তারা সুখে শান্তিতে জীবন ভোগ করেছিল – নামের অধ্যায়ে “দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ” তার “প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া” খান বইটি তুলে ধরেছেন ইয়াহিয়ার চরিত্র। আমাদের এই মার্চে “পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ” এর অংশ হিসেবে তার অনুসন্ধানগুলো তুলে ধরা হবে। পাকিস্তান আমাদের দীর্ঘ ২৩ বছর শোষণ করেছে। তবে সেই শোষণ মূলত করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানি এলিট। তাই পাকিস্তানি শাসন-শোষণ এর চেহারা সম্পর্কে জানার জন্য এদের জীবনাচার সম্পর্কে জানা জরুরী। বইয়ে দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সব রকম অন্যায়, অপরাধ। ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত জীবন দেখাতে গিয়ে উঠে এসেছে সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়। “তারা সুখে শান্তিতে জীবন ভোগ করেছিল ” অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন :
তারা সুখে শান্তিতে জীবন ভোগ করেছিল :
ইয়াহিয়া খানকে জড়িয়ে যত নারীদের কথা শোনা যায় তাদের মাঝে নুরজাহান ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর বিখ্যাত। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে তার উত্থান পতনের গল্পটা সবচেয়ে বেশি চমকপ্রদ।
উদাহরণস্বরূপ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সাথে তার দূরতম সম্পর্কের একটা কথা শোনা যায়। কিন্তু আইয়ুব খানের ব্যক্তিগত চরিত্রের কথা ভেবে কেউ কখনো চিন্তাও করতে পারেনি যে ১৯৬৫ র যুদ্ধের পর ইয়াহিয়া খানের সাথে তার সম্পর্ক ও সম্মান এতটা উঁচুতে চলে যাবে। এমনকি সিনেমা পাড়ায় একবার গুজব ছড়িয়ে গেল যে ইয়াহিয়া খান ম্যাডাম নুরজাহানকে তার মন্ত্রিসভার ক্যাবিনেটে পোর্টফোলিও বিহীন মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছেন। এই আইডিয়াটা কেউ কেউ ইয়াহিয়া খানের মাথার ভেতর ঢুকিয়েছিল সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত নুরজাহানের মতো এমন একজন নারীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করলে বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের ইমেজ আরো উজ্জ্বল হবে। কারণ এতে করে প্রমাণিত হবে যে পাকিস্তানের সংস্কৃতিক মনোভাব অনেক উন্নত।
কাওয়াকিব নামের লাহোরের একটা বিখ্যাত ফিল্ম ম্যাগাজিন প্রশ্ন রাখল যে, জেনারেল ডি গুল যদি আন্দ্রে মলরক্স নামের একজন সাধারণ লেখককে সংস্কৃতিক মন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারেন তবে ম্যাডাম নুরজাহানের মতো একজন প্রভাবশালী প্রতিভাবান অভিনেত্রীকে মন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিতে বাধা কোথায়?
দুটো কারণে এই পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেল।
- প্রথমত পাকিস্তানের গোঁড়া সম্প্রদায়গুলো এই ধরনের কাজের তীব্র
- বিরোধিতা করতে পারে, দ্বিতীয়ত নুরজাহানের নামের সাথে পূর্ববর্তী শাসকদের নামও জড়িত আছে।
কেউ কেউ বলত যে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সাথে নুরজাহানের যেমন ভালো সম্পর্ক ছিল একই সাথে জেনারেল হস্তান্দার মির্জার সাথেও ভালো দহরম মহরম ছিল।
ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের প্রথম দিকে তার সাথে নুরজাহানের সম্পর্ক নিয়ে তেমন কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি।
তবে আল ফাতেহ পত্রিকায় সর্বপ্রথম মালিকায়ে তারান্নুম নামে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এক বান্ধবীকে নিয়ে দারুণ চমকপ্রদ একটা গল্প ছাপা হয়। তার কিছুদিন পর পাকিস্তান টেলিভিশনে নুরজাহানকে নিয়ে বলা হয়,
‘একজন নারী যে ইয়াহিয়া খানকে একটা গানের বিনিময়ে পাকিস্তান বিক্রি করে দিতে রাজি করিয়েছে।‘
নুরজাহান অনেক জনপ্রিয় থাকার কারণে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে জড়িয়ে নুরজাহানের বিরুদ্ধে কিছু বলাটা একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল। শুধু তাই নয় প্রথম যখন এমনটা করা হলো তখন লাহোর যুবলীগ এর বিরুদ্ধে দশ হাজার লোক জড়ো করার ভয় দেখাল। শুধু তাই নয় তারা টিভি স্টেশন ও যে পত্রিকা অফিসগুলো নুরজাহানকে নিয়ে অপপ্রচার করছে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দিল। তবে ১৯৭২ এর পর থেকে ঘটনার মোড় ঘুরতে লাগল অন্যভাবে।
১৯৭২ এসে গল্প ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল যে নুরজাহান সত্যিকার অর্থেই গভীরভাবে ইয়াহিয়া খানের হারেমের সাথে জড়িত ছিল। ফলে ভাসা ভাসা একটা দাবি উঠতে শুরু করল ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ে এবং যে দুর্যোগ পাকিস্তানের উপর নেমে এসেছিল তার ভাগীদার নুরজাহানকেও হতে হবে। এই দাবির উপর আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ হলো যখন জেনারেল রানি তার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানকে জড়িয়ে নানা ধরনের গল্প বলা শুরু করল।
পত্রিকার খবর, কানাঘুষা গুজব সব কিছুই নুরজাহানের পেশাগত জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবন পারিবারিক জীবন সব জায়গায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করল। ১৯৭২ এর মাঝামাঝি সময় নুরজাহান বিরোধী একটা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। পাকিস্তানি পত্রিকাগুলো বলতে শুরু করল যে এই আন্দোলন যদি আরো গুরুতর হয় তাহলে নুরজাহান দেশত্যাগ করে ইয়োরোপের কোনো দেশে আশ্রয় নেবে।
কয়েকটা ফিল্ম ম্যাগাজিনের সাথে সাক্ষাৎকারে নুরজাহান বলল যে কিছু উচ্চপদস্থ পেশাদার অসাধু কর্মকর্তা আর সাংবাদিক ইচ্ছাকৃতভাবে তার ক্যারিয়ারকে কলুষিত করার জন্য ধারাবাহিকভাবে ইয়াহিয়া খানকে জড়িয়ে তার নামে দুর্নাম ছড়াচ্ছে। নুরজাহান অভিযোগ করল যে পত্রিকাওয়ালারা এটাও বলছে যে নুরজাহানের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশের ব্যবসায়িক লেনদেন ও সম্পর্ক রয়েছে। করাচির একটা ফিল্ম ম্যাগাজিন দাবি করে যে ১৯৪৮ সনে নুরজাহান বোম্বে থেকে পাকিস্তানে চলে আসে। সে বোম্বে দুটো ফিল্ম হাউস পরিচালনা করত।
এই সব গুজবের বিপরীতে নুরজাহান ঘোষণা করল,
‘আমি একটা একটা করে পয়েন্ট বের করে বলতে পারব যে ভারত থেকে আমি একটা টাকাও কখনো উপার্জন করিনি। আমি স্বেচ্ছায় যখন ভারত ছেড়ে চলে আসি তখন লক্ষ লক্ষ রুপি সেখানে ফেলে চলে আসি। ইন্ডিয়াতে আমার গানের যে সব রেকর্ড বাজানো হয় তার জন্য আমাকে রয়্যালেটি হিসেবে একটি রুপিও দেয়া হয় না। ইন্ডিয়ান রেকর্ড ব্যবসায়ীরা আমার রেকর্ড বিক্রি করে যা উপার্জন করছে সেখান থেকেও আমার অংশের কোনো পারিশ্রমিক তারা দেয় না।
ভারতের তুলনায় পাকিস্তানে আমি খুব দীন জীবন যাপন করছি। এই সব নিয়ে আমি কখনো কোনো অভিযোগ করিনি। কিংবা আমার শোচনীয় অবস্থা নিয়ে কোনো পত্রিকাও কোথাও কিছু বলেনি। যাই হোক আমার বিরুদ্ধে যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি পাকিস্তানি সংগীতের বাজার থেকে আমাকে ছিটকে ফেলার জন্য এই সব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এইভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আমি বলছি ভাঙা হৃদয় নিয়ে পাকিস্তান থেকে আমাকে চলে যেতে হবে।‘
নুরজাহানের এই সব শক্ত আর দৃঢ় বিবৃতিতে কাজ হলো। সিনেমা পাড়ায় তার শত সহস্র ভক্তকুল রাস্তায় নেমে এল। তারা হুমকি দিল যদি নুরজাহান দেশ ছেড়ে চলে যায় তাহলে তারা নিজেদের শরীরে আগুন দিয়ে জীবন্ত দগ্ধ হবে।
নুরজাহান বলেছিল সে যদি দেশ ছেড়ে চলে যায় তাহলে লন্ডন কিংবা অন্য কোনো দেশে যাবে। ভারতে সে কিছুতে যাবে না। তখন সংবাদ মাধ্যমগুলো বলতে শুরু করল যে ইন্ডিয়ার সিনেমা পরিচালকরা নুরজাহানকে ভারতে আবার অভিনয় করার জন্য প্রচুর টাকার প্রস্তাব দিয়েছে।
যাই হোক ইয়াহিয়া খানের সাথে নুরজাহানের প্রেমের সম্পর্কের চেয়েও আরো চমকপ্রদ গল্প ছিল। ইয়াহিয়া খানের পতনের পর যে পদ্ধতিতে নুরজাহান আবার নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেটা ছিল আরো বিস্ময়কর। নুরজাহানের গান প্রচারের উপর টিভি আর রেডিও যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ১৯৭৩ এর পর আন অফিসিয়ালি সেই নিষেধাজ্ঞা তারা তুলে নিতে শুরু করল। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের টিভি ও রেডিও নুরজাহানকে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রচার করতে শুরু করল।
পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভোগ ম্যাগাজিনে নুরজাহানের নাম আসল। পাকিস্তানের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নুরজাহানের সংগীত কিংবা তার উপস্থিতি ছাড়া হবে এটা কল্পনাও করা যেত না।
নুরজাহান সত্যিকার অর্থেই একজন প্রভাবশালী মহিলা ছিল। জেনারেল রানির বিবৃতি মতে সে নুরজাহানকে ইয়াহিয়া খানের সাথে সর্বপ্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে অনেক পাকিস্তানির মতে রানির কথাটা ঠিক নয়। রানি নিজেকে একটু ক্ষমতাশালী প্রমাণ করার জন্য এই সমস্ত কথা বাড়িয়ে বলেছে। কারণ ইয়াহিয়া খানের সাথে পরিচয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই নুরজাহানের সাথে পাকিস্তানের অনেক ঊর্ধ্বতন মহলের পরিচয় ছিল। সে প্রায়ই প্রেসিডেন্ট হাউসে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী হিসেবে যেত। মাঝে মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের অনেক অনুষ্ঠানে সে গান করত।
যাই হোক নুরজাহান দাবি করে যে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই তার সাথে নুরজাহানের পরিচয় ছিল। গুজরাট ও শিয়ালকোটে ১৯৬৫ এর যুদ্ধের পর সে ইয়াহিয়া খানের সেনাসদস্যদের নানা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শুনিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের খুব ঘনিষ্ঠ একজন সেনা কর্মকর্তা বলেন যে সেই সময় ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলেন এবং মেয়ে মানুষের প্রতি তার তেমন দুর্বলতা ছিল না।
তারপরেও নুরজাহানের সাথে কথা বলা বা তার সাথে থাকতে পারার ভাবনা তাকে মুগ্ধ করত। ইয়াহিয়া খান এক নৈশভোজে নুরজাহানকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। নুরজাহান সেই আমন্ত্রণে ভালোভাবে সাড়া দিয়েছিল। তবে ১৯৭০ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের ব্যবহারে বা আচার আচরণে নুরজাহানকে নিয়ে তেমন অরুচিকর আচরণ লক্ষ করা যায়নি।
অবশ্য এ ক্ষেত্রে রানির মতামত একদম ভিন্ন। সে বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেছিল যে নুরজাহানকে সে ইয়াহিয়া খানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক জেনারেল উমরের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে সে নুরজাহানকে ইয়াহিয়া খানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রানির মতে,
“ত্রিশ বছরের কম মেয়েদেরকে স্পর্শ করা কিংবা তাদের সাথে রাত কাটানোর বিষয়ে ইয়াহিয়া খান খুব রক্ষণশীল ছিলেন। সমাজের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো কম বয়স্ক শুকনো হাড্ডিসার প্রজাপতিগুলোর প্রতি ইয়াহিয়া খানের এলার্জি ছিল। তিনি তাদেরকে পছন্দ করতেন না। তবে মধ্য বয়স্কা নষ্ট ভ্রষ্টা সুন্দরী রমণীরা যারা সত্যিকার অর্থেই জানত যৌনতা কী তাদের প্রতি ইয়াহিয়া খানের আগ্রহের কমতি ছিল না। নুরজাহান এই ধারায় একদম পরিপূর্ণ একজন নারী ছিল।
মামু (ইয়াহিয়া খান) যখন রেকর্ডারে নুরজাহানের গান শুনলেন তখন তিনি নুরজাহানের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি তাকে বললাম সে কোনো তরুণী না, সে একজন মধ্য বয়স্কা নারী। হাফ ডজনের উপর স্বামীকে সে তালাক দিয়েছে। এরপরও ইয়াহিয়া খান তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য জেদ করতে থাকলেন। তারপর আমি জেনারেল উমরের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম যেখানে গায়িকা হিসেবে নুরজাহানকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। এ জন্য নুরজাহানকে আমি নগদ ৫ হাজার রুপি দিয়েছিলাম। একই সাথে সমমূল্যের অলংকারও দিয়েছিলাম।”
‘নুরজাহান আসল আর ক্ষমতাবান মানুষটাকে এক পলকেই মুগ্ধ করে ফেলল। ইয়াহিয়া খান এই মহিলার প্রেমে পড়ে গেলেন যার শরীরে কিছু ছিল না শুধু মাত্র গলার স্বরটুকু ছাড়া। যাই হোক ইয়াহিয়া খান নুরজাহানের সাথে টানা পাঁচ ঘণ্টা কাটালেন। তারা জেনারেল উমরের বাসার ছোট্ট একটা সাজানো রুমে একা একসাথে থাকলেন।
নুরজাহান পাঁচ ঘণ্টা পর যখন ঘর থেকে বের হয়ে আসল তখন তার টালমাটাল অবস্থা। সে কারো সাথে কোনো কথা বলল না। কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থা তার ছিল না। সেই রাতের পর থেকেই নুরজাহান আমার শত্রু হয়ে গেল। আমার কাছ থেকে সে ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের অলংকার ধার নিয়েছিল। সেগুলো সে ফেরত দেয়নি।‘
আবার এই প্রসঙ্গে নুরজাহানের বিবৃতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। সে বেশ জোর গলায় বলেছে ইয়াহিয়া খানের সাথে তার কোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। করাচির একটি উর্দু সাপ্তাহিকে এক সাক্ষাৎকারে নুরজাহান বলে,
‘এক আমি জেনারেলের বাসায় অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান আমাকে টেনে একটা ছোট্ট রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সত্যি কথা হলো সেখানে কোনো অনৈতিক কাজ আমাদের মধ্যে হয়নি। কারণ প্রথমত ইয়াহিয়া খান মদ খেয়ে এতটাই মাতাল ছিলেন যে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না আর দ্বিতীয়ত অনৈতিক কোনো ধরনের আচরণ করা থেকে আমি ইয়াহিয়া খানকে বিরত রেখেছিলাম। আমি তাকে সদাচারণ করতে বাধ্য করেছিলাম।‘
নুরজাহান দাবি করে যে রানি তার ইমেজটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সে তার নামে অসংখ্য বদনাম আর দুর্নাম ছড়িয়েছিল। এমনটাও দাবি করা হয় যে নুরজাহানের বিরুদ্ধে রানির মিথ্যে প্রপাগাণ্ডার কারণে নুরজাহানের চেয়েও দশ বছরের ছোট তার অভিনেতা পরিচালক স্বামী তাকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য হাইকোর্ট থেকে রুল জারি করেছে।
নুরজাহানের দাবি,
“এই রানি সে একটা মিথ্যাবাদী ডাইনি। আমি নিশ্চিত সে শত্রুপক্ষের কোনো এজেন্ট। তাকে প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়া খানের পাশে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল শারীরিক আর মানসিকভাবে ইয়াহিয়া খানকে ভারসাম্যহীন করার জন্য যাতে করে তিনি পাকিস্তানের দুর্যোগের মুহূর্তে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন।
এই মহিলা সব শ্রেণির পতিতাদেরকে ইয়াহিয়া খানের পাশে জড়ো করেছিল। যাতে করে ইয়াহিয়া খান এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর রাষ্ট্রের বিষয় নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে না হয়। তার সাথে আমার কাজ করার মতো কিছুই ছিল না। তার সাথে আমার নামটাকে বাজেভাবে জড়ানো হয়েছে কারণ আমি শুধুমাত্র একবার তার জন্য গান গেয়েছিলাম।“
অবশ্য সত্যটা বের করা একটু কঠিনই বটে যে নুরজাহান কি আসলেই ইয়াহিয়া খানের জন্য একবার গান গেয়েছিল নাকি তার সাথে আরো গভীর সম্পর্ক ছিল। তবে প্রেসিডেন্ট হাউসের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত বেশ কিছু সাংবাদিকের মতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে সম্পর্কের কারণে যে সমস্ত নারী আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছিল কিংবা সুবিধা গ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে নুরজাহানের নাম শোনা যায় না।
বেশি যেটা শোনা যায় নুরজাহান ইয়াহিয়া খানের খুব কাছের লোক ছিল না। ইয়াহিয়া খান নুরজাহানকে পছন্দ করতেন। এই পছন্দের কারণে নুরজাহান দেশের বাইরে নানা রকমের অনুষ্ঠানে যেতে পেরেছিল।
তবে পাকিস্তানে নুরজাহানের জনপ্রিয়তা ছিল সত্যিকার অর্থেই ঈর্ষণীয়। তার বিরুদ্ধে যখন নানা ধরনের প্রচার প্রপাগাণ্ডা চলছিল সেই সময় এক তরুণ একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখলেন যে
‘নুরজাহানের সাথে ইয়াহিয়া খানের পরিচয় হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান ভালো যে কাজটা করেছিলেন তা হলো তিনি নুরজাহানকে গান গাওয়ার আরো সুযোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নুরজাহানকে সাহায্য করার মতো তেমন কিছু ইয়াহিয়া খানের ছিল না। বরং উল্টো নুরজাহান গান গেয়ে ইয়াহিয়া খানের ক্রান্তিকালীন সময়ে তার হৃদয়কে প্রশান্ত রেখেছিল।‘
ইয়াহিয়া খানের সাথে নুরজাহানের সম্পর্ক যাই হোক কেন এই সমস্ত দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ার পর নুরজাহানের তৃতীয় স্বামী ইজাজ দুরানি তার ভিআইপি স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের পারিবারিক তালাকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো স্বামীর পক্ষে শুধু একক সিদ্ধান্তে নিজের স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে না। সেজন্য উভয়কে ম্যারেজ কোর্টে যেতে হবে।
পাকিস্তানের রেডিও টেলিভিশন নুরজাহানকে বয়কট করতে শুরু করল। নুরজাহান তার বাসা ছেড়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে উঠল। তার স্বামী ইজাজ দুরানি আরেক তরুণী শাহিদা পারভিনের সাথে থাকতে শুরু করলেন।
তবে কিছুকাল পরে হঠাৎ করেই সব কিছু কেমন যেন পাল্টে গেল। সংগীত রানি নুরজাহানের ভাগ্য চাকা ঘুরতে শুরু করল। ইয়াহিয়া খানের সাথে জড়িয়ে বিশাল জনপ্রিয় এই তারকার দুর্নামে লোকজন বিরক্ত হয়ে পড়ল। লোকজনের মনে হতে শুরু করল যে নুরজাহানের মতো একজন বড় মাপের শিল্পী আসলেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। যেভাবেই হোক জনমত ইজাজ দুরানি থেকে সরে এসে নুরজাহানের পক্ষে যেতে শুরু করল।
ষাটের দশকে নুরজাহানের সাথে যখন ইজাজ দুরানির পরিচয় হয় তখন তিনি একদম বেনামি আর অপরিচিত একটা মুখ ছিলেন ফিল্ম পাড়ায়। নুরজাহানের জনপ্রিয়তা সেই সময় ছিল আকাশচুম্বি। সেই সময় নুরজাহান তার দ্বিতীয় স্বামী ছবি পরিচালক শওকত রিজভিকে ডিভোর্স দিল। আর ইজাজ দুরানিকে নিজের কাছে টেনে নিল।
সেই সময় নুরজাহান বিভিন্ন ধরনের প্রযোজক আর পরিচালকদের ইজাজ দুরানিকে ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করার জন্য চাপ দিয়েছিল। তার এই প্রচেষ্টার কারণে কয়েক বছরের মধ্যে ইজাজ দুরানি পাকিস্তানের মিডিয়ার পর্দায় বেশ জনপ্রিয় একজন অভিনেতা হয়ে উঠলেন।
পাকিস্তান ফিল্ম পাড়ায় জেনারেল রানি যখন নুরজাহানকে নিয়ে কুৎসা গাইতে শুরু করল তার পূর্ব পর্যন্ত নুরজাহানের বৈবাহিক সম্পর্কের কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এর পরই ইজাজ দুরানি নড়ে চড়ে বসলেন। তিনি বলতে শুরু করলেন এত দুর্নাম আর কলংকের বোঝা নিয়ে তিনি কীভাবে সংসার করবেন। তিনি কোর্টের দ্বারস্থ হলেন।
তবে ভাগ্যক্রমে এর পরপরই ঘটনার মোড় ঘুরে যেতে শুরু করল। জনমত নুরজাহানের দিকে যেতে শুরু করল। পাবলিক বয়কটের কারণে ইজাজ দুরানির ছবিগুলো ফ্লপ খেতে শুরু করল। নুরজাহানকে যেসমস্ত ছবির প্রযোজকরা বয়কট করেছিল তারাও সরে আসতে শুরু করল। কারণ নুরজাহানকে বয়কট করার কারণে আরো প্রভাবশালী সংগীত শিল্পীরা সেই সমস্ত প্রযোজকদের ছবিতে গান গাইতে অস্বীকার করছিল। শুধু তাই নয় এমনটাও শোনা গিয়েছিল যে চব্বিশ বছর থেকে শুরু করে সত্তর বছরের পুরুষরা নুরজাহানকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া শুরু করল।
নুরজাহান ইজাজ দুরানির কাছ থেকে তালাক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। তবে কোর্ট যখন ইজাজ দুরানির পক্ষে মত দিল তখন নুরজাহান হাইকোর্টের আপিল বিভাগে গেল। আপিল বিভাগ বিষয়টা টেকনিক্যালভাবে ঝুলিয়ে দিল।
তবে এর মধ্যে ইজাজ দুরানি আরেকটা জটিলতা পাকিয়ে ফেললেন। তিনি শাহিদা পারভিন নামে আরেক অভিনেত্রীকে বিয়ে করলেন। পাকিস্তানি পারিবারিক আইন অনুযায়ী কেউ বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে না। লোকজন নুরজাহানকে বলল যে এই কারণে ইজাজ দুরানি
কারাগারে যেতে পারেন। এই অবস্থায় ইজাজ দুরানি পাঁচ লক্ষ রুপির বিনিময়ে নুরজাহানের সাথে তালাকের বিষয়টা মিটমাট করতে চাইলেন। কিন্তু নুরজাহান কোর্টে তার কেসটা চালিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত নিল।
এর মধ্যেই পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যমে আরেকটা খবর বেশ তোলপাড় লাগিয়ে দিল। শাহিদা পারভিনের বাবা মা পুলিশের কাছে অভিযোগ করলেন যে নুরজাহান আর তার সহোযোগীরা তাদের মেয়েকে বাসায় গিয়ে হেনস্থা করেছে। শুধু তাই নয় নুরজাহান তখন শাহিদা পারভিনের সন্তান সম্ভবা বড় বোনকে মেরেছিল। অভিযোগটা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হলেও রহস্যময় কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানুষের চোখের আড়ালে চলে যায়।
এর কিছুদিন পর আবার নতুন আরেকটা ঘটনা ঘটল।
আগস্টের ১৯৭৩ এর মাঝামাঝি সময়ে নুরজাহান আর রানি এক সাথে সংবাদ সম্মেলন করল। সেখানে তারা ঘোষণা করল যে তাদের মধ্যে এতদিন যা হয়েছে সেটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। তারা দুজন বোন। শুধু মাত্র মিডিয়ার রিপোর্টের কারণে তাদের মধ্যে এই দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তারা সকলের সামনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করল।
কিন্তু কিছুদিন পর আবার কিছু একটা মনে হয় তাদের মধ্যে ঘটল। ফলে দুজনার সম্পর্ক আবার বিষিয়ে উঠল। দুজন এমনভাবে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করল যে মনে হলো ইয়াহিয়া খানে উঠে এসে গল্পের বাকি অংশের সমাধান করতে হবে।
তবে ঘটনা যাই হোক এত কিছুর পরেও নুরজাহান আবার নিজেকে করতে পেরেছিল।
১৯৭৩ সনে নুরজাহানের দ্বিতীয় স্বামী শওকত হাবিবের ঔরসে তার বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। একটা গুজব ছিল যে শুধু মাত্র ইয়াহিয়া খানের জন্য নুরজাহানের পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসেনি, তার পরিবারের বিপর্যয়ের জন্য বড় মেয়েও একটা কারণ ছিল। নুরজাহানের স্বামী ইজাজ দুরানি প্রায়ই নুরজাহানকে বলতেন তোমার মেয়েকে অন্য কোথাও রেখে আসো কিংবা বিদেশ পাঠিয়ে দাও। নুরজাহান এতে কিছুতেই সম্মত হয়নি। ফলে মেয়েকে নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত।
এই ঝগড়ার মধ্যেই হঠাৎ করে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল আর সংসারের কালো মেঘও হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। মেয়ের বিয়ের পর পরই ইজাজ নুরজাহানের কাছে তার ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইলেন। তিনি এর মধ্যে শাহিদা পারভিন নামে যাকে বিয়ে করেছিলেন যেহেতু পাকিস্তানের পারিবারিক আইন তাকে মেনে নেয়নি তাই সে বিয়েটা ইজাজ বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারলেন না।
নুরজাহান আর ইজাজ এক সাথে বসবাস করতে শুরু করলেন।
তথ্যসূত্র:
বই : প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান
লেখক : দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ [ নির্মল পরিচ্ছন্ন অকপট ভাষায় এক দুঃসাহসিক কলমের অভিযান হলো ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ । ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার লেখনীর ভিতর দিয়ে একজন প্রাক্তন সামরিক স্বৈরশাসক, যৌনদানব, মাতাল, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলের অবিশ্বাস্য সব জানালা খুলে দিয়েছেন । সাংবাদিক দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে লেখালেখি করতেন । ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন সময় এবং এর পূর্বে ইয়াহিয়া খানের ভূমিকা, তার অন্ধকার জীবনের নানাদিক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে লেখক ‘প্রাইভেট লাইফ অব ইয়াহিয়া খান’ বইটিতে লিখেছেন ।
অনুবাদ : রফিক হারিরি
আরও পড়ুন:
- নারী মাংসের প্রতি লোভ – জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ]
- জেনারেল রানির আত্মজীবনী – জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন [ পাকিস্তানি জেনারেল সিরিজ ]
- বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস কাল
- প্রধানমন্ত্রী: কেউ যেন কষ্ট না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে
- বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ছয় দফা আন্দোলন ছিল ‘ম্যাগনা কার্টা’
- বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে ও নির্বাচনে আসার আহ্বান জানালেন ওবায়দুল কাদের
- কাল সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন