস্ব কর্মচারীদের মাধ্যমে অথবা কোন ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করে তার মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় করতো। সেটা তারই প্রাপ্য ছিল। জায়গিরদার জমির মালিক ছিল না এবং একই জায়গির বরাবর ভোগ করতো না।

কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi Nazrul Islam ]
কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi Nazrul Islam ]
৩/৪ বছর অন্তর অন্তর তাকে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বদলি করা হতো। বাংলায় যতদিন তারা মোগল সম্রাটের অধীনে কাজ করতো ততদিন তারা বাংলার কৃষকের কাছ থেকে তার উৎপন্ন ফসলের যত বেশি অংশ— শুধু আইনসম্মত খাজনা নয়, অতিরিক্ত যত বেশি—আদায় করা যায় তা করে আবার উত্তর ভারতে ফিরে যেত। এছাড়া স্থানীয় জমিদাররা ছিল যারা তাদের অঞ্চলে কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা ছাড়া নানা আবওয়াব আদায় করতো এবং কৃষকদের শাসন ও তাদের উপর অত্যাচার করার নিরঙ্কুশ অধিকার ভোগ করতো।

মোগল শাসকরা—সম্রাট ও সম্রাটের পরিবারের ব্যক্তিরা, সুবাদার প্রভৃতিরা—অনেক সময়ে বাণিজ্যেও অংশগ্রহণ করতেন। বাংলায় মোগল সুবাদার মীর জুমলা, শায়েস্তা খাঁ, আজিমুসসান—কোন কোন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের বেচাকেনার উপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করেছিলেন। বাজার দরের থেকে কম দামে জিনিস কিনে বাজার দরের থেকে বেশি দামে তাঁদের লোকেদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীদের কিনতে বাধ্য করতেন।

যদুনাথ সরকার বলেছেন, শায়েস্তা খাঁ “লবণ, সুপারি এবং জীবনধারণের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় আরও কয়েকটি পণ্যের উপর বিক্রির একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করেছিলেন” এবং শুল্কের নামে নানা জায়গায় তাঁর কর্মচারীরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মালের উপর বেআইনীভাবে কর বা আবওয়াব আদায় করতো। মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭১৭ সালে সুবাদার হয়ে এইসব বন্ধ করেছিলেন।

ফরাসী ডাক্তার বার্নিয়ের সপ্তদশ শতাব্দীর ষাটের দশকে দুবার বাংলায় এসেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছিলেন, বাংলা কৃষিজাত ও শিল্পজাত সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রাচুর্যে ভরা। বার্নিয়ের লিখেছিলেন, বাংলায় চাল ও চিনি এত উৎপন্ন হয় যে শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়, আরব, মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দূর দেশেও রপ্তানি হয়। তিনি বাংলাকে সুতীবস্ত্র ও সিল্কের “সাধারণ ভাণ্ডার” (“the common storehouse”) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন— যে ভাণ্ডার থেকে শুধু মোগল সাম্রাজ্য নয়, দূর দেশেও এই সব পণ্য পাঠানো হতো।

তিনি উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন, জমির উর্বরতায়, সম্পদে ও সৌন্দর্যে বাংলা পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে যায়। ১ ১৫০৩ ও ১৫০৮ সালের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে ইতালীয় পর্যটক লুডোভিচি ডি ভারথেমা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার এক শহরে এসেছিলেন। সেই শহরের নাম দিয়েছিলেন বংঘেল্লা। তিনি লিখেছিলেন, “আমি যত শ্রেষ্ঠ শহর দেখেছি তাদের মধ্যে বংঘেল্লা অন্যতম, আর এই রাজ্যও বিশাল।…

এখানে শষ্য, নানারকম মাংস, প্রচুর চিনি আর আদা পাওয়া যায়। তাছাড়া সুতী কাপড়ের এত প্রাচুর্য পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। এখানকার মত এত বেশি ধনী ব্যবসায়ীও আমি কোন দেশে দেখিনি। প্রতিবছর এখান থেকে পঞ্চাশটি জাহাজ বোঝাই হয়ে সুতী আর রেশমী কাপড় রপ্তানি হয়।…এইসব জিনিস তুর্কি, সিরিয়া, পারস্য, সারা আরবদেশ, ইথিওপিয়া আর ভারতের সর্বত্র রপ্তানি হয়। ২

পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থানগড় [ Mahasthangarh ]
পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থানগড় [ Mahasthangarh ]
১৪২৫ থেকে ১৪৩২-এর মধ্যে মা হুয়ান কর্তৃক সংকলিত একটি চীনা বিবরণে বলা হয়েছে যে, “স্বর্গের সকল ঋতু পৃথিবীর সম্পদ বর্ষণ করেছে এই রাজ্যের উপরে; এর জনসাধারণের সম্পদ ও সততা বোধ হয় চিন চিয়াং-এর (প্যালেমবাঙ্গ—Palambang-এর) মানুষদের থেকে বেশি ও চাও ওয়ার-এর—Chao-war-র (জাভার)—লোকদের সমান।”৩ (পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে বাংলায় চীনা রাজদূতের দোভাষী হিসাবে মা হুয়ান বাংলায় এসেছিলেন)।

সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাঙ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বার্নিয়ের পর্যন্ত, চীন থেকে শুরু করে য়ুরোপের বিভিন্ন দেশের যেসব পর্যটকও রাজকর্মচারী বাংলায় এসেছিলেন, তাঁরা বাংলার সমৃদ্ধির ও বাঙালী জাতির মুগ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন। ৪

আরও পড়ুন:

Leave a Comment