শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : শিক্ষণশান্তও আজকাল শিক্ষা-বিজ্ঞান নামে পরিচিত। এবং সবাই জানে যে বিজ্ঞান মাত্রই তথ্য-প্রমাণ নির্ভর। তবে প্রাকৃত বিজ্ঞানের মতো এই বিজ্ঞান ততটা তথ্যভিত্তিক নয়, যতটা তত্ত্বসংশ্লিষ্ট। বিজ্ঞান প্রমাণভিত্তিক আর তত্ত্ব গ্রহণসাপেক্ষ। তাই এখানে মতগত বিতর্কের ও লক্ষ্যগত বিভিন্নতার অবকাশ অনেক।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 2 শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/আহমদ-শরীফ-236x300.jpg)
আসলে শিক্ষাশাস্ত্র বিজ্ঞান নয়। এ যুগে বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবশে যে-কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ও পদ্ধতিবদ্ধ শাস্ত্র ও তত্ত্বকে ‘বিজ্ঞান’ বলে চালিয়ে দেয়ার আগ্রহ থেকে এ বুলির উদ্ভব ও প্রসার।
মূলত শিক্ষাতত্ত্বটি হচ্ছে নৈতিক, আর শিক্ষানীতিটি হচ্ছে বৈষয়িক। প্রথমটি মানবিক, দ্বিতীয়টি জৈবিক। একটি জীবন-সম্পৃক্ত, অপরটি জীবিকা-সংলগ্ন। একটি চেতনা সঞ্জাত মানববিদ্যা, অপরটি বিজ্ঞানপ্রসূত প্রযুক্তি বিদ্যা। তাই একটি নীতিমূলক, অপরটি বৃত্তিমূলক। আমরা এখানে শিক্ষার নৈতিক দিকটাই অধিক গুরুত্বে আলোচনা করতে চাই। জীবনকে অবলম্বন করেই মানুষের সর্বপ্রকার প্রয়াস-প্রেরণা হয় আবর্তিত। জীবনই সর্বপ্রকার চিন্তাচেতনার কারণ। জীবন হচ্ছে দেহ ও মনের সমন্বিত রূপ। দেহে যেমন ক্ষুধা আছে, মনেরও তেমনি রয়েছে চাহিদা। দেহ আধার, মন আধেয়। দেহ যন্ত্র, মন যন্ত্রী।
এজন্যই জীবন ও জীবিকা প্রয়াস অবিচ্ছেদ্য। জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও বিকাশ লক্ষ্যেই মানুষের সর্বপ্রকার প্রয়াস নিয়োজিত। তবু জীবনের জন্যই জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়, তেমনি জীবনের প্রয়োজনেই শিক্ষা আবশ্যক। শিক্ষাকে তাই জীবনের অনুগত করতে হয়, জীবনকে শিক্ষার ছাঁচে ফেলে টবের তরুতে পরিণত করলে জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে জীবন বিকৃত হয়। শিক্ষাকে তাই জীবন-সংলগ্ন করতে হবে।
শিক্ষাবিজ্ঞানীরা শিক্ষাদানে অর্থাৎ এডুকেইট করার সুফলপ্রসূতায় গভীর আস্থা রাখেন। আমরা এডুকেইট করার পক্ষপাতী নই। আমরা চাই মানবিক জ্ঞানের অবাধ বিকাশের জন্য কেবল বিশুদ্ধ জ্ঞানদান বা ডেসিমিনেশান অব নলেজ। অর্থাৎ আত্মা ও আত্মবিকাশের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা কামনা করি। পেশাগত, বৈষয়িক যোগ্যতাগত বুদ্ধিবৃত্তির, শ্রেয়ঃবোধের ও সৌন্দর্য-চেতনার স্বাধীন বিকাশ লক্ষ্যে বিদ্যাদান এ স্তরে আমাদের বাঞ্ছিত নয়। কেননা আমরা কেবল কর্মী ও কর্মযোগ্য প্রাণী চাইনে। মানবিক গুণবিশিষ্ট সামাজিক মানুষ তৈরিই আমাদের লক্ষ্য। যে-মানুষ পারস্পরিক কল্যাণ ও মৈত্রী লক্ষ্যে প্রীতি ও শুভেচ্ছার ভিত্তিতে দায়িত্ব ও কর্তববুদ্ধি নিয়ে সমস্বার্থে সহিষ্ণুতা ও সহযোগিতার অঙ্গীকারে সহ-অবস্থানে আগ্রহী হবে।
Table of Contents
[ শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব – আহমদ শরীফ ]
তাই শেখানো বুলিতে বা আরোপিত বিশ্বাসে কিংবা নিপুণ যন্ত্রীতে আমাদের আস্থা নেই। অর্জিত জ্ঞানজ প্রজ্ঞায় ও বোধিতে যে মানুষের মন-মেজাজ পুষ্টি ও বিকাশ পায়—এই তত্ত্ব আমরা স্বীকার করি। এবং তাই জ্ঞান-যে মানবিক গুণের উন্মেষ ও বিকাশ লক্ষ্যে অর্জিত হওয়া উচিত, তাও আমরা স্বীকার করি। মানবিক গুণ বলতে আমরা বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ, সামাজিক শ্রেয়ঃ-চেতনা ও সৌন্দর্যবোধের বিকাশ বুঝি। আবার মানুষের মানসপ্রবণতার বৈচিত্র্য স্বীকার করি বলেই সব মানুষের সমবিকাশ যে অস্বাভাবিক ও অসম্ভব, জ্ঞান-যে সবক্ষেত্রে শোধনে সমর্থ নয়, তাও মানি। কেননা বিশ্বাস সংস্কার বন্ধ্যা, তার ভবিষ্যৎ নেই।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব - আহমদ শরীফ](https://glive24.com/wp-content/uploads/2021/12/Ahmed-Sharif.jpg)
মুক্তমনের অঙ্গনে অনুকূল প্রতিবেশে যে-কোনো বীজ উপ্ত হবার সম্ভাবনা থাক। তাছাড়া দুঃশীল অমানুষও সংখ্যাগুরু সুজন সুনাগরিকের প্রতি সমীহবশে সংযত আচরণে বাধ্য হয়। তাই আমরা মাধ্যমিক স্তর অবধি (১৫ বছর বয়স পর্যন্ত) উদার ও সাধারণ শিক্ষানীতির পক্ষপাতী। এ স্তরে থাকবে ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য, শিল্প সম্বন্ধে সাধারণ জিজ্ঞাসা জাগানোর ব্যবস্থা; বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধে আগ্রহ সৃষ্টির মতো প্রাথমিক সূত্রগুলোর পরিচিতি এবং সর্বপ্রকার সংস্কার মুক্তির আনুকূল্য দান। কেননা আরোপিত বিশ্বাস-সংস্কার মানুষের চিন্তাশক্তিকে বন্ধ্যা রাখে, আর মানুষকে করে ভীরু।
সততা, সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, সময় ও নিয়মানুবর্তিতা, স্বাস্থ্য, দায়িত্ব-চেতনা, কর্তব্যবুদ্ধি প্রভৃতির মূল্য-চেতনা হবে উক্ত শিক্ষার প্রসূন ও ফসল। এক কথায় জীবন প্রতিবেশ এবং সমাজ সম্পর্কে কল্যাণকর নিরপেক্ষ স্বচ্ছ দৃষ্টি দানই হবে শিক্ষার লক্ষ্য।
সৎ শিক্ষার পথে শাস্ত্র, সমাজ ও সরকার-সৃষ্ট বাধা :
সরাসরি শিক্ষাতত্ত্বে প্রবেশ না করে আমরা একটু প্রাসঙ্গিক উপক্রমণিকার অবতারণা করতে চাই। আর সব প্রাণী সহজাত বৃত্তি-প্রবৃত্তি এবং নিয়তি-নির্দিষ্ট বৃদ্ধি ও শ্রেয়বোধ নিয়ে প্রকৃতির আনুগত্যের অঙ্গীকারে নিয়ম-নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে। মানুষ তার অবয়বের শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগে গোড়া থেকেই কৃত্রিম জীবন রচনায় উৎসাহ বোধ করেছে। তাই সে প্রকৃতির প্রভুত্ব অস্বীকার করে, তাকে বশ ও দাস করে জীবনের সুখ, স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনে উদ্যোগী হয়েছে।
হাতকে যখন হাতিয়াররূপে জানল, তখন মানুষ জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যদান লক্ষ্যে হাতের কাজ উদ্ভাবনে মন দিল। আর এতেই তার চিন্তাশক্তির বিকাশ হল শুরু। এমনি করেই তার জীবন ও জীবিকা-পদ্ধতি সংলগ্ন চিন্তাভাবনার প্রসার হতে থাকে। প্রকৃতির নিয়ম ও রহস্য অনুধাবন করে করে সে প্রকৃতিকে বশ ও দাস করার বৃদ্ধিও আয়ত্ত করেছে। যৌথ কর্ম ও সহচারিতার গরজে তার ভাবনাচিন্তা প্রকাশের ও বস্তুনির্দেশের জন্য সে নব নব ধ্বনিও সৃষ্টি করেছে, তাতেই তারা ভাষা হয়েছে ঋদ্ধ।
তার অপ্রাকৃত, কৃত্রিম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বহু প্রসারের ধারায় আজ অবধি সে যা অর্জন করেছে, তা-ই তার সম্পদ ও সঞ্চয়, তা-ই তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি। অতএব মানুষের সর্বপ্রকার প্রয়াসের ও বিকাশের মূলে রয়েছে তার জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য বাঞ্ছা প্রত্যাশার প্রবর্তনাতেই সে আবিষ্কারে ও উদ্ভাবনে, নির্মাণে ও বৈচিত্র্যদানে প্রয়াসী।
জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তার অভাববোধ ও অতৃপ্তিই তাকে কাঙ্ক্ষী, জিজ্ঞাসু ও উদ্যোগী রেখেছে। তাই গতিশীলতা ও চলমানতাই তার চেতনার গভীরে মূল জীবন প্রেরণা। স্থিতিতে তাই তার স্বস্তি-শাস্তি নেই। অবচেতনভাবে মানুষ তাই এগিয়ে চলার আগ্রহে নতুন চিন্তায়, আবিষ্কারে, উদ্ভাবনে ও নির্মাণে নিরত। স্থিতি ও স্থায়িত্বে জরা ও জীর্ণতা বাসা বাঁধে। নব নব কিশলয় যেমন বৃক্ষের বৃদ্ধির লক্ষণ, তেমনি পুরোনো রীতি-রেওয়াজ ও মতাদর্শ পরিহার সামর্থ্যেই নিহিত থাকে মানব-প্রগতি।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
সব মানুষ অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, পরনির্ভরতায় নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। তা ছাড়া তাদের শক্তি ও প্রবণতা বিভিন্ন ও বিষয়। তাই গোটা মানব-সমাজের হয়ে কেউ কেউ চিন্তায়, উদ্ভাবনে, আবিষ্কারে ও নির্মাণে নিরত হয়। এজন্যেই বিশ্বের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে কয়েকশত মানুষও মেলে না, যাদের চিন্তা ও মনীষার ফসলে, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনার দানে মানুষ আজ বিশ্ববিজয়ী ও নভশ্চর। এমনি করে একের দানে অপরে হয় ঋদ্ধ। একের সৃষ্টি বিশ্বমানবের হয় সম্পদ।
এ তথ্য জেনেও শাস্ত্র, সমাজ ও সরকার চিরকালই স্থিতিকামী মানুষকে একটি নিয়মের নিগড়ে নিবদ্ধ করে শাস্ত্র, সমাজ ও শাসক চিরকালই নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছে। নইলে ঝামেলা বাড়ে, শাস্ত্রকার, সমাজপতি ও রাজ্যপতির স্বস্তি-সুখ নষ্ট হয়। জীবনের ও মননের প্রবহমানতা ও স্বাভাবিক অগ্রগতি অস্বীকৃতির ফল কোনকালেই ভাল হয়নি। চিরকাল সর্বত্রই রক্তঝরা প্রাণঘাতী ধর্ম-বিপ্লব, সমাজ-বিপ্লব ও রাষ্ট্র-বিপ্লব ঘটেছে। সনাতনী ও স্থিতিকামীর পরাজয়ে পরিবর্তন-প্রত্যাশীর ও গতিকামীর জয় অবশ্যম্ভাবী জেনেও আজো শাস্ত্র, সমাজ ও সরকার নতুন ভাব-চিন্তার জন্ম-নিরোধে সমান উৎসাহী।
তাই জগতে নতুন চিন্তার তথ্যের ও তত্ত্বের জনকমাত্রই ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দ্রোহী-বিপ্লবী। তাকে চিরকালই নির্যাতিত ও নির্বাসিত কিংবা লাঞ্ছিত ও নিহত হতে হয়েছে। তবু প্রসূত চিন্তা, তথ্য ও তত্ত্ব নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয় না। দূর্বার মতো দুর্বার প্রাণশক্তি নিয়ে তা জনমনে কেবল আত্মবিস্তার করতে থাকে। বাতাসের মতোই তা হয় সর্বগ, আলোর মতো হয় সর্বপ্লাবী। এমনি করে এককালের অনভিপ্রেত নিষিদ্ধ ভাব-চিন্তা লোকগ্রাহ্য ও লোকপ্রিয় শ্রেয়স্কর ধর্মাদর্শ, কাম্য সমাজপদ্ধতি ও বাঞ্ছিত রাষ্ট্রতত্ত্ব হয়ে প্রতিষ্ঠা পায়।
আজ অবধি মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির যা কিছু সার-তত্ত্ব, যা-কিছু গৌরবের ও গর্বের, যা-কিছু মানব-মনীষার ও মহিমার স্মারক তার সবটাই দ্রোহীর দান। কিন্তু স্বার্থচেতনা, নিষ্ক্রিয় স্থিতি-কামনা মানুষের বিবেকবুদ্ধি ছাপিয়ে ওঠে। আপাত শ্রেয়-চেতনার প্রবলতায় ভাবী শ্রেয়বোধ তুচ্ছ হয়ে যায়। তাই কল্যাণের নামে, শৃঙ্খলার নামে, আনুগত্যের স্বস্তির নামে কোনো রীতিনীতির পরিবর্তন, কোনো ত্রুটির শোধন, কোনো অন্যায়ের প্রতিকার, কোনো অশুভের প্রতিরোধ, কোনো বাদের প্রতিবাদ, কোনো প্রতিহিংসার প্রতিশোধ তারা অবাঞ্ছিত উপদ্রব বলে মনে করে। যারা যুক্তি প্রমাণে ফাঁকির ফাঁক দেখিয়ে দিতে চায়, তাদেরকে শাস্ত্র, সমাজ, সরকার উপসর্গ বলেই জানে।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 5 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-5-242x300.jpg)
তাই চিরকাল জ্ঞানের নামে অজ্ঞানকে, বিজ্ঞতার নামে অজ্ঞতাকে, শ্রেয়সের নামে অকল্যাণকে, সত্যের নামে মিথ্যাকে, তথ্যের নামে কল্পনাকে, তত্ত্বের নামে বিশ্বাসকে ভক্তির নামে বিস্ময়কে, অমঙ্গলের নামে ভীরুতাকে লালন করতে তারা আগ্রহী। ফলে মানুষের কল্যাণ-চিন্তা ও কর্ম স্বাভাবিক স্ফূর্তি পায়নি। মানুষের সংস্কৃতি-সভ্যতার বিকাশও আনুপাতিক হারে হয়েছে মন্থর। মানবিক সমস্যাও তাই হয়েছে জটিল, বহু ও বিচিত্র।
যদিও মনুষ্যসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় সমাজ, শাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রাদর্শ প্রভৃতি গড়ে উঠেছে এবং ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র একই উদ্দেশ্যে ত্রিধারায় মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বহন করছে, তবু স্বস্বার্থে শাস্ত্রপতি, সমাজপতি, কিংবা রাষ্ট্রপতি, সনাতন রীতি পরিহারে চিরকালই নারাজ। জ্ঞানমাত্রই-যে অসম্পূর্ণ, অভিজ্ঞতা-যে ত্রুটিমুক্ত নয়, সত্য-যে উপলব্ধি নির্ভর, শ্রেয়চেতনা-যে আপেক্ষিক, তথ্য যে প্রমাণপ্রসূত, তত্ত্ব-যে তাৎপর্য নির্ভর, ভক্তি-যে প্রবণতার প্রসূন, উদ্যমের অনুপস্থিতিতেই-যে স্থিতি-কামনার জন্ম, প্রত্যাশার অভাবই যে সনাতনপ্রীতির মূলে, অজ্ঞতাই-যে বিস্ময়ের আকর, বিশ্বাস-যে যুক্তিবিরহী, ভয়-যে আত্মপ্রত্যয়ের অভাবপ্রসূত, কল্পনার গুরুত্ব যে বুদ্ধিহীনতায়, যুক্তির সন্তান যে প্রজ্ঞা, প্রমাণ-যে পাথুরে হওয়া আবশ্যিক, জ্ঞান-যে উপলব্ধির মাধ্যমে প্রজ্ঞায় পরিতৃপ্তি পায় তা স্বীকার করলে তাদের চলে না।
যা জানা যায় তাই জ্ঞান। জ্ঞান জিজ্ঞাসার প্রসূন। বিৎ বা বিদ মানে জ্ঞেয় যে-জানে অর্থাৎ বেত্তা। স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞানকে বলি অভিজ্ঞতা। আর অপরের অভিজ্ঞতা শুনে জানার নাম জ্ঞান। দৃশ্য ও অদৃশ্য, গুপ্ত ও ব্যক্ত শক্তি ও বস্তু সমন্বিত বিশ্বে কোনো জ্ঞানই আজো পূর্ণ কিংবা অখণ্ড হতে পারেনি। তাই এককালের জ্ঞান অন্যকালে অজ্ঞতা ও মূর্খতা বলে উপহাস পায়। স্থান, কাল ও অন্যান্য প্রতিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে কারণ ক্রিয়া নিরূপণজাত সিদ্ধান্তই জ্ঞান। স্থান-কাল প্রতিবেশ কখনো অভিন্ন থাকে না। তাই কোনো লব্ধজ্ঞানও সর্বজনীন আর সর্বকালীন হতে পারে না। ফলে আমাদের যে কোনো অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও ধারণা সর্বক্ষণ সংশোধন-সাপেক্ষ। তেমনি কোনো আচার বা পদ্ধতিই ত্রুটিমুক্ত নয়।
এসব তত্ত্ব-যে শাস্ত্রবেত্তা, সমাজনেতা কিংবা রাষ্ট্রশাসকের অজানা, তা নয়। কিন্তু স্থিতিশীল সমকালীন পরিবেশ তাদেরকে যে-সুযোগ-সুবিধে দান করে, তার পরিবর্তনে স্ব স্ব জীবনে ও স্বার্থে অনিশ্চয়তা ও বিপর্যয় ডেকে আনতে তারা নারাজ। কেননা তা তাদের বিবেচনায় আত্মবিনাশের শামিল। তাই সুপ্রাচীন কাল থেকেই শাস্ত্রবিদেরা কেবল শাস্ত্রকেই চির-মানবের চিরন্তন জ্ঞান ও আচরণ-বিধির আকর বলে প্রচার করে।
জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে অভ্রান্ত জ্ঞান শুধু শাস্ত্রেই মেলে। অন্যসব জ্ঞান মানবিক অজ্ঞতার প্রসূন। কাজেই যা কেতাবে নেই, তা চোখে-দেখা হলেও জগতে নেই। শাস্ত্রবিরুদ্ধ জ্ঞান কিংবা চিন্তা তাই নিষিদ্ধ। ঐরূপ চিন্তা, জ্ঞান কিংবা কর্ম বর্জনই শ্রেয়। কারণ অর্জন অমঙ্গলের আকর।’ তাই সেকালের রোম থেকে সেদিনকার ইয়ামেন-লিবিয়াতেও আমরা অশাস্ত্রীয় বিদ্যার প্রবেশ নিষিদ্ধ দেখেছি। পাকিস্তানেও ইসলামি জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব বিঘোষিত ও বিকীর্তিত হতে শুনেছি।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 6 কাজী নজরুল ইসলাম এর সাথে আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/কাজী-নজরুল-ইসলাম-এর-সাথে-আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-300x288.jpg)
আর আদমের আমল থেকেই গৃহপতি, গোত্রপতি ও সমাজপতিকে কৌলিক, গৌত্রিক ও সামাজিক রীতিনীতি এবং আচার-সংস্কার সংরক্ষণে সদাসতর্ক দেখা যায়। এরাও দ্রোহ সহ্য করে না। কল্যাণকর নতুন কিছু বরণ করার ঔদ্ধত্য কঠিন হস্তে দমনে এদের অনীহা নেই। এদেরও এক বুলি — যা শাস্ত্রসম্মত নয়, কিংবা লোকাচার-দেশাচার বিরুদ্ধ, যা নতুন তা-ই অনভিপ্রেত, তা-ই অবৈধ ও পরিহার্য। কারণ অন্যথায় তাদের স্বার্থ ও স্থিতি বিপর্যস্ত হয়, সমাজে প্রতাপ বিনষ্ট হয়।
তেমনি শাসকের স্থিতি, স্থায়িত্ব ও স্বার্থের প্রতিকূল যা-কিছু, তা-ই রাজ্য বা রাষ্ট্রের অমঙ্গলকর-অনভিপ্রেত বলে চালিয়ে দেয়ার রেওয়াজও আজকের নয়। রাজ্য পত্তনের মুহূর্ত থেকেই তার শুরু। এজন্য প্রতিকার প্রার্থনা, প্রতিবাদ উচ্চারণ, কিংবা প্রতিরোধ প্রয়াস শাসনপাত্রের ক্ষমার অযোগ্য ঔদ্ধত্য ও অমার্জনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত।
শাস্ত্রকার যেমন শাস্ত্রের অনুগত মেষ-স্বভাব মানুষ চায়, সমাজপতি যেমন মানুষকে গড্ডলিকা বানাতে উৎসুক, সরকারও তেমনি নাগরিককে অনুগত স্তাবক ও অনুগ্রহজীবী অনুচররূপে দেখার প্রত্যাশী।
অতএব, মানুষকে কেউ ধার্মিক বানাতে উৎসুক, কেউ সমাজ-শৃঙ্খল পরাতে উদ্যেগী, কেউবা শাসনের নিগড়ে বাঁধতে ব্যস্ত।
শান্তি-শৃঙ্খলার নামে সবাই আনুগত্যের অঙ্গীকারকামী। ব্যষ্টি ধার্মিক, সামাজিক ও নাগরিক হোক এই-ই কাম্য; কিন্তু বিবেকবান হোক, ন্যায়পরায়ণ হোক—এক কথায় মানুষ হোক এমন কামনা যেন কেউ-ই করে না।
মানবিক গুণের স্বাভাবিক বিকাশের ধারা:
আমাদের শৈশব-বাল্যজীবনে আমাদের ঘরোয়া জীবনের বিশ্বাস-সংস্কার ও রীতি-নীতির প্রভাব এমন একটি জীবনবোধ, এমন একটি চেতনা দান করে যা প্রত্যয়ের ও প্রথার, বিশ্বাসের ও ভরসার, স্বস্তির ও সংস্কারের, এক অদৃশ্য অক্ষয় পাথুরে দুর্গ তৈরি করে। ঝিনুক-কূর্মর দেহাধারের মতোই তা সংস্কারার্জিত চেতনাকে সর্বপ্রযত্নে লালন করে।
জ্ঞানজ প্রজ্ঞা ও মানববিদ্যায় লভ্য তাৎপর্যবোধ মানুষের এই আরোপিত চেতনার দুর্গে আঘাত হেনে তাকে বদ্ধ চেতনার আশ্রয়চ্যুত করে। নিঃসীম আকাশের নিচে মানবিক বোধের উদার প্রাঙ্গণে দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন শুনে পাওয়া প্রত্যয় ও দেখে শেখা আচার ছাপিয়ে অর্জিত জ্ঞান, উদ্ভূত প্রজ্ঞা ও অনুশীলিত বিবেক প্রাধান্য পায়। তখন প্রজ্ঞা ও বিবেকের প্রভাবে আত্মায় ও আত্মীয়ে, স্বভাবে ও সংসারে, জীবনেও জগতে, বিদ্যায় ও বিশ্বাসে, বিবেকে ও বিষয়ে, প্রজ্ঞায় ও প্রত্যয়ে দ্বন্দ্ব কমে এবং তেমন মানুষের হাতে অপর মানুষের বিপদ-সম্ভাবনা ঘুচে। এমনি সুজন সুনাগরিক সৃষ্টিই শিক্ষার লক্ষ্য।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 7 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-4-232x300.jpg)
শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষকে সংবাদের সিন্দুক করা নয়, সুন্দর ও সুস্থ জীবন রচনায় প্রবর্তনা দেয়া, সফল সার্থক জীবনযাত্রার পথ ও পাথেয় দান। তেমনি জীবনযাত্রা সুখকর করবার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল উদ্ভাবনে এবং দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদনে ও তাদের উপযোগ সৃষ্টিতেই বৈজ্ঞানিক প্রয়াস নিয়োজিত। পার্থিব জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজন মিটানো ও নিরাপত্তা সাধনই বিজ্ঞানের কর্তব্য। কিন্তু চিত্তক্ষেত্রে সামষ্টিক জীবনের কল্যাণ-প্রত্যাশায় প্রীতি, করুণা ও মৈত্রীর চাষ করা এবং ফসল ফলানো হচ্ছে বিবেকী আত্মার দায়িত্ব। বিজ্ঞানচর্চার মূলে রয়েছে স্বাধীন চিন্তা ও জিজ্ঞাসা। এ অন্বেষা প্রসারিত করে বহির্দৃষ্টি। এর নাম বিজ্ঞান।
জ্ঞান শক্তিদান করে এবং শক্তির সুপ্রয়োগেই আসে ব্যবহারিক জীবনে সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ্য। যন্ত্রশক্তি তাই আজ অজেয় ও অব্যর্থ। কিন্তু ব্যবহারিক-বৈষয়িক জীবনযাত্রার সৌকর্য বাঁচা নয়, বাঁচার উপকরণ মাত্র। কারণ মানুষ বাঁচে তার অনুভবে ও বোধে, তার আনন্দে ও যন্ত্রণায়। সে অনুভবকে সুখকর সম্পদে, সে-বোধকে কল্যাণপ্রসূ ঐশ্বর্যে পরিণত করতে হলে চাই প্রজ্ঞা, যে প্রজ্ঞা কল্যাণ ও সুন্দরকে প্রীতি ও মৈত্রীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা প্রয়াসী।
বিজ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্রে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার, প্রয়োজন ও প্রীতির সমতা রক্ষিত না হলে আজকের মানুষের প্রয়াস ও প্রত্যাশা ব্যর্থতায় ও হতাশায় অবসিত হবেই। কেবল তা ই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিহিংসা জিইয়ে রাখবে দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম ও সংঘর্ষ-সংঘাত। অতএব, আজ যন্ত্রের সঙ্গে জ্ঞানের, কালের সাথে কলিজার, ম্যাশিনের সাথে মননের, কলের সাথে বিবেকের নিকট ও নিবিড় যোগ এবং প্রাপ্তির সাথে প্রীতির, জ্ঞানের সাথে প্রজ্ঞার, বিজ্ঞানের সঙ্গে বিবেকের সমন্বয় ও সমতাসাধনই আজকের মানবিক সমস্যা সমাধানের পথ ও পাথেয়। উদ্দেশ্যনিষ্ঠ উপায়চেতনা আন্তরিক করার জন্যই আজকের মানুষকে মানববাদী হতে হবে।
কিন্তু কোনো মানুষের মনের ‘সায়’ না থাকলে তাকে জোর করে বাঞ্ছিত ভালো বা মন্দ করা যায় না। তাই কোনো নিয়মের নিগড়ে রেখে অভিপ্রেত বুলি শিখিয়ে অভীষ্ট ফল পাওয়া যাবে না, কেননা মানুষ ম্যাশিন নয়। তার মন বলে যে-শক্তিটি রয়েছে তার অবাধ বিকাশেই কেবল সে সুষ্ঠু মানুষ হতে পারে, এর জন্যে দরকার বিশ্বের সর্বপ্রকারের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তার যথাসম্ভব ও যথাসাধ্য পরিচয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠক্রমে যে-কোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীর মন মেজাজ পঙ্গু করবেই। এ স্তরদুটোতে তাই স্পেসিয়ালাইজেশন বা বিষয়-বিশেষে প্রবণতা সৃষ্টির প্রয়াস মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর হবে।
ধর্মশাস্ত্র শিক্ষা :
শাস্ত্রের সঙ্গে শিক্ষার বিরোধ ঘুচবার নয়, শিক্ষার আপাত উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন। কেননা জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানমাত্রই বর্ধিষ্ণু। কারণ জিজ্ঞাসা থেকেই জ্ঞানের উৎপত্তি। জিজ্ঞাসা
অশেষ তা-ই জ্ঞানও কোনো সীমায় অবসিত নয়। নব নব চিন্তা-ভাবনায় ও আবিক্রিয়ায় জ্ঞানের পরিধি-পরিসর কেবলই বাড়ছে। যত জানা যায়, তার চেয়েও বেশি জানবার থাকে। জ্ঞানবৃদ্ধির অনুপাতে তথ্যের স্বরূপ ও তত্ত্বের গভীরতা ধরা পড়ে। এজন্য জ্ঞানের সাথে ধর্মশাস্ত্র সমতা রক্ষা করতে অসমর্থ। কেননা ধর্মশাস্ত্রীয় সত্য হচ্ছে চিরন্তনতায় ও ধ্রুবতায় অবিচল। তার হ্রাস-বৃদ্ধি ও পরিমার্জন নেই। পক্ষান্তরে জ্ঞান হচ্ছে প্রবহমান। তার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসার আছে, আছে বিবর্তন ও রূপান্তর নতুন তথ্যের উদ্ঘাটন, নবসত্যের আবিষ্কার, পুরোনো জ্ঞানকে পরিশোধিত ও পরিবর্তিত করে।
যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে চাঁদ-সূর্য সম্পর্কে তথ্যগত ও তত্ত্বগত সত্যের রূপান্তর ঘটেছে এবং জিজ্ঞাসু মানুষ তা দ্বিধাহীন চিত্রে গ্রহণ করেছে ও করছে। কিন্তু শাস্ত্রীয় চাঁদ-সূর্য সম্পর্কে প্রত্যয়জাত সত্যের পরিবর্তন নেই বেদে-বাইবেলে। জ্ঞানের সাথে বিশ্বাসের বিরোধ এখানেই। জ্ঞান প্রমাণ-নির্ভর আর বিশ্বাস হচ্ছে অনুভূতি ভিত্তিক। জ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয়জ আর বিশ্বাস হচ্ছে মনোজ। শৈশবে বাল্যে শুনে পাওয়া বিশ্বাস মানুষের মর্মমূলে ঠাঁই করে নেয়। তাই চিত্ত-লোকে আজো মানুষ জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাসের অরণ্যে পথের সন্ধানে দিশেহারা। ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা লৌকিক সংস্কার-নিষ্ঠা বন্ধ্যা, পক্ষান্তরে জ্ঞান সৃজনশীল।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 8 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-2-248x300.jpg)
এজন্যই রসায়ন-শাস্ত্রের অধ্যাপকও পড়াপানিতে পান রোগের ও দুর্ভাগ্যের নিদান, পদার্থবিজ্ঞানী ঝাড়ফুঁকে পান বৈদ্যুতিক সেঁকের ফল। উদ্ভিদবিজ্ঞানীর কাছেও বেলপাতার মর্যাদা আলাদা। জীববিজ্ঞানী ও হুতুম, পেঁচা কিংবা টিকটিকির দৈব প্রতীকতায় আস্থা রাখেন। ফলে প্রায় কেউই অধীতবিদ্যাকে অধিগত বোধে পরিণত করতে পারে না। জর্ডন-জমজম-গঙ্গার পানি, বার-তিথি-নক্ষত্র, হাঁচি-কাশি-হোঁচট, জীন-পরী-অপ্সরা, ভূত-প্রেত-দৈত্য অথবা পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্ব ও দৈব-কাহিনী তাদের জীবনে ও মননে তদের অধীতবিদ্যা ও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের চেয়ে বেশি সত্য ও বাস্তব থেকে যায়।
তাই নিজের সন্তানই যখন পিছু ডাক দেয়,তখন সে আর আত্মজ থাকে না, মুহূর্তের জন্য হয়ে উঠে দৈবপ্রতীক। তেমনি হাঁচি কিংবা কাশি থাকে না নিছক দৈহিক প্রক্রিয়া বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে হয়ে উঠে দৈব ইশারা। সেরূপ কাক, হুতোম, পেঁচক কিংবা টিকটিকির ডাক হয়ে যায় দৈববাণী। এমনি করে আমাদের জীবনে অধীতবিদ্যা ও লব্ধজ্ঞান মিথ্যা হয়ে যায়। লালিত বিশ্বাস-সংস্কারই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের জীবন। ফলে বিদ্যা আমাদের বহিরঙ্গের আভরণ ও আবরণ হয়েই থাকে, আর বিশ্বাস-সংস্কার হয় আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পদ। একারণে অর্জিত বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান, আর লালিত বিশ্বাসের টানাপোড়েনে আমাদের ব্যক্তিত্ব হয় দ্বিধাগ্রস্ত, সত্তা হয় অস্পষ্ট। ভাব-চিন্তা-কর্মে আসে অসঙ্গতি।
যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানের, যুক্তি ও বিশ্বাসের সমন্বয় চান, তাঁরা চাঁদ-সূর্যের অন্বয়রূপে উপস্থিতিই কামনা করেন। এবং তা নিষ্ফলতাকে বিড়ম্বনাকেই বরণ করার নির্বোধ আগ্রহ মাত্র। সামাজিক মানুষের জীবনে মূল্যবোধ জাগে যুক্তি অথবা বিশ্বাস থেকে। মূলত উপযোগ-চেতনা মূল্যবোধের উৎস হলেও যুক্তি ও বিশ্বাসই তার বাহা অবলম্বন। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে অন্ধ। বলতে গেলে যুক্তির অনুপস্থিতিই বিশ্বাসের জন্মদাতা। যুক্তি দিয়ে তাই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্তির অবতারণা ও তেমনি বিড়ম্বনাকে বরণ করা ছাড়া কিছুই নয়।
আজকাল একশ্রেণীর জননেতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকল্যাণকামী মনীষী শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও নীতিবোধের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান কামনা করছেন। নতুন ও পুরোনোর, কল্পনার ও বাস্তবের, যুক্তির ও বিশ্বাসের অথবা দুই বিপরীত কোটির সত্যের সমন্বয়সাধন করে নতুনে ও পুরাতনে, সত্যে ও স্বপ্নে সঙ্গতিস্থাপনে তাঁরা আগ্রহী। তাই পুরোনো ধর্ম ও পুরোনো নীতিবোধের সঙ্গে আধুনিক জীবনচেতনার মেলবন্ধনের উপায় হিসেবে তাঁরা বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মশিক্ষা দানেও উদ্যোগী। কিন্তু এর পরিণাম যে শুভ হবে না—অন্তত যে হয়নি, তার প্রমাণ পাদরি স্কুল ও নিউস্কিম মাদ্রাসা। এ-শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষ কখনো সন্দেহ-তাড়িত, কখনো বা বিশ্বাস-চালিত। এই মানুষের জ্ঞানে-বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব কখনো ঘুচে না। তাই তার জীবন হয় দ্বৈত সত্তায় বিকৃত। ব্যক্তিত্ব থাকে অনায়ত্ত।
আজকের দিনের শিক্ষা-সমস্যা :
বলেছি স্বার্থ বজায় রাখার জন্যে চিরকাল নেতারা নামান্তরে একই নীতি-পদ্ধতি চালু রেখেছে। আদিকালে গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্যের নামে, পরে উপাস্যের অভিন্নতার আবেদনে এবং একালে দৈশিক, রাষ্ট্রিক, ভাষিক, ধার্মিক কিংবা মতবাদীর ঐক্যের নামে মানুষে মানুষে বৈরিতার কারণ জিইয়ে ও ব্যবধানের প্রাচীর খাড়া রেখেছে। শাস্ত্রানুগত্যপ্রসূত নীতিবোধ ও স্বার্থচেতনাজাত স্বাতন্ত্র্য-বুদ্ধি ধর্ম ও জাতীয়তার নামে বন্দিত হচ্ছে এবং ঐ দুটোর নামে চিরকাল যেমন দেশে-দেশে নর-বিধ্বংসী যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে তেমনি আজো হচ্ছে—–অদূর ভবিষ্যতেও হবে। কেননা আজো শাসকেরা সেই সনাতন নীতির সুফলপ্রসূতায় আস্থাবান।
সেজন্যই আজকাল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রাদর্শের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে ব্যক্তিকে, পারিবারিক সামাজিক ও নাগরিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভাব-চিন্তা-কর্ম, আচার-আচরণ, রীতি রেওয়াজ, নীতি-নিয়ম, বিধি-বিধান প্রভৃতি নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষ যে ম্যাশিন নয়, পোষা প্রাণীও নয়, জীবন-যে যান্ত্রিক নয়, মন-যে মানব-ব্যবহারনিয়ম তা স্বীকার করলে ওদের চলে না।
শিক্ষাব্যবস্থাও জীবন-জীবিকা সংলগ্ন। তাই দেশে দেশে শিক্ষানীতিতে দেশ-জাত বর্ণ-ধর্মের প্রলেপ-প্রসাধনের ব্যবস্থাও বাঞ্ছিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফল দুনিয়ার কোথাও কখনো ভালো হয়নি। তবু স্বার্থবুদ্ধির প্রাবল্যে সদবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। শাস্ত্রের, সমাজের ও সরকারের শিক্ষিত লোককে বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারে বড় ভয়। কেননা ওদের চিন্তা ও উদ্যোগই তাদের কায়েমী স্বার্থে ও সুস্থজীবনে বিপর্যয় ঘটায়। তাই সরকারমাত্রই নানাভাবে শিক্ষানিয়ন্ত্রণে প্রয়াসী। বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি সরকারি আগ্রহের মূলে রয়েছে ঐ নীতি। অথচ কোটি কোটি অশিক্ষিত লোক থেকে সরকারের সমাজের কোনো বিপদ-বিপর্যয় নেই বলে তাদের সম্বন্ধে কেউ মাথা ঘামায় না। ভয়ই দরদের আবরণে শিক্ষিতদের প্রতি সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। গুরুতর করে তোলে।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 9 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-1.jpg)
জ্ঞানার্জনের, বিদ্যাভ্যাসের কিংবা কৌশল আয়ত্তকরণের বা নৈপুণ্য-লাভের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য, সাচ্ছল্য ও উৎকর্ষসাধন। জ্ঞান উপায়, উদ্দেশ্য নয়। জ্ঞান কোন সাফল্যে উত্তরণ ঘটায় না। কেননা জ্ঞানের তিনটে স্তর—শেখা, জানা ও বোঝা, তথা শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। যে শিশু ‘কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’ শেখে, সে কোনো পদেরই অর্থ বোঝে না। যে বালক এ চরণ জানে, সেও তার তাৎপর্য বোঝে না। বয়স হলে বোঝে। ‘বরিশালে ধান ও পাট জন্মে’— এ তথ্য জ্ঞানযাত্র। ধান ও পাট উৎপাদনের প্রয়োজন-চেতনাই তথা তাৎপর্যবোধই প্রজ্ঞা!
অতএব জ্ঞান জিজ্ঞাসার সন্তান আর প্রজ্ঞা উপলব্ধির ফসল। সুতরাং যা শেখানো হয় তাই শিক্ষা, যা জানা যায়, তা-ই জ্ঞান বা বিদ্যা এতে মানুষের কোনো উপকার হয় না—যদি না তা বোধের স্তরে উন্নীত হয়ে বোধি হয়। লোক-প্রচলিত বিশ্বাস শিক্ষা ও জ্ঞান মনুষ্য-চরিত্র উন্নত ও নির্দোষ করে এবং মনুষ্য-রুচি, মার্জিত করে। কিন্তু এ তত্ত্বেও কোনো তথ্য নেই। শিক্ষায় বা বিদ্যায় মানুষের চরিত্র বদলায় না বরং যার যা চরিত্র ও রুচি, তা স্বকীয় লক্ষণে বিকশিত হবার সুযোগ পায় মাত্র। পৃথিবীর অধিকাংশ নরদেবতা ছিলেন নিরক্ষর-অশিক্ষিত, তেমনি নরদানবদের অধিকাংশ ছিল শিক্ষিত ও জ্ঞানী। আমাদের দেশেও আজ দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতার সমস্যা তো শিক্ষিত লোক-সৃষ্ট সমস্যা।
কাজেই জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন জ্ঞানজ প্রজ্ঞা লাভের জন্যই। সে-প্রজ্ঞার লক্ষ্যে নিয়োজিত না হলে যে জ্ঞানচর্চা বৃথা, তার সাক্ষ্য ইতিহাস।
এমন এক সময় ছিল, যখন আমরা বলেছি, আমরা আগে মুসলমান পরে ভারতিক। তারপরে বলেছি আগে পাকিস্তানি পরে বাঙালী, এখন বলছি আমার একমাত্র পরিচয় আমি বাঙালী অর্থাৎ আমি আগে বাঙালী পরে মুসলমান বা হিন্দু। অতএব, আমরা কখনো মুসলমান, কখনো পাকিস্তানি, কখনোবা বাঙালী। আমাদের লক্ষ্য যেন কখনো ‘মানুষ’ হবার দিকে ছিল না, এখনো নেই। বড়জোর আমরা বাঙালী মানুষ হব, মানুষ বাঙালী হবার বাসনাই যেন মনে ঠাঁই পায় না। অবশেষে হয়তো একদিন সেই পুরোনো বিলাপ কিংবা খেদ শোনা যাবে রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি’। আজকের আবেগের কুয়াশা ও উচ্ছ্বাসের ধূলিঝড় অবসিত হলে আমরা স্বস্থ হয়ে হয়তো স্বীকার করব সখেদে—’রয়েছি বাঙালী হয়ে মানুষ হইনি’।
এ-যুগে কিন্তু ঠকে শেখার প্রয়োজন হয় না, দেখেই শেখা যায়। তাই ধর্মীয় ও জাতীয় স্বাতন্ত্র্য-চেতনা যে মানব-দুর্ভোগের কারণ এবং এ-যুগে দুনিয়ার কোথাও যে একক ধর্মের ও একজাতের মানুষের বাস সম্ভব নয়, সর্বক্ষেত্রেই সংমিশ্রণ ও সাস্কর্য। অপরিহার্য, তা জেনে-বুঝে একালে ওদুটোর বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়াই কল্যাণকর, তা ই বাঞ্ছনীয়। আমরা পারিবারিক-সামাজিক জীবনে একাধারে কারো সন্তান, কারো বন্ধু, কারো শত্রু, কারো মনিব, কারো বান্দা; তাতে একটা অপরটার বাধা হয়ে দাড়ায় না।
তেমনি দেশ-জাত-বর্ণ-ধর্ম-চেতনা নিয়েও আমাদের প্রথম ও শেষ পরিচয় আমরা মানুষ। বিশেষ রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়েও আমরা বিশ্বের নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক হতে পারি।
রাষ্ট্রাদর্শ অনুগ তথা সরকার-বাঞ্ছিত শিক্ষাপদ্ধতি কতকগুলো তোতা পাখি কিংবা পোষমানা প্রাণী তৈরি করতে হয়তো সমর্থ কিন্তু সুষ্ঠু মানসের মানুষ গড়তে পারে না। সার্কাসের বাঘ-সিংহ যেমন যথার্থ শ্বাপদ নয় তাদের বিকৃত রূপ, তেমনি আরোপিত আদর্শের ও নীতি-চেতনার খাঁচায় লালিত বিদ্বানও সম্পূর্ণ মানুষ হয় না। টবের গাছ ও হাঁড়ির মাছ কখনো স্বাভাবিক বাড় পায় না। জ্ঞানের জগতে শিক্ষার্থীদের অবাধে ছেড়ে দিলে তাদের মন-মেজাজ-মনন স্বাধীন বিকাশ লাভ করবে। আর এটাই কাম্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। জ্ঞানের জগতে দেশকাল-জাতিধর্ম নেই, আছে কেবল তথ্য ও তত্ত্ব এবং মানুষের আবিষ্কৃত তথ্যে ও উদ্ভাবিত তত্ত্বে সর্বমানবিক উত্তরাধিকার রয়েছে।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
তত্ত্বকথা বাদ দিয়েও বলা যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার তথা পাঠক্রমে তথ্য ও সত্যের প্রতি আনুগত্য রেখে জাতীয়, ধর্মীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় আদর্শ-উদ্দেশ্যের প্রতিবিম্বন বা প্রতিফলন সম্ভব নয়। তাহলে কেবল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বৃহৎ পৃথিবীকে, নিরবধি কালকে, বিশ্বের লব্ধজ্ঞানকে লুকিয়ে ছাপিয়ে গাড়ির ঠুলিপরা ঘোড়ার কিংবা ঘানির চোখবাঁধা বলদের মতো নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টির বিভ্রান্ত-মনের নরম মনোভূমে বিকৃতির বীজ উপ্ত করে কতগুলো আধা-মানুষ তৈরি করে লাভ। কেননা, দেখা গেছে কোনো কল্যাণকর চিন্তা বা কোনো সুখকর সৌন্দর্য থেকে মানুষকে কোথাও বেশিদিন বঞ্চিত রাখা যায়নি, বিশেষ করে আজকের বিশ্বে তা নিতান্ত হাস্যকর ব্যর্থ প্রয়াস।
এই যন্ত্র-যুগে বিশ্বের কোনো প্রান্তের কোনো ভাব, চিন্তা, কর্ম, মত, আদর্শ কিংবা সংগ্রাম সেখানেই নিবন্ধ থাকে না, তারে-বেতারে, লোকমুখে কিংবা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে তা বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এখনকার সংহত বিশ্বের মানবিক ভাব-চিন্তা কর্ম আলোর মতো, বাতাসের মতো সর্বমানবের উপভোগ্য ও উপজীব্য হয়ে ওঠে। কেউ কাকেও শত প্রযত্নেও বঞ্চিত করতে পারে না। তা ছাড়া নতুন ভাব, চিন্তা, কর্ম, মত বা আদর্শ চিরকালই একক মানুষের দান। সে-মানুষ কোথায় কখন কীভাবে আত্মপ্রকাশ করে, তা কেউ আগে থেকে জানতে পায় না। ঐ একজনের আবির্ভাবের ভয়ে অসংখ্য মানুষকে পঙ্গু করার ব্যবস্থা রাখা অমানবিক। ফেরাউন কিংবা কংসের ব্যর্থতার কথা এ-সূত্রে স্মর্তব্য।
এও উল্লেখ্য যে, আজ আমরা আমাদের রাষ্ট্রের যে চতুরাদর্শের কথা ভেবে গর্বিত, তাদের প্রত্যেকটিই এককালের নিষিদ্ধ কথা এবং পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তাদের উদ্ভব আর প্রত্যেকটির জনক বা উদ্ভাবকও একক ব্যক্তি। এসব চিন্তার জনককে হয়তো লাঞ্ছিত নয়তো নিহত হতে হয়েছে। প্রথমদিকে ধারক-বাহকদেরও নিয়তি ছিল অভিন্ন। কিন্তু তবু উচ্চারিত চিন্তা বা মত বা আদর্শের সংক্রমণ থেকে পৃথিবী মুক্ত থাকেনি। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে ও স্বীকৃতি পেতে সময় লেগেছে বটে, কিন্তু নিরবধি কালের তুলনায় তা কিছুই নয়। অতএব শিক্ষার মাধ্যমে অনুগতজন তৈরির রাষ্ট্রিক প্রয়াস বৃথা ও ব্যর্থ হবেই।
বৃটিশ আমলে দায়ে ঠেকে এদেশের সীমিত সংখ্যার মানুষকে কেরানি ও চাকুরে বানাবার জন্য শাসকগোষ্ঠী ইংরেজিশিক্ষা চালু করেছিল বটে, কিন্তু এদেশে উচ্চশিক্ষায়ও ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ডের অনুকৃতি ছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শনের কোনো কেতাব থেকেই এদেশী ছাত্রকে বঞ্চিত করা হয়নি। এ বিদ্যায় যে কয়জন মানুষ হবার হয়েছে, যারা না হবার হয়নি। কিন্তু শিক্ষাবিস্তারের কোনো ইচ্ছাই সরকারের ছিল না। এ সরকারি নীতি আজ অবধি এদেশে অপরিবর্তিত রয়েছে।
অবশ্য বিশুদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্মীয়, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রিক আদর্শ ও নীতি কেজো ও প্রয়োগযোগ্য না হলেও বৈষয়িক বিদ্যা রাষ্ট্রিক প্রয়োজনানুগ হতে পারে—যেমন প্রযুক্তিবিদ্যা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যবস্থাপনা বিদ্যা, নৌবিদ্যা, সমরবিদ্যা, খনিজবিদ্যা, ভূবিদ্যা, সমুদ্রবিদ্যা প্রভৃতি জীবিকা-সংস্থান লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক বিদ্যায় রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ অসঙ্গত নয়। এসব বিদ্যালয়-ক্ষেত্রে শিক্ষাকে গণমুখী, দৈশিক, জাতিক কিংবা আঞ্চলিক করা এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত করাও অযৌক্তিক হবে না।
কিন্তু মানুষ গড়া অর্থাৎ মানবিক বোধ-বিবেকের উৎকর্ষসাধন লক্ষ্যে শিক্ষাদান করতে হলে মানববিদ্যায় গুরুত্ব দিতেই হবে। কেননা মানববিদ্যাই মানুষের মানসজগৎ প্রসারিত করে। বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষের ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মিটায় কিন্তু যে নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মানুষকে নির্বিশেষ মানুষ ও মানববাদী করে তা বহুলাংশে মানববিদ্যার প্রভাবপ্রসূত। প্রাণ থাকলেই প্রাণী, জীবন থাকলেই জীব, তেমনি পরিস্তুত মন থাকলেই হয় মানুষ। মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে মনের ঐশ্বর্য চাই। নইলে জৈব-জীবন অসার।
![শিক্ষাতত্ত্বের গোড়ার তত্ত্ব [ Early theory of pedagogy ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 11 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature এবং আহমেদ সফা](https://glive24.com/wp-content/uploads/2022/02/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-6-300x208.jpg)
ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য-শিল্প প্রভৃতিই মানুষের মনের হীনতা, সংকীর্ণতা, অজ্ঞতা, অসূয়া, অসহিষ্ণুতা ঘুচিয়ে উদারবোধের জীবনে উত্তরণ ঘটাতে পারে। কেননা প্রজ্ঞা, প্রীতি ও কল্যাণবুদ্ধির পরিশীলন ও বিকাশ এ মানববিদ্যার উদার অঙ্গনেই সম্ভব। আজ যন্ত্র ও যান্ত্রিকতা মানুষের বৈষয়িক ও ব্যবহারিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই মানববিদ্যার মাধ্যমে মনের পরিচর্যা আজ আরো জরুরি হয়ে উঠেছে। কেননা যন্ত্রীর মন যদি কল্যাণকামী না হয়,
তাহলে যন্ত্র কখনো কল্যাণপ্রসূ হতে পারে না। জ্ঞানকে আমরা চোখের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখি। চোখের দৃষ্টি আমাদের চলার পথ নির্বিঘ্ন করে, জীবন-জীবিকার সর্বক্ষেত্রেই সহায়ক হয়। জ্ঞানও তেমনি প্রজ্ঞারূপে আমাদের মানসজীবন উদ্দীপ্ত, নিরাপদ ও স্বস্তিকর করে।
উপসংহার :
আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের আলোচনা প্রত্যক্ষ ও বাস্তব সমস্যাভিত্তিক না হয়ে পারোক্ষ ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যে অবসিত হল বলে মনে হবে। ভাববাদী বলে নিন্দিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও বলব এ-যুগের জটিল জীবনচেতনার এবং দুঃসাধ্য জীবিকা সংস্থান প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাক্ষেত্রে মানবিক চেতনার ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষার গুরুদায়িত্ব এখন শিক্ষালয়ে শিক্ষকের।
সেইজন্যই জৈবিক ও মানবিক বৃত্তির একটি সমন্বয়সাধন অত্যন্ত জরুরি। আর এই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে হলে মানবিক গুণের স্বাধীন ও সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাহত না করেই জৈবিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রয়োজনানুগ বৃত্তিমূলক শিক্ষাদান বাঞ্ছনীয়। তাই আমরা মনে করি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কেবল মানববিদ্যা ও বিজ্ঞানের পাঠক্রম পড়ুয়াদের গ্রাহিকা-শক্তি অনুযায়ী তৈরি হওয়া আবশ্যিক। প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়াদের কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা জাগানোই থাকবে প্রধান লক্ষ্য। মাধ্যমিক স্তরে (বয়ঃসীমা পনেরো) বুদ্ধিবৃত্তি, সৌন্দর্যচেতনা ও শ্রেয়বোধ জাগানোর লক্ষ্যেই পাঠক্রম রচিত হবে। এবং উচ্চশিক্ষায় পড়ুয়াদের প্রবণতা অনুসারে বৃত্তিমূলক বিদ্যা নির্বাচনে স্বাধীনতা থাকা দরকার।
অবশ্য কৃষিবিদ্যা, কৃৎ-কৌশল, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, সমুদ্রবিদ্যা, নৌবিদ্যা, সমরবিদ্যা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সামর্থ্যানুযায়ী সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের পক্ষে অন্যায় বা অবাঞ্ছিত নয়। কারণ রাষ্ট্রের জনগণের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করা শেষাবধি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে স্বীকৃত। কিন্তু তাই বলে মানুষ নির্বিশেষের মানবিক গুণ বিকাশের স্বাধীন অধিকার থেকে কাউকেও বঞ্চিত রাখা এ-যুগে নিশ্চয়ই অমানুষিক অপরাধ। তাই কেবল কর্মী ও যন্ত্রী হওয়া কিংবা বানানো জীবনের বা রাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে পারে না। এ কারণেই শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা মাধ্যমিক স্তর অবধি কেবল মানুষ গড়ার পদ্ধতি উদ্ভাবনে ও আবিষ্কারে গুরুত্ব দিতে চাই।
শিক্ষায় মানুষমাত্রেরই যে জন্মগত অধিকার রয়েছে, তা আজ আর অস্বীকৃত নয়। তাই কাজ দেয়া যাবে না বলে সাধারণ শিক্ষা থেকে কাউকে বঞ্চিত রাখা চলবে না এই সাধারণ শিক্ষাকে মাধ্যমিক স্তর অবধি জীবন-সংলগ্ন রাখতে হবে, যেমন উচ্চশিক্ষা হবে জীবিকা-সংপৃক্ত। কারণ বোধশক্তির ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশই মনুষ্যত্বের সোপান। তাই সর্বজনীন তথা গণশিক্ষার প্রবর্তন ও বয়স্কশিক্ষার আশু ব্যবস্থা করা আবশ্যিক।
এ সূত্রে বিশেষ স্মর্তব্য যে, সাধারণ মানববিদ্যার সঙ্গে যেমন বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিবিদ্যারও কিছু সংলগ্নতা কাম্য ও আবশ্যক, তেমনি উচ্চবৃত্তিমূলক বৈষয়িক বিদ্যা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পের যে-কোনো একটি পাঠ্য রাখা দরকার। তাহলেই কেবল বিবেকবান আনাড়ি-মানুষ বা হৃদয়হীন যন্ত্রী-মানুষ তৈরির সমস্যা থেকে সমাজ মুক্ত থাকবে। এ ছাড়া বিবেচক মানববাদী মানুষ তৈরির অন্য উপায় আজো অনাবিষ্কৃত।
আরও পড়ুন: