দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির মতে, নির্বিচার গ্রেপ্তার, গুম, হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়নসহ নানা অনিয়ম এখনো অব্যাহত রয়েছে। এসব ঘটনাকে আসক “দমন-পীড়নের নতুন রূপ” হিসেবে অভিহিত করেছে।

আন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দেওয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটি এই পর্যালোচনা তুলে ধরে

গণজাগরণ থেকে গুম নিপীড়নের বাস্তবতা

আসক জানায়, গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের যে গণজাগরণ হয়েছিল, সেখানে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বৈরাচারের পতনের দাবি এবং মানবিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু মাত্র এক বছরেই সেই আন্দোলনের চেতনা উপেক্ষিত হয়ে পড়েছে এবং মানুষের আশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে

মব জাস্টিসের বৃদ্ধি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা

সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার সুযোগে জনগণ নিজেরাই অপরাধীদের শাস্তি দিতে উদ্যোগী হচ্ছে। এর ফলে “মব জাস্টিস” বা গণপিটুনির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যেখানে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত ও আহত হচ্ছেন।

আসক মনে করে, এই প্রবণতার পেছনে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামাজিক বিভাজন বড় ভূমিকা রাখছে।

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বিচারহীনতা

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে বলে দাবি করে আসক।
সংস্থাটি জানায়:

  • মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ঘটছে।
  • এসব ঘটনার বিচার না হওয়া এবং অপরাধীদের দৃশ্যমান শাস্তির অনুপস্থিতি সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা: কাঠামোগত রূপ নিচ্ছে

আসক জানায়, নারীর প্রতি সহিংসতা এখন আর বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং এটি “কাঠামোগত সহিংসতা” রূপে পরিণত হয়েছে।

নিয়মিতভাবে ঘটছে:

সহিংসতার ধরনব্যাখ্যা
শারীরিক নির্যাতনঘরোয়া ও পারিবারিক সহিংসতা
ধর্ষণনারীর নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে
পোশাক/মতপ্রকাশ নিয়ে অপমানসামাজিক বয়কট ও লাঞ্ছনা

 

শিক্ষাঙ্গনে মতপ্রকাশের অধিকার হুমকির মুখে

আসক উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, শিক্ষাঙ্গনে মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের কারণে শিক্ষার্থীদের:

  • বহিষ্কার
  • হুমকি
  • অন্যায় আচরণের সম্মুখীন হতে হচ্ছে

একে সংস্থাটি মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখছে।

গণমাধ্যম সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন চলমান

আসকের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, গত এক বছরেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার, সংবাদপত্র বন্ধ, সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধের হুমকি এবং সাইবার হয়রানি বন্ধ হয়নি।

সংস্থাটি দাবি করেছে, এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে—“গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নে সরকার এখনো সংবেদনশীল নয়।”

গুম প্রতিরোধে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ, কিন্তু দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ

আসক স্বীকার করে, গুম প্রতিরোধে সরকারের কিছু উদ্যোগ আশাব্যঞ্জক। যেমন:

  • আন্তর্জাতিকভাবে গুম প্রতিরোধ কনভেনশনে সই
  • অতীতের গুমের ঘটনা তদন্তে “গুম কমিশন” গঠন

তবে সংস্থাটি মনে করে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পুনর্গঠন না হওয়া সরকারের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করছে।

নির্বাচন সামনে রেখে সুপারিশ আহ্বান

সরকারের তরফ থেকে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে আসক। সংস্থাটি বলছে,

“এটি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।”

তবে সেই সঙ্গে আসক নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে:

  • আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা
  • বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধ
  • সংখ্যালঘু ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
  • গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা
  • মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার জবাবদিহি নিশ্চিত করা

এই বিবৃতির মাধ্যমে আসক মূলত একটি সংকটাপন্ন ও উদ্বেগজনক মানবাধিকার চিত্র তুলে ধরেছে, যা সরকারের জন্য গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।